Advertisement
E-Paper

আমার প্রথম ছবি

তখন দার্জিলিঙে, বছর ছয়েক বয়স। স্কুলের থিয়েটারে প্রথম অভিনয় করলাম। পিটার প্যান। তখনই স্বপ্ন দেখেছিলাম, বড় হয়ে অভিনয় করব। বয়স যখন পনেরো, একটা ছবি দেখলাম, ‘জায়ান্ট’। সেখানে জেমস ডিন-এর অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ। ভাবলাম, অভিনেতা হবই হব। তার পর, তেইশ বছর বয়সে এই শহরে আমি সার্ত্রের একটা নাটক পরিচালনা করছি, বাংলায়। নাটক নামাতে পয়সা লাগে, তাই গেছি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর ডিরেক্টরের কাছে। সেখানেই মৃণাল সেনকে প্রথম দেখি।

অঞ্জন দত্ত

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

তখন দার্জিলিঙে, বছর ছয়েক বয়স। স্কুলের থিয়েটারে প্রথম অভিনয় করলাম। পিটার প্যান। তখনই স্বপ্ন দেখেছিলাম, বড় হয়ে অভিনয় করব। বয়স যখন পনেরো, একটা ছবি দেখলাম, ‘জায়ান্ট’। সেখানে জেমস ডিন-এর অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ। ভাবলাম, অভিনেতা হবই হব। তার পর, তেইশ বছর বয়সে এই শহরে আমি সার্ত্রের একটা নাটক পরিচালনা করছি, বাংলায়। নাটক নামাতে পয়সা লাগে, তাই গেছি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর ডিরেক্টরের কাছে। সেখানেই মৃণাল সেনকে প্রথম দেখি। ওঁর কোনও ছবি কান-এ যাবে, তার ফ্রেঞ্চ সাবটাইট্ল-এর কাজে এসেছিলেন। লম্বা, রোগা একটা লোক, চেন স্মোকার। এক কোনায় বসে হাঁ করে দেখছি। এক বার মনে হল বলি, আমি অভিনয় করব আপনার ছবিতে। কিন্তু বলা হল না।

পরের বছর, ১৯৮০। খবর এল, মৃণাল সেন আমাকে খুঁজছেন। সেই যে রোগা ছেলেটা আলিয়ঁস ফ্রসেঁজ-এ বসে ছিল, তাকে ওঁর চাই। ম্যাক্সমুলার ভবনে আমার নাটকের রিহার্সালে চলে এলেন এক দিন। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, সিনেমা করবে? আমি কী বলি, হাঁদার মতো তাকিয়ে থাকলাম। তার পর বললাম, করব।

ওঁর বাড়ি গেলাম। তখন আমার লম্বা লম্বা চুল, উনি কেটে দিলেন। তেল মাখিয়ে দিলেন চুলে। জিন্স-বুট খুলে আমাকে পরতে হল পাঞ্জাবি আর গেঞ্জি। উনি গীতা সেনকে বললেন, ‘দ্যাখো, এ তোমার ছেলে হবে। চলবে?’ আমাকে বললেন, দেখো বাবা, বাংলা বলতে হবে কিন্তু ভাল করে। বললাম, আমি তো বাংলাতেই নাটক করি। উনি বললেন, এই যে কাঁধটাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তুমি কথা বলো, এ রকম কিন্তু বাঙালিরা করে না। তুমি একটা মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলের পার্ট করতে যাচ্ছ, ও রকম কাঁধ ঝাঁকাবে না।

৫০০০ টাকার কড়ারে শুরু হল আমার প্রথম সিনেমায় অভিনয়। ছবির নাম ‘চালচিত্র’। কিন্তু মৃণাল সেন আমাকে একটা দিনের জন্যও অভিনয় শেখাননি। বলেননি, এ রকম করো, ও রকম বলো। আমাকে জোর করে একটা সিচুয়েশনের মধ্যে ফেলে ‘অ্যাকশন’ বলে দিতেন। কে কে মহাজন-এর হাতে একটা অ্যারিফ্লেক্স টু সি ক্যামেরা, আর আমি রাস্তায় হাঁটছি, দৌড়চ্ছি, ট্রামে উঠে পড়ছি, নেমে যাচ্ছি, সেটে ডায়লগ বলছি। যা পারছি করছি। ভাল লাগলে ডিরেক্টর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছেন, সিগারেট দিচ্ছেন, পিঠে চাপড় মারছেন। গীতা সেন খুব খেয়াল রাখতেন।

২৪/২৫ দিনে চালচিত্র-র শুটিং হয়ে গেল। একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার ছেলের চাকরি পাওয়ার গল্প। ছেলেটা চাকরি পাবে, টাকা পাবে, কিন্তু তার জন্য ওকে কাগজে এমন কিছু লিখতে হবে, যেটা ও নিজে বিশ্বাস করে না। বস-এর চরিত্রে ছিলেন উৎপল দত্ত। অভিনয় তো করছি, কিন্তু কী যে করছি, কেমন করছি, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ডিরেক্টরও কিছু বলছেন না। শুধু যে সিনটায় আমার চরিত্রটা ভাবছে চাকরিটা নেব কি নেব না, উনি আমাকে বললেন, দ্যাখো অঞ্জন, আমরা সবাই একশোয় একশো পেতে চাই। কিন্তু তুমি যখন একটা শট দিচ্ছ, মনে রাখতে হবে, সব কিছুরই কমবেশি পয়েন্ট আছে। ধরো, ১০০-র মধ্যে স্ক্রিপ্ট-এর ১০। তেমনই হয়তো ক্যামেরার ৩০, এডিটিংয়ের ৩০, মিউজিকও আছে। অ্যাক্টিংও এ রকম একটা এলিমেন্ট। কোনও শটে হয়তো অ্যাক্টিং ১০, কোনও শটে ৯০-ও হতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই সিনে আমার অ্যাক্টিং কত পয়েন্ট? উনি বললেন, এই সিনে সব অলরেডি ডান। তুমি কিছু করলেই সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আমিও তা-ই করলাম, মানে কিচ্ছু করলাম না। চুপ করে ফাঁকা তাকিয়ে ছিলাম শুধু।

১৯৮১-র ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চালচিত্র সিলেক্টেড হল। আমি ভেনিস যাব! জীবনে প্রথম বিদেশ যাওয়া, তায় ভেনিস। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোর একটা। মৃণাল সেন যাবেন এক সপ্তাহ পর। আমার সাত দিন থাকার পারমিশন। বায়না ধরলাম, আমি গোটা ফেস্টিভ্যাল থাকব, ছবি দেখব। আগের বছরই বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘আকালের সন্ধানে’ সিলভার বেয়ার পেয়েছে। ইউরোপ জুড়ে মৃণাল সেন তখন একটা নাম। বললেন, দেখছি। ওঁর কথায় আমাকে চোদ্দো দিনের হসপিটালিটি অফার করা হল। কিন্তু যেতে হবে নিজের পয়সায়। আমি একশো ডলার যোগাড় করলাম। একটা অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইন্সে টিকিটের ব্যবস্থা হল, বম্বে থেকে রোম অবধি। ফ্লাইটে ফ্রি-তে ড্রিংক করে, নেশাগ্রস্ত হয়ে নামলাম রোমে। সেখানে পড়লাম ভয়ংকর সিকিয়োরিটি চেক-এ। কী একটা টাং করে আওয়াজ হচ্ছে শুধু। ওরা জামাপ্যান্ট, বেল্ট-বুট খুলিয়ে, আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে চেক করছে, কিছু পাচ্ছে না। আমার ভয় অন্য। মাজনের ভেতরে অল্প একটু চরস লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওটা যদি পেয়ে যায় তো আমি শেষ। যা হোক, শব্দরহস্যের সমাধান হল না। আমিও এক ফাঁকে টুক করে বাথরুমে চরসটা ফেলে দিলাম। এত ভয় পেয়েছিলাম, নেশাটাই ছেড়ে দিলাম।

রোম থেকে ভেনিস। সিকিয়োরিটির গেরোয় খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। মৃণাল সেন বলেছিলেন এয়ারপোর্টে কেউ একটা প্ল্যাকার্ড হাতে থাকবে। কেউ নেই। কোথায় যাব, জানি না। একটা লোক দেখি কোডাক-এর নেগেটিভের ক্যান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম, নির্ঘাত ফেস্টিভ্যালের কেউ। গিয়ে বললাম, ‘মস্ত্রা?’ ইতালিয়ানে মস্ত্রা মানে ফেস্টিভ্যাল। সে বলল, এখানে দাঁড়াও, বাস আসবে। ভেনিসের বিখ্যাত ওয়াটার-বাস এল, চড়লাম। নেমে সার সার ট্যাক্সির একটায় উঠেছি, সে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আমার মাথায় শুধু ডলার আর লিরা-র কনভার্শন ঘুরপাক খাচ্ছে। ফেস্টিভ্যাল অফিসের সামনে নামিয়ে দিল (পরে জেনেছি স্ট্যান্ড থেকে জায়গাটা মোটে দশ মিনিটের রাস্তা, আমাকে মুরগি করেছে), যা চাইল দিয়ে দিলাম। এক একটা দেশের কাউন্টার, ‘ইন্ডিয়া’ আর পাই না। অনেক লাইন-টাইন পেরিয়ে খুঁজে পেলাম যখন, লাঞ্চ ব্রেক হয়ে গেল, রেজিস্ট্রেশন ক্লোজ্ড। মরিয়া আমি কাউন্টারের তলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি পাত্তা না দিয়েই। অনেক লোক, খাওয়াদাওয়া চলছে। একটা কেউ ইংরেজিতে কথা বলছে না। এক সাফাইকর্মীকে বললাম ‘ডিরেক্টর?’ সে একটা সিঁড়ি দেখিয়ে দিল। ওপরে উঠে সব দরজায় কান পাতছি, কোনও শব্দ নেই। একটা ঘর থেকে আওয়াজ শুনে হড়বড় করে ঢুকে পড়লাম। টাকমাথা একটা লোক বসে আছে, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা বলে উঠল, ‘আন্জান!’ তাকিয়ে দেখি, লোকটার পেছনে দেওয়ালে চালচিত্রর বিরাট একটা পোস্টার। পোস্টারে বড় করে আমার ছবি। আমি দেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম।

এই লোকটাই ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর। সে তো আমার কান্না দেখে হতভম্ব। বললাম, আমার খুব খারাপ অবস্থা। কাউকে চিনি না, থাকার জায়গা নেই, খিদেয় মরে যাচ্ছি। ও বলল, আমি তোমার হোটেলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, গিয়ে রেস্ট নাও। আমি তো কিছুতেই যাব না। একটা ভাল লোক পেয়েছি এত ক্ষণে, যদ্দিন না মৃণাল সেন আসছেন, একে ছাড়লে চলবে না। ও ড্রাইভার দিয়ে আমাকে ওর বাড়ি পাঠিয়ে দিল। গেলাম, ফ্রিজ থেকে খাবার, টেবিলে রাখা হুইস্কি খেয়ে কখন সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না।

পর দিন সকালে, হোটেল। জীবনের প্রথম ফাইভ স্টার হোটেল। সামনে বিশাল সি-বিচ। বিস্ময়ের পর বিস্ময়, হোটেলের লবিতে দেখি রবার্ট ডি নিরো আর রবার্ট ডুভাল দাঁড়িয়ে! ফেস্টিভ্যাল মাথায় উঠল। এখানে জন ট্রাভোল্টা, ওখানে সিডনি লুমেট! সাত দিন কেটে গেল, একটাও ছবি দেখিনি, সমানে স্টারদের দেখছি। রাতে বিচ-এ শুয়ে আছি, খাচ্ছিদাচ্ছি, যা প্রাণ চায় করছি। এই ক’দিনে প্রচুর বন্ধু হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে ঘুরছি। পুরো জোকার একটা। তার পর মৃণাল সেন এসে পৌঁছলেন। ‘শুনছি তুমি নাকি কোনও ছবি দেখছ না, শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছ?’ টানতে টানতে নিয়ে গেলেন সিনেমা দেখতে।

ভেনিসেই মৃণাল সেন, আমার ডিরেক্টর, হয়ে গেলেন মৃণালদা। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বড় হতে হতে আমি ছবি বলতে দেখেছি শুধু হলিউড। এখানে মৃণাল সেনের দৌলতে জিরি মেনজেল, নানি মোরেত্তি, ইয়ান্চো, এমির কস্তুরিকা... পৃথিবীর সিনেমার বিশাল দরজাটা খুলে গেল। ভেনিসে ওই ক’টা দিনে আমার চিন্তাভাবনা, রুচি— মৃণালদা বদলে দিলেন। ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনে পুরস্কার ঘোষণা হল। দেখি আমার জন্যও একটা পুরস্কার! প্রথম অভিনয়ের জন্য।

মৃণালদা থেকে গেলেন, ইউরোপে কোথাও কোনও একটা কাজ আছে। আমি কলকাতা ফিরলাম। মনে হল, যদি অভিনেতা হতেই হয়, তবে অনেক কিছু জানতে হবে, শিখতে হবে আমাকে। অনেক দায়িত্ব আমার। দমদম এয়ারপোর্টে যখন নামলাম, মনে হল, অনেক বড় হয়ে গেছি।

anjan dutta film
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy