যে দেশে দুর্যোধন থেকে রাবণ সকলে মহাসমারোহে পূজিত হন, সেখানে নাথুরাম গডসের মন্দির নিয়ে হইচই কীসের? গাঁধীহত্যার তিথিতে, মেরঠ-এ, আগামী ৩০ জানুয়ারি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা নাথুরাম গডসের মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে বলে যে ঘোষণা করেছে, ভারতের অনেকেই তাতে যতই প্রেশার কুকারের মতো চিড়বিড়িয়ে ফুটুন, ব্যাপারটা চমৎকার। শাহরুখ খানের সিনেমা ছাড়া, অবিমিশ্র ভিলেন বলে কিছু হয় নাকি? আপনার কাছে যে টেররিস্ট, আমার কাছে সে বিপ্লবী শহিদ। আপনার কাছে যে গড, আমার কাছে সে গডসে! তাই স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন কাজকম্মের দেশে এই উদ্যোগকে হাততালি জানাই। মন্দিরটা কী করে আরও দুর্দান্ত চমকপ্রদ হতে পারে, সে বিষয়ে কয়েকটা সাজেশন রইল।
মন্দিরের ডিটেল, কোন স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠবে তার শিখর, গোপুরম এবং গর্ভগৃহ, কিছুই জানা যায়নি। হিন্দু মহাসভার সভাপতি শুধু জানিয়েছেন, মন্দিরে নাথুরাম গডসের সঙ্গে থাকবেন অখণ্ড ভারতমাতা। দারুণ চিন্তা! আমাদের মনে হয়, বিষ্ণুমন্দিরের প্রবেশদ্বারে যেমন গরুড় কিংবা শিবমন্দিরে যেমন নন্দীমূর্তি থাকে, গডসে ও অখণ্ড ভারতমাতার এই মন্দিরের দরজায় সেই ভাবে ভক্তিভরে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মূর্তি স্থাপন করা উচিত।
৩০ জানুয়ারির সন্ধ্যায় গাঁধী তখন নিষ্প্রাণ, গডসেকে আটকে রাখা হয়েছে একটি ঘরে। খবর পেয়ে নেহরু ও পটেল পৌঁছে গিয়েছেন, একটু বাদে পৌঁছলেন ভারতের শেষ ভাইসরয়। বিড়লা হাউসের আশপাশের রাস্তায় তখন দ্রুত গতিতে গুজব ছড়াচ্ছে, ‘কোই মিঞা বাপুকো মার দিয়া।’ মাউন্টব্যাটেন শুনতে পেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘কে বলেছে, মুসলমান মেরেছে? আপনারা জানেন না, এটা এক হিন্দুর কীর্তি!’ তারও মিনিট দশেক পর মহারাষ্ট্র কংগ্রেসের নেতা ভি এন গ্যাডগিল গিয়ে আততায়ীকে শনাক্ত করবেন। মাউন্টব্যাটেন পরে বলেছিলেন, ওই দশ মিনিটই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় টেনশন ছিল। আততায়ী মুসলমান হলে ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যেত, দেশভাগের পরই আর একটা দাঙ্গা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি থাকত না। মাউন্টব্যাটেন ঠিক আঁচ করেছিলেন, নাথুরাম গডসে হিন্দু বলেই ভারতমাতা প্রাণে বেঁচে গেলেন। মন্দিরে ওই খ্রিস্টান গন্ধর্বের মূর্তি না থাকলে তাই ভারতমাতার পুজোয় মহাপাপ ঘটবে! দুশো তুলসীগাছ লাগিয়েও শোধন করা যাবে না!
হিন্দুদের সাবেক রীতিতে, প্রবেশদ্বার থেকে অলিন্দ পেরিয়ে মূল দেবতার গর্ভগৃহে ঢুকতে হয়। অলিন্দে গণপতি, বীরবাহু, জয়-বিজয় ধাঁচে থাকা উচিত কিছু মূর্তি। কারও নাম মদনলাল পাহাওয়া, কারও বা গোপাল গডসে, কারও বা নাম বিষ্ণু কারকারে কিংবা দিগম্বর ব্যাজ। মদনলাল পাহাওয়া ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি গাঁধীকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন। গোপাল গডসে নাথুরামের ভাই, তিনিও ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। বিষ্ণু কারকারে আহমদনগরে ‘ডেকান গেস্ট হাউস’ নামে অতিথিশালা চালাতেন। মদনলাল থেকে নাথুরাম, গোপাল সব অবতারেরা সেখানেই আশ্রয় নিতেন। দিগম্বর ব্যাজ নামের ষড়যন্ত্রীটি অবশ্য বিচারের সময় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। সকলেই বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ঘনিষ্ঠ শিষ্য, হিন্দু মহাসভার সদস্য। বিড়লা হাউসের ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে এঁরাই গডসে-রূপী ঈশ্বরের লীলা-সহচর ছিলেন।
