Advertisement
E-Paper

একটাভয়[কষ্ট]লজ্জা

শীতের সময় পড়ন্ত রোদের রংটা ঠিক গলন্ত সোনার মতো থাকে না, কেমন মরে আসে যেন।

ঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:২০

শীতের সময় পড়ন্ত রোদের রংটা ঠিক গলন্ত সোনার মতো থাকে না, কেমন মরে আসে যেন। এই মরে-আসা আলোটার সঙ্গে আমার একটা লাভ-হেট সম্পর্ক আছে। এক এক সময় উপচে আসে বিরহ রস, শচীন দেববর্মনের গানের মতোই মধুর। আর এক এক বার সেই তীব্র বাদ পড়ে যাওয়ার জ্বলুনি মনে পড়ে যায়। যে জ্বলুনিতে হাজার বরফ ঘষেও আমি ঠাণ্ডা করতে পারিনি।
সেই বিকেলে আমিও পড়ে ছিলাম ব্যাডমিন্টন শাট্ল-এর মতো ছিঁড়েখুঁড়ে। জলে ভিজে, কিছু পালক-বিহীন। মাঠের চারপাশের লাইন ধরে অনেক বার হেঁটেছিলাম। যদি ওরা আমায় খেলতে নেয়। যদি ওরা আমায় এক বারও বলে, ঠিক আছে এ বার তোর চান্স। কিন্তু না, কখনও বলল না।
বাড়ির থেকে একটু দূরে একটা ছোট্ট মাঠে শীত জুড়ে আমরা শাট্লকক এ দিক ও দিক করতাম। ওরা ঠিক আমার পাড়ার বন্ধু ছিল না। কিন্তু আমি প্রায়ই মাঠ বরাবর যাতায়াত করতাম আর ওদের খেলতে দেখতাম বলে ওদের সঙ্গে নিজে নিজেই বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম। আমি তখনও একটা খোলা হাওয়ার মতো ছিলাম। কাটা ঘুড়ির মতো ঠোক্কর খেতে শিখিনি। এক দিন হল কী, আমি লাফাতে লাফাতে মাঠে পৌঁছতেই দেখি ওরা সবাই হাফ-সার্কল করে দাঁড়িয়ে আমার আসার জন্যই অপেক্ষা করছে।
— কী হয়েছে?
রুমুদিদি বলে এক জন পান্ডা গোছের ছিল। সে বলল, তুই কাল ইচ্ছে করে বেশি জোরে জোরে মেরে কক ভেঙে দিয়েছিস। কক কেনার পয়সা নিয়ে আয় বাড়ি থেকে। আমি তো হাঁ। যতই বলি, আমি তো একা খেলিনি, কাল সবাই খেলেছে, তা হলে তোমরা কী করে বলছ যে আমি একা ভেঙেছি? সবাই যেন রুমুদিদির ক্যাপ্টেন্সিতে আমার ওপর রইরই করে তেড়ে এল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই ভেঙেছিস। যা পয়সা নিয়ে আয়।
আমি ছোট্টটি, একা আর পারলাম না। চোখ দিয়ে গরম জল, গাল বেয়ে মিথ্যে দোষারোপ চুঁইয়ে পড়ল। যখন আমি র্যাকেট নিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাড়ি ফিরছি, রুমুদিদির গলা শুনতে পেলাম। কী রে কেমন দিলাম, বলেছিলাম না, ওকে ভাগিয়েই ছাড়ব? আমাদের গ্রুপে গায়ে পড়ে ঢুকতে এসেছে। ন্যাকা! ‘বন্ধু হবে নাকি?’ এ বার বন্ধুত্ব কর।
অথচ আমি তার পরের দিন, তার পরের দিন, তার পরের দিনও গিয়েছিলাম, র্যাকেট নিয়ে। মাঠের ধারে হেঁটেছিলাম, আনমনে কিন্তু আড়ে আড়ে দেখছিলাম, যদি এক বারও ডাকে। কিন্তু আমায় নেয়নি ওরা। বরং আমায় দেখে এ ওর কানে কী সব বলত, আর খুব হাসাহাসি করত। আমি ওদের কাছে ফেকলু পার্টি বনে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম, মাকে বললেই একটা নতুন শাট্লকক কেনার পয়সা দেবে। কিন্তু যে ভুল করিনি, তার জন্য পয়সা কী করে চাইব?
তবু রোজ যাওয়া চাই আমার। কী যে ছাতা রূপকথার গল্পের মতো বিশ্বাস ছিল, এক দিন না ঠিক ওরা আমায় বুঝবে, আমায় ডাকবে। কিন্তু ওরা ডাকেনি। আমি ওই রোদটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খুব নালিশ করতাম। নিজে নিজেই বকমবকম। রোজ বাড়ি ফেরার সময় গলা বুজে আসত। রোজ মা জয়েন্ট ফ্যামিলির হাজার কাজের ঝামেলার মধ্যেও জিজ্ঞেস করত, ‘আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?’ আমি মুখ নামিয়ে বলতাম, ধুর, এত তাড়াতাড়ি আলো পড়ে আসে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy