Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

পুরনো উত্তর কলকাতার বাড়ির সরু সিঁড়ি বেয়ে সবে একটা চওড়া রকে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই লাল রকের ঐতিহ্য, আর চুপেচুপে জমে থাকা ইতিহাস নিয়ে আমরা তখন সে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে আহাবাহা করায় ব্যস্ত। শীত সে বছর বেশ জাঁকিয়ে পড়েছিল। বেশ কাঁপছে তখন সোয়েটার থেকে বেরিয়ে পড়া হাতের চেটো দুটো।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পুরনো উত্তর কলকাতার বাড়ির সরু সিঁড়ি বেয়ে সবে একটা চওড়া রকে এসে দাঁড়িয়েছি। সেই লাল রকের ঐতিহ্য, আর চুপেচুপে জমে থাকা ইতিহাস নিয়ে আমরা তখন সে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে আহাবাহা করায় ব্যস্ত। শীত সে বছর বেশ জাঁকিয়ে পড়েছিল। বেশ কাঁপছে তখন সোয়েটার থেকে বেরিয়ে পড়া হাতের চেটো দুটো।

কোনাকুনি যে রক-ওয়ালা বাড়ি, সেখান থেকে একটা মৃদু উত্তেজনার আভাস পেলাম। শীতের রাত হিসেবে সাড়ে দশটা মন্দ রাত নয়। এখন কে গোল বাধাল? বেশি উঁঁকিঝুঁকি মারতেও পারছি না। অন্যের বাড়িতে অতিথি হয়ে সবে উদরপূর্তি ও স্ফূর্তি করেছি, ফলে তাদের রকে প্রায়শই কংগ্রেস অধিবেশন বসত সে সময়— এটা না শুনে অন্য রকের কনসার্ট-এ মন দিতে পারছি না।

গুনগুন উত্তেজনা বাড়ছে। এ বার একটু মুখ বাড়িয়েই দেখলাম। একটু অবাক, এক জন আধা বয়স্ক মহিলা মাঙ্কিটুপি, সোয়েটার পরে জগে করে প্রচুর প্রচুর জল ঢালছেন তাঁদের নিজস্ব রকে। আর বেশ গাল পাড়ছেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোকজনকে। ‘কেন রে? এটা কি তোদের বাপের জায়গা? রোজ একটু রাত হতে না হতেই বউ-বাচ্চা বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চলে আসিস? সকালে দুধ আনতে যাওয়ার সময় কত অসুবিধে হয় জানিস?’ সামনের ভিড়ের মধ্যে যে লোকটি মাঝবয়সেই প্রৌঢ়, তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে, জানি তো অসুবিধে হয়, তা বউবাচ্চা নিয়ে কোথায় যাই বলেন? শীতের রাত, কচিটার মাত্র চার মাস। বুকে সর্দি লেগে গেছে।’

এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারখানা বুঝতে চেষ্টা করলাম। ছোট ভিড়ের লোকসংখ্যা জনা আটেক। তার মধ্যে গোটা পাঁচ জনের একটা পরিবার। কারও বগলে ছেঁড়া মাদুর আর ছেঁড়া চাদর, কেউ একটা মলিন ক্ষয়ে যাওয়া তোশক নিয়ে থামে হেলান দিয়েছে, মশারি নিয়ে বছর আটেক বড় বড় গোল গোল চোখ করে ফয়সালার জন্য অপেক্ষা করছে, আর চার মাসের মা কোনও মতে নিজের শাড়ি জড়িয়ে পুঁচকিকে সম্ভাব্য নিউমোনিয়া থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বাকিরা বোধ হয় দর্শক।

এই পরিবারের গর্হিত কাজটার ব্যাপারে বোঝা গেল মহিলার তড়পানি থেকে। তিনি বললেন, ‘দাঁড়া, তোরা আজ কী করে শুতে পারিস এখানে আমি দেখছি।’ বলে ফের জল ঢালতে শুরু করলেন। মাঝবয়সি লোকটি কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, ‘এখানটা একটু ঢাকা মতো, শীত একটু কম লাগে, এত জল ঢালবেন না গিন্নিমা। শুকোবে না। আর মুছে নিলেও বড্ড ঠান্ডা উঠবে। কাল থেকে আপনারা ওঠার আগেই আমরা চলে যাব। অন্তত আজ রাতটা শুতে দিন। জাড়ে গা বাজছে।’

রোজ রাতে এই পরিবারটা আশ্রয় নেয় এই রকে। বড্ড শীত, তাই খোলা আকাশের নীচ ছেড়ে একটু ঢাকা জায়গায় শুতে চায়। কিন্তু ওই বাড়ির লোকেদের পছন্দ নয় রাস্তার কতকগুলো লোক এসে ওদের রকটা নোংরা করুক, ওদের রকের বদনাম করুক। হয়তো এই রকেরও মহান ইতিহাস আছে। হয়তো এখানে বসে কালিদাস মেঘদূত ভেবে পেয়েছিলেন। সেই ঐতিহ্যে কালি লাগবে। যখন কিছুতেই ব্যাটাদের শায়েস্তা করা গেল না, অপমান করে তাড়িয়ে দিলেও ফের চলে আসে রাতের দিকে, তখন এই ফন্দিটি করলেন ও-বাড়ির পিসিমা। রাত সাড়ে দশটায় বালতি বালতি জল ঢেলে রকটাকে তিনি অকলুষিত রাখলেন ফ্রম রাস্তার নামগোত্রহীন লোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariya anandabazar sanchari mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE