Advertisement
E-Paper

টুকরো টুকরো মানুষ

কমান্ডার সাহেবের হুকুম ছিল, হাতের ছুরিটা দিয়ে গলার নলিটা খ্যাচাং করে উড়িয়ে দে— তা হলেই গ্যালগেলিয়ে রক্ত বেরিয়ে বাকি শরীরটা ছটফটিয়ে মরে যাবে। নোংরা খ্রিস্টান আর্মেনীয়গুলোর জন্য সরকারি বুলেট খরচ করার কোনও মানেই হয় না! জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা কয়েদির দল ঠিকঠাকই মিলিটারির হুকুম তামিল করছিল। হাঁটু গেড়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকা নাজারেথের ডাইনে-বাঁয়ে একটার পর একটা রক্তাক্ত লাশ গড়িয়ে পড়ছে।

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৫ ০০:০৩

কমান্ডার সাহেবের হুকুম ছিল, হাতের ছুরিটা দিয়ে গলার নলিটা খ্যাচাং করে উড়িয়ে দে— তা হলেই গ্যালগেলিয়ে রক্ত বেরিয়ে বাকি শরীরটা ছটফটিয়ে মরে যাবে। নোংরা খ্রিস্টান আর্মেনীয়গুলোর জন্য সরকারি বুলেট খরচ করার কোনও মানেই হয় না! জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা কয়েদির দল ঠিকঠাকই মিলিটারির হুকুম তামিল করছিল। হাঁটু গেড়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকা নাজারেথের ডাইনে-বাঁয়ে একটার পর একটা রক্তাক্ত লাশ গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার কোতলের ভার যার ওপর, সে ছুরিটা গলায় ঠেকিয়েও কিছুতেই শেষ টানটা দিতে পারছে না। এ দিকে তুর্কি সেনারা তো তদারক করছে। তাই ছুরি বসিয়ে একটু চাপ দিতেই হয়। তাতে নাজারেথের প্রাণটা বাঁচল, কিন্তু গলার আওয়াজটা চলে গেল। মাথা গোঁজার ঘর নেই, বউ আর যমজ দুই মেয়ের কোনও খোঁজ নেই, জলের পাত্তরে এক ফোঁটা জল নেই, পেটে এক কণা খাবার নেই। তার পরেও বোবা লোকটা মরুভূমি, পাহাড়, নদী, সাগর পেরিয়ে পৃথিবীর এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো তার হারানো মেয়েদের খোঁজে।

ঘটনাটা ঘটছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯১৫-১৬’র তুরস্কে। অটোমান সাম্রাজ্যের পড়ন্ত বেলায় তুরস্ক জার্মানির হয়ে লড়ছে। ও দিকে তখনও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকা জারের রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে তাদের আর্মেনীয় বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। আর তারই শোধ তুলতে তুর্কি-বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নিজের দেশের নিরীহ সংখ্যালঘু আর্মেনীয় বাসিন্দাদের ওপর। কয়েক লক্ষ মানুষ খুন হয়ে যায়। শ্রম-শিবিরে চালান হয়ে, দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে, খেতে না পেয়ে, মরুভূমির তেষ্টায় ছটফট করে মারা যায় আরও কয়েক লক্ষ। হিটলারের ইহুদি নিধনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া এই আর্মেনীয় গণহত্যার দায় তুরস্ক এখনও স্বীকার করে না। এখনও সে দেশের রাজনীতিতে এটা সেই দগদগে গোপন ঘা, নানা অজুহাতের পুলটিসে যাকে ঢেকে রাখতে হয়, আর সেই ‘বিতর্কিত’ গণহত্যাই এ ছবির পটভূমি। জার্মানি-প্রবাসী তুর্কি পরিচালক অবশ্য বার বার বলেছেন, ‘গণহত্যা’ তাঁর ছবির বিষয় নয়। তিনি একটা মানুষ আর তার পরিবারের গল্প বলতে চেয়েছেন।

কিন্তু সেই মানুষটা তো নাজারেথ! সে শ্রম-শিবিরে তার সঙ্গীদের পোকামাকড়ের মতো মরতে দেখেছে! এক শরণার্থী শিবিরে খুঁজে পাওয়া তার স্ত্রী, তারই দু’বাহুর বন্ধনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই বার বার বলেছে, আমার এই যন্ত্রণা শেষ করে দাও না গো! শেষ অবধি নাজারেথের আলিঙ্গনই মৃত্যুর বন্ধন হয়ে মেয়েটিকে মুক্তি দেয়! এই নাজারেথের জীবনের গল্প থেকে ওই কান্না-রক্তের ইতিহাসকে কি কখনও বাদ দেওয়া যায়? মরুভূমিতে বুকফাটা তেষ্টা নিয়ে জল ভরতে গিয়ে কুয়োর ভেতর ধর্ষিতা নারীদের নগ্ন লাশ দেখে নাজারেথ যে ভাবে ছিটকে সরে আসে, সে ভাবেই দর্শককে চমকে দিয়ে সারা ক্ষণ গুমরে ওঠে সেই হননকাল।

পরিচালক এখানে গায়ে পড়ে ইতিহাসের জ্ঞান দেন না। শুধু ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্সের বার বার ব্যবহারে বুঝিয়ে দেন ঘটনার ব্যাপকতা। এথনিক ক্লেনজিং, মানে তুর্কিদের হাতে আর্মেনীয়দের নিকেশ হওয়ার ইতিহাস তাঁর পটভূমি। তবু তুর্কি সাবানওয়ালা ওমর নাসিরুদ্দিনও ছবিতে আছেন, ওই ভয়ংকর হিংসার দিনগুলোয় নাজারেথ-সুদ্ধ অনেক আর্মেনীয়কেই বুড়ো ওমর তাঁর সাবান কারখানায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। আসলে হিংসা আর ভালবাসার কোনও জাত হয় না, সীমান্তও নয়। তাই ১৯২২-এ এক
তাঁবু-সিনেমায় নাজারেথ ‘দ্য কিড’ দেখে। চার্লির ম্যাজিকে তার ভেতরটা যখন তোলপাড়, তখনই সে তার মেয়েদের খবর পায়। সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে আমেরিকায় এসে সে একটি মেয়েকে খুঁজে পায়। যুদ্ধ এই মেয়েটির অঙ্গহানি ঘটিয়েছে। অন্য বোনটি মৃত। ছবির শেষে বোবা বাপ তার খঞ্জ মেয়েটির হাত ধরে। ভিনদেশি শহরের বরফ-ঢাকা রাস্তায় অন্য এক জীবনের দিকে হেঁটে যায়— গণহত্যার স্মৃতি শরীরে নিয়ে— গণহত্যার স্মৃতি ভুলতে।

sanajkol@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy