Advertisement
E-Paper

মাসিমা পিৎজা খামু

এক সময় ‘পাড়ার ছেলে’ নামে একটা বস্তু ছিল। তারা যেমন ফিচলে, তেমন ওস্তাদ। এর জানলায় আড়ি পাতছে, ওর মেয়েকে চিঠি দিচ্ছে, চাঁদা তুলতে গিয়ে চোপা করছে।এক সময় ‘পাড়ার ছেলে’ নামে একটা বস্তু ছিল। তারা যেমন ফিচলে, তেমন ওস্তাদ। এর জানলায় আড়ি পাতছে, ওর মেয়েকে চিঠি দিচ্ছে, চাঁদা তুলতে গিয়ে চোপা করছে।

সুন্দর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৫
‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবির ‘পাড়ার ছেলে’রা।

‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবির ‘পাড়ার ছেলে’রা।

শক্তিপদ ধাড়া জীবনবিমার উচ্চপদস্থ অফিসার। প্রতি দিন সকাল আটটায় বের হন, ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। পদমর্যাদার কৌলীন্যে তিনি পাড়ার ছেলেদের বিশেষ পাত্তা দেন না। তাঁর মেয়ে নন্দার সঙ্গে প্রেমের চেষ্টা করে আমাদের বিল্টু। তা তো করে, কিন্তু লাস্ট সিনে সানাই বাজবে কি? ঠিক নেই। তবুও পাড়ার ছেলের স্বাভাবিক সৌজন্যে ক্লাস টেন-এর নন্দাকে আমরা বন্ধুপত্নীর মর্যাদা দিয়ে থাকি।

রোববার সন্ধের মুখে আমরা শক্তিবাবুর বাড়ি গেছি চাঁদা নিতে। দরজার বেল টিপতেই তিনি দোতলার বারান্দা থেকে বাজখাঁই গলায় বললেন— ‘কে?’

— আজ্ঞে, পাড়ার ছেলেরা। সরস্বতী পুজোর চাঁদাটা...

তিনি দোতলার বারান্দা থেকে শরীর খানিক ঝুঁকিয়ে সেই আধো-অন্ধকারে আমাদের মুখগুলো দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘পাড়ার ছেলে! কই, একটাকেও তো চেনা লাগছে না।’ বিল্টু বলে উঠল, ‘মেয়েকে ডাকুন, চিনতে পারবে।’

ব্যস, এই একটি মন্তব্যে নন্দা পর দিন থেকে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেল।

আমাদের হেডস্যরের দোতলা বাড়ির এক তলার ভাড়াটে এইচ কে মিত্র— ধুরন্ধর ব্যবসায়ী। বাজারে বিড়ির হোলসেল দোকান। আমরা বলতাম হাড়কিপ্‌টে মিত্তির। প্রতি সন্ধেয় তিনি হেডস্যরের সঙ্গে দাবা খেলতে বসে ইচ্ছে করে হারতেন, যাতে বাড়ির ভাড়াটা না বাড়ে। তাঁর সরস্বতীপুজোর চাঁদা পঞ্চাশ পয়সা বছরের পর বছর ফিক্সড।

সেই বছর বিল্টু বলল, ‘কাকু কিছু বাড়ান—’

মিত্তিরবাবু খিঁচিয়ে বললেন, ‘বাজার আগুন, কোথা থেকে দেব?’

বিল্টু অম্লানবদনে বলল, ‘কেন, বিড়ি বেচে দেবেন!’

তিনি হতচকিত হয়ে চুপ করে গেলেন কিছু ক্ষণ, তার পর খানিক উদাস স্বরে বললেন, ‘বাড়াতে বললেই কি বাড়ানো যায়? ঘরের মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে...’

বিল্টু এ বার আরও অকপট। বলল, ‘চিন্তা করছেন কেন, আমরাও তো বড় হচ্ছি। পাড়ার ছেলেদের ওপর ভরসা রাখুন।’

বলা বাহুল্য, সে দিন সন্ধেয় দাবা-বোর্ডে মিত্তিরমশাই হেডস্যরের কাছে বিশ্রী ভাবে এক বার নয়, বার দুয়েক হারলেন এবং তার পর যথাবিহিত সম্মান পুরসরঃ নিবেদনমিদং... ফল যা হবার তা-ই হল। পর দিন স্কুলে আমরা বেইজ্জত।

মিত্তিরবাবুর দুই কন্যা— স্বর্ণচরি ও বালুচরি। সকালে বাপ বেরিয়ে যেতেই দুজনে চরকির মতো ঘুরে বেড়ায় পাড়ায়। আমাদের আড্ডার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে বুকের ভেতর পরিষ্কার দুম দুম শব্দ শুনতে পাই।

মিত্তিরবাবু তো কমপ্লেন বক্স, কিন্তু তাঁর দুই মেয়ে দুটো যেন লেটার বক্স। প্রতি দিন অসংখ্য প্রেমপত্র জমা হচ্ছে সেখানে। বিল্টু দু’বোনের কাছে রিফিউজ্ড হবার পর, রাগ মেটাতে ওদের সদর দরজায় চক দিয়ে লেটার বক্স এঁকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিল ‘লাভ লেটার বক্স— পুরা ভর্তি হইলে খোলা হয়।’ শেষ পর্যন্ত ‘রাস্টিকেট’ হওয়ার ওয়ার্নিং মাথায় নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল বিল্টু।

স্কুলে বাংলা ক্লাসে হিন্দি সিনেমার পোকা ট্যারা-পল্টু ‘ইজ্জত’ লিখতে গিয়ে লিখে ফেলল ‘ইজাজত’। বাংলা টিচার ভূপেনবাবু জীবনে ও শব্দ শোনেননি। বললেন, ‘এর মানে কী বাবা পল্টু?’

— কেন, সব ক’টা অক্ষরই তো রয়েছে স্যর। একটা ‘ই’, দুটো বর্গীয় জ আর একটা ‘ত’।

— তা রয়েছে, কিন্তু এর মানে কী?

পল্টু অম্লান বদনে বলল, ‘পাড়ায় পোস্টার দেখেননি, রেখা রয়েছে স্যর...’

পিঠে জোড়া বেত ভাঙার পর পল্টুর বোধোদয় হল, বেইজ্জত করতে ইজাজত লাগে না।

পাড়ার একমাত্র হাইস্কুল নিস্তারিণী বালিকা বিদ্যালয়ে ১৫ আগস্ট লুচি-আলুর দম করতে গিয়ে আগুন লেগেছে। সেই আগুনে শামিয়ানা পুড়ল, বাঁশগুলো জ্বলতে জ্বলতে চড়চড় করে বেড়ে ওঠা আগুন প্রায় জাতীয় পতাকার কাছাকাছি। স্কুলে হুলুস্থুলু। হঠাৎ কোথা থেকে খ্যাপা খোকন— যে ক্লাস এইটের পর আর স্কুলমুখো হয়নি, আগুনের তোয়াক্কা না করে, আর একটা বাঁশ নিয়ে পোল ভল্টের কায়দায় লাফ মেরে জাতীয় পতাকা অক্ষত অবস্থায় নামিয়ে নিয়ে এল।

চার দিকে ধন্য ধন্য। খ্যাপা খোকন রীতিমত ভিআইপি। তার প্রেমিকা, ক্লাস এইটের বুল্টি, সে দিন স্কুল ইউনিফর্মের বদলে নাচের পোশাক পরেছিল। সে চোখ বড় বড় করে খোকনের দিকে তাকিয়ে। সে চোখে চোখ রেখে খোকনের যে কী হল... সে ঢিপ করে হেডস্যরের পায়ে একটা প্রণাম ঠুকে বলল, ‘মাপ করে দেবেন স্যর, আমি পাড়ার ছেলে...’

হেডস্যর অবাক! মাপ কীসের? খোকন কিছু ক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘বুল্টিকে দেখব বলে প্যান্ডেলের পেছনে ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। আমারই বিড়ি থেকে আগুনটা লেগে গেল স্যর...’

অভয় হালদার লেন, বনমালী নস্কর লেন, বরোদা বসাক স্ট্রিট— শহরে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট রাস্তা এবং জমে ক্ষীর হয়ে যাওয়া এক একটা পাড়া— গলি ক্রিকেট, ফাইভ-এ-সাইড ফুটবলে মাতোয়ারা। ঘোষগিন্নির ননদের ফোন এল বিশু মিত্তিরের বাড়িতে। ‘একটু ডেকে দেবেন, দশ মিনিট পর ফের করছি।’

ঘোষেরা চার-পাঁচটা বাড়ির ও পারে। কে ডাকবে? জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মিত্তিরমশাই দেখলেন দশ নম্বর জার্সি পরে পাড়ার ছেলে গোপাল একমনে বল নাচাচ্ছে।

‘অ্যাই গোপলা, ঘোষবাড়িতে খপর দে, ফোন এয়েচে...’

বলটা পায়ে আঠার মতো লাগিয়ে ড্রিব্‌ল করতে করতে ঘোষগিন্নিকে ধরে নিয়ে এল গোপাল।

দশ মিনিট পর ননদের ফিরতি ফোন— ‘শ্যামবাজারে সেল দিচ্ছে, যাবে নাকি বউদি?’

— রাখ তোর সেল, আজ পাড়ায় ফুটবলের ফাইনাল! গোপলা-বিশে, পল্টু— এরা সবাই খেলচে। কালীঘাটে পুজো দিয়ে এলুম। আমাদের রোয়াকটাই তো এদের— কী বলে... হ্যাঁ, প্যাভিলিয়ন।

গোটা পাড়াটাই পাড়ার ছেলের প্যাভিলিয়ন— তারা ভয়ের নয়, ভক্তিরও নয়। স্নেহের নয়, স্নেহচ্যুতও নয়। কিংবা সবগুলোই।

কল্যাণ ঘোষ নামকরা ডাক্তার। গোটা উত্তর কলকাতা জোড়া খ্যাতি। তা সে নামডাক যতই হোক, পাড়ার ডাক্তার, রাতবিরেতে কল এলে যেতেই হয়। রাত দেড়টায় ফোন এল, বোসবাড়ির ছোট নাতি জ্বরে বেহুঁশ।

ডাক্তার বললেন, ‘এখুনি আসছি।’

কিন্তু আসবেন কী! বাইরে ঘোর অন্ধকার। ক’দিন আগে সামনের ল্যাম্পপোস্টের বাল্‌ব কে ঢিল মেরে ভেঙে দিয়েছে। টর্চ হাতে গেট খুলে বাইরে আসা মাত্র কেউ যেন তাঁরই বাড়ির কার্নিস থেকে লাফিয়ে নামল। ডাক্তার চেঁচালেন— ‘কে রে?’ ছেলেটি অন্ধকারে মুখ ঢেকে বলল, ‘আপনি যাচ্ছেন বোসেদের উপকার করতে, আমি কী করে আপনার ক্ষতি করি! আজ আর হল না স্যর, চলুন পৌঁছে দিই।’ ডাক্তার বুঝলেন ব্যাটা চোর হতে পারে, কিন্তু পাড়ারই ছেলে।

ভৌমিক বাড়ির ছোট ছেলে শ্যামল অষ্টমঙ্গলা সেরে ফিরে এসেছে। রাতের অন্ধকারে আমরা তার জানলার নীচে ঘাপটি মেরেছি। জানলা তো একটাই। আমরা পাঁচ জন। তাই বিল্টু রিলে করছে, আমরা কল্পনা করছি।

বিল্টু ফিসফিস করে বলল, ‘বউদি সবে শুয়েছে, শ্যামলদা জল খাচ্ছে।’

ও দিকে নতুন বউ কিছু আঁচ করে ধড়মড় করে উঠে বসে পড়েছে।

শ্যামলদা হেসে বলল— ‘ও কিছু না, পাড়ার ছেলে। দেখবে কম, ভাববে বেশি। আমরাও করতুম।’

পাড়াগাঁ অনেক আগেই দেহত্যাগ করেছেন। নব্বইয়ের দশকে পাড়াও ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন। তার পর থেকে চতুর্দিকে কমপ্লেক্স— লেক ভিউ, মল ভিউ। শুনেছি, টালিগঞ্জের এক আবাসনের নাম মহানায়ক ভিউ— সে বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়ালে উত্তমকুমারের মূর্তি দেখা যায়। এখন কমপ্লেক্সগুলোতে সব আছে— জিম, ক্লাব, সুইমিং পুল। নেই কেবল একটি জিনিস— পাড়ার ছেলে।

কিন্তু পাড়ার ছেলে এমনই চরিত্র, হারিয়েও হারায় না। দূর মফস্‌সলের শান্ত প্ল্যাটফর্মে কোনও প্রৌঢ় দম্পতির সঙ্গে হয়তো দেখা হয়ে যায় অন্য এক বৃদ্ধের। মুখোমুখি দুজনেই কিছু ক্ষণের জন্য স্থির।

বৃদ্ধ বলে ওঠেন— ‘তুই এখানে?’ প্রৌঢ়াও অবাক হয়ে বললেন ‘তুমি!’

ঠিক তখুনি আসা লোকালটায় চাপতে চাপতে বৃদ্ধ বললেন, ‘আজ আসি রে, পরে দেখা হবে।’

ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে তাকিয়ে রইলেন প্রৌঢ়া— ফেলে আসা সময় অথবা চলে যাওয়া লোকাল ট্রেনের দিকে।

পাশ থেকে প্রৌঢ় স্বামী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আগে কখনও দেখিনি, কে বলো তো?’ কয়েক কদম মন্থর পায়চারি করে, আরও মন্থর স্বরে প্রৌঢ়া সেই বৃদ্ধের পরিচয় দিলেন— ‘আমাদের পাড়ার ছেলে।’

কে জানে প্রৌঢ়ার নাম বালুচরি না নন্দা, এবং বৃদ্ধটি ডানপিটে বিল্টু কি না? পাড়ার ছেলের যে বয়স বাড়ে না!

এখন বদলে গেছে সময়। তাই দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে থাকা পাড়ায় সহসা রাতের কড়া নাড়ার চল নেই। বদলে মধ্যরাতে লগ ইন।

তবুও গ্লোবাল সেই পাড়ায় কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বলে ফেলে ‘মাসিমা, পিৎজা খামু।’

subratasundar@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy