E-Paper

যথাযথ পর্বতারোহী হয়ে ওঠাই প্রথম শর্ত

না হলে আমন্ত্রণ করা হবে বিপদকেই। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা না থাকলে শুধু যে সাফল্য অধরা থাকবে তা-ই নয়, যেতে পারে প্রাণও। সাম্প্রতিক বহু ঘটনায় রয়েছে এর প্রমাণ।

পর্বতারোহণ: এভারেস্ট অভিযান।

পর্বতারোহণ: এভারেস্ট অভিযান। ছবি: পিটিআই।

দেবাশিস বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৫ ১০:০৮
Share
Save

এভারেস্ট অভিযানের একটা অলিখিত নিয়ম হল, আগের রাতে সাউথ কলের ক্যাম্প-৪ বা সামিট ক্যাম্প থেকে সামিটের দিকে রওনা হয়ে পরদিন সকাল ১০-১১টার মধ্যে আরোহী যেখানেই থাকুন না কেন, সেখান থেকে তাঁকে ফেরার পথ ধরতেই হবে। না হলে সুস্থ ভাবে ক্যাম্প-৪’এ নামা কার্যত অসম্ভব।

আর সামিট ক্যাম্প থেকে শীর্ষারোহণে রওনা হওয়ার সময় প্রতি মুহূর্তে মাথায় রাখতে হবে যে, ওঠার সময়েই শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিলে চলবে না; তার কিছুটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে সুস্থ ভাবে ওই ক্যাম্পের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরেআসার জন্য।

খবর পেয়েছিলাম, এ বছর এভারেস্ট অভিযানে যাওয়া রানাঘাটের রুম্পা দাস ও সুব্রত ঘোষের সামিট হয়েছে সেই নির্ধারিত সময়েরও বেশ কিছুটা সময় পরে। এই তথ্য জানার পর চিন্তা বেড়েছিল। কারণ, হাওয়ার গতিবেগ বেশি থাকায় আগের রাতে অনেকটা দেরি করেই রওনা দেন ওঁরা। ফলে সামিটও হয় দেরিতে। এর পরে কোনও ক্রমে রুম্পা নেমে এলেও আশঙ্কা সত্যি করে ক্যাম্প-৪’এ আর পৌঁছনো হয়নি সুব্রতর। হিলারি স্টেপের কাছেই এখনও রয়ে গিয়েছে সুব্রতর দেহ। যদিও অনেক কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বর্ধমানের সৌমেন সরকার আর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল অবশ্য এ বছর শীর্ষ ছুঁয়ে সুস্থ ভাবে নেমে আসতে পেরেছেন।

এখানে একটা কথা বলার আছে। পর্বতারোহণে তেমন অভিজ্ঞতা না থেকেও এভারেস্টের টানে পা বাড়াচ্ছেন অনেকে, যার ফল অনেক সময়ে হচ্ছে মারাত্মক। জানতে ইচ্ছে করে, এর আগে ক’টি শৃঙ্গারোহণ করেছেন এঁরা? ক’জনের ১০-১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে? ৬-৮টি ছ’হাজারি শৃঙ্গ, অন্তত একটি সাতহাজারি শৃঙ্গারোহণের কৃতিত্ব কি রয়েছে? ইউনাম, স্টক কাংরি, রেনকের মতো সাধারণ মানের শৃঙ্গারোহণ করে কোন যুক্তিতে, এঁরা সটান এভারেস্টে পাড়ি দেওয়ার সাহস পান?

এভারেস্ট অভিযানের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ অভিযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযাত্রীকে নিজের ভুলের মাসুল দিতে হয়েছে। সুব্রতকেও হয়তো এমনই কোনও ভুলের মূল্য দিতে হল। আসলে পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতাই বিপদ থেকে অভিযাত্রীকে বাঁচিয়ে আনার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। যত দূর জানি, সুব্রতর দীর্ঘ পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা ছিল না, আগে একটি অভিযানে অধিক উচ্চতাজনিত সমস্যাতেও পড়েছিলেন। রুম্পা নেমে এলেও প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে যে, যথেষ্ট সুস্থ থাকলে তাঁকে ক্যাম্প-টু থেকে হেলিকপ্টারে নামাতে হল কেন? ভবিষ্যতে আটহাজারি অভিযানে যেতে হলে রুম্পাকে এ ব্যাপারে আরও যত্নশীল হতে হবে। কারণ, এভারেস্টের মতো সুযোগসুবিধা অন্যত্র মিলবে না। এর আগে এভারেস্টে হাওড়ার কুন্তল কাঁড়ারের হাতের আঙুলে ফ্রস্টবাইট হয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, এ জন্য অন্য শৃঙ্গে তোমায় আরও বেশি সাবধান হতে হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে কুন্তল ও বিপ্লব বৈদ্যের করুণ পরিণতির কথা সকলেরই জানা। আসলে এভারেস্টের সুযোগসুবিধায় অল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা সাফল্যের মুখ দেখলেও তা তাঁদের মনে এক ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিতে পারে। তিনি নিজেকে বেশি অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ভাবতে শুরু করতে পারেন; তাঁকে দেখে আবার অন্য কেউ ভাবতে পারেন, আমিও কেন পারব না? ফলে একটা ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।

হাতের কাছেই এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। ২০১৩ সালে ছন্দা গায়েন একযোগে এভারেস্ট-লোৎসে আরোহণ করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। যদিও তার আগে তেমন বড় কোনও আরোহণ ছন্দার ঝুলিতে ছিল না। জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে হয়তো তিনি তাঁর শারীরিক ও মানসিক শক্তির পরিমাপে ভুল করেছিলেন। পরের বছর, ২০১৪ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন দুরূহ কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে দুর্গম ইয়ালুং কাং বা কাঞ্চনজঙ্ঘা পশ্চিম অভিযানের! যাওয়ার আগে কি খোঁজ নিয়েছিলেন, এর আগে ওই জোড়া অভিযান কে বা কারা করেছেন? তাঁদের আরোহণ ক্ষমতা কতটা? সেই পড়াশোনা ছিল না বলে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করায় কাঞ্চনজঙ্ঘায় আমরা অকালে হারাই ছন্দা ও তার সঙ্গী দুই দক্ষ শেরপাকে।

আবার অনেক অভিজ্ঞ পর্বতারোহীও ভাগ্যবিড়ম্বনায় এভারেস্টে বিফল হয়েছেন। যেমন, সুব্রত চক্রবর্তী। এক চাকার সাইকেলে ভারত-ভ্রমণ, অসংখ্য পর্বতাভিযানে সাফল্যের অধিকারী সুব্রত ২০১৪ সালে তিব্বত দিয়ে এভারেস্ট অভিযানের কথা ভাবেন। পরে আয়োজনকারী সংস্থার পরামর্শমতো নেপালের পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সে বছর খুম্বু হিমবাহে তুষারধসে ১৬ জন শেরপার মৃত্যুতে বাতিল হয় অভিযান। ভাগ্যের ফেরে খালি হাতে ফিরতে হয় সুব্রতকে।

এ দেশে হিমালয়ে পর্বতারোহণের অনুমতি দেয় ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন। তবে অভিযাত্রী দলকে কিছু ন্যূনতম যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়। দলনেতার বয়স ২৫ বছরের বেশি এবং তাঁর ‘অ্যাডভান্সড মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স’ করা বাধ্যতামূলক। কমপক্ষে দু’টি ৬,৪০০ মিটারের বেশি উঁচু শৃঙ্গাভিযানে অংশ নিতে হবে, কমপক্ষে একটিতে সফল আরোহণ করতে হবে। নেতা-সহ দলের অর্ধেক সদস্যের ‘অ্যাডভান্সড কোর্স’ করা থাকতে হবে ও কিছু অভিযানের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একটি দলে কোর্স না-করা সর্বোচ্চ দু’জন সদস্য থাকতে পারবেন, তবে তাঁদের উচ্চ উচ্চতায় ট্রেকিং এবং রক ক্লাইম্বিংয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে।

অথচ নেপালে এমন কোনও নিয়ম নেই। যে কেউ টাকা দিয়েই যে কোনও শৃঙ্গে আরোহণের অনুমতি পেতে পারেন। ২০২৪ সালে নেপাল সরকার ঘোষণা করেছিল, আটহাজারির আগে অন্তত একটি সাত হাজার মিটার উচ্চতার শৃঙ্গারোহণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়নি। কাঠমান্ডুর বিভিন্ন নামী আয়োজনকারী সংস্থাও বিজ্ঞাপনে লেখে যে, ‘মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে চলে আসুন, পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে, আমরা আপনাকে চড়িয়ে দেব।’

রূঢ় বাস্তব হল, যত দিন পর্যন্ত কড়া নিয়ম নেপালে চালু না হচ্ছে, তত দিন এ ধরনের অভিযানের প্রবণতা আর উন্মাদনা থাকবে। সেই সঙ্গে ঘটবে দুর্ঘটনাও।

এই সংস্থা পরিচালিত অভিযানেরও সমস্যা রয়েছে। সাধারণত কোনও আরোহী অভিযানের আগে দীর্ঘদিন সেই শৃঙ্গের অতীত-রিপোর্ট নিয়ে চর্চা করেন। পথে কোথায় বিপদ, কোথায় কতটা দড়ি বা সরঞ্জাম লাগবে, কত জনের দল হবে, কোথায় ক্যাম্প লাগানো যাবে, কতটা খাবার নিতে হবে— সেই বিশদ ধারণার প্রয়োজন রয়েছে। তবেই অভিযান সাফল্য পায়। অথচ সংস্থানির্ভর অভিযানে বেশির ভাগ আরোহীই চোখ বুজে চলে যান শুধুমাত্র শেরপা, গাইড আর এজেন্সির ভরসায়। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হলেই বিপত্তি। কারণ আরোহীর সেই আরোহণ নিয়ে তাঁর নিজস্ব কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি, ফলে কোনও প্ল্যান বি, প্ল্যান সি ছকে রাখা নেই।

এ বার অন্তত এটুকু বোঝার প্রয়োজন ও সময় এসেছে যে, যথেষ্ট অভিজ্ঞতা বা পড়াশোনা ছাড়া এভারেস্ট-কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো বড় শৃঙ্গে পা বাড়ানো বিপদকে সাদরে ডেকে আনার শামিল। বাড়ি বন্ধক রেখে এভারেস্টে পৌঁছেই বা কী মিলবে? ওই বিপুল ঋণের বোঝা তো টানতে হবে নিজেকেই। তার চেয়ে দেশের হিমালয়ে আরোহণ করলে দক্ষতাও বাড়বে, খরচও সাধ্যের মধ্যে থাকবে। আর পর্বতারোহী হিসাবে মিলবে নিজের হাতে সব কিছু করে অভিযান সফল করার মানসিক তৃপ্তি। সংস্থার হাত ধরে পর্বতারোহণে গিয়ে পর্বতারোহী হিসাবে উত্তরণ কতটা হয়, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাই একান্ত আবেদন, এই ভিত্তিহীন, অকারণ উন্মাদনা বন্ধ হোক। আগে যথাযথ পর্বতারোহী হওয়ার চেষ্টা করুন, তার পরে না-হয় এভারেস্ট-কাঞ্চনজঙ্ঘা-অন্নপূর্ণার দিকে পা বাড়াবেন!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mount Everest trekking

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।