অলিন্দ পেরোতে পেরোতে চোখ যাবে গর্ভগৃহের উপরে বিরাজমান শিখরের দিকে। হিন্দুর মন্দির-স্থাপত্যে শিখর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দূর থেকে ওটি দেখেই মন্দির চেনা যায়। বেশির ভাগ মন্দিরের শিখরে কলস থাকে। এখানে কলসের পরিবর্তে ৯ মিমি ব্যারেটা অটোমেটিক পিস্তল, সিরিয়াল নম্বর ৬০৬৮২৪-এর একটি মডেল থাকা উচিত। নাথুরাম ওই অস্ত্রেই গাঁধীবধ করেছিলেন। পিস্তলটি ১৯৩৪ সালে ইতালিতে তৈরি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মুসোলিনির এক অফিসার সেটি নিয়ে আবিসিনিয়ার যুদ্ধে যান। আবিসিনিয়ায় মুসোলিনির বাহিনী ব্রিটিশ সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পিস্তলটি ফোর্থ গ্বালিয়র ইনফ্যান্ট্রির কম্যান্ডিং অফিসার ভি ভি জোশীর দখলে আসে। সেখান থেকে কয়েক হাত ঘুরে, ২৮ জানুয়ারি পৌঁছয় নাথুরামের হাতে। শিখরই বোঝাবে, যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, (মুসোলিনির ব্যাপারটা মনে রাখলে, ফ্যাসিবাদ) এবং অস্ত্রের চোরাচালান পুরাকাল থেকেই অঙ্গাঙ্গী, নতুন কোনও ঘটনা নয়। ৯/১১ পরবর্তী দুনিয়ায় ওই মন্দিরশিখরই হবে পর্যটনের নতুন আকর্ষণ।
গর্ভগৃহের বেদিতে থাকবে নাথুরাম গডসে ও নারায়ণ আপ্টে-র মূর্তি। গাঁধীহত্যার দায়ে ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর আম্বালা জেলে দুজনেই ফাঁসি গিয়েছিলেন। নাথুরামের নাকে অবশ্যই একটি নথ থাকবে। পোস্ট অফিসের সামান্য কর্মী বিনায়ক গডসে ও তাঁর স্ত্রীর প্রথম তিনটি পুত্রসন্তান জন্মের পরই মারা গিয়েছিল। জ্যোতিষীর পরামর্শে পরবর্তী সন্তান রামচন্দ্রের বাঁ নাক ফুটো করে একটি নথ পরিয়ে, তাঁকে মেয়েদের মতো বড় করা হতে থাকে। ওই নথ থেকেই পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়দের কাছে রামচন্দ্র হয়ে ওঠে ‘নাথু’রাম। মেয়েদের মতো নথ, সাজপোশাক বলে অন্য বন্ধুরা শৈশবেই তাকে ঠাট্টা, বিদ্রুপে ভরিয়ে দিত। হিন্দু মহাসভা চমৎকার পরিকল্পনা নিয়েছে। মন্দির তৈরির পর ওই ধরনের ছেলেদের আর ‘মগা’, ‘লেডিজ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যাবে না। দেবতা কুপিত হবেন।
নারায়ণ আপ্টের মূর্তিটি কিন্তু অন্য রকম। শৈশব-অভিজ্ঞতার কারণে নাথুরাম গডসে ছিলেন নারীবিদ্বেষী, ম্যাট্রিকও পাশ করেননি। নারায়ণ আপ্টে কিন্তু বিজ্ঞানের স্নাতক, বর্ণময় প্রেমিক। আহমদনগর মিশনারি হাই স্কুলে শিক্ষক থাকতে থাকতে খ্রিস্টান ছাত্রী মনোরমা সেলভি-র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই বিবাহিত ভদ্রলোক। সাভারকরের নির্দেশে পরে তিনি পুণেতে হিন্দু মহাসভার কাজে, আর মনোরমা মুম্বইয়ের উইলসন কলেজে। তখনকার দিনে বাইক নিয়ে নারায়ণ পুণে থেকে মুম্বই যেতেন, হোস্টেল থেকে প্রেমিকাকে উঠিয়ে, স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন হোটেলে চেক ইন করতেন। মনোরমাকে এক বার গর্ভপাত করাতেও হয়েছিল। গডসে-মন্দিরের চিন্তাটি তাই চমৎকার! মন্দিরে নারায়ণ আপ্টের মূর্তি থাকবে বলেই শিবসেনা, বজরং দলরা ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে আর হুমকি দেবে না। মেয়েদের পোশাক, বিবাহ-বর্হিভূত সহবাস ইত্যাদি নিয়ে ফতোয়া জারির অসভ্যতা করবে না। বরং দেবতাকে অনুসরণ করতেও বলতে পারে!
দুই দেবতার দুই চরিত্র। এটিই ঐতিহ্য!
শিব সংহার করেন, বিষ্ণু পালন করেন।
পুজোর উপকরণও আলাদা। কারও তুলসীপাতা, কারও বা বেলপাতা। প্রস্তাবিত গডসে-মন্দিরও সে রকম! নাথুরাম কফি খেতে ভালবাসতেন, তাঁর পুজোর উপচার হবে কফি। নারায়ণ আপ্টে আবার সিগারেট, হুইস্কি পছন্দ করতেন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সামনে রাখা হোক কারণবারি। ব্র্যান্ডটা নাহয় হিঁদুবাদীরা বিদগ্ধ সভা-টভা ডেকে ঠিক করুন।
‘খুনির মন্দির’, ‘হিন্দুত্ববাদীদের ন্যক্কারজনক চক্রান্ত’ ইত্যাদি চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। বরং নিজেকে মূর্খই প্রমাণ করা হবে। আসলে, ‘মন্দিরে দেবদেবীর মূর্তিই থাকবে’ গোছের চিন্তাভাবনা অনেক পরের। মন্দির কথার অর্থ: ঘর। সংস্কৃত ভাষায় বেডরুমের আর এক নাম তাই শয়নমন্দির। ঘরের মধ্যে কে নাচানাচি করছে, কে ইন্টুমিন্টু করছে, আর কে নাথুরাম গডসের মূর্তি বসাচ্ছে, পুরোপুরি তার ব্যাপার।
তবে, সে সব তর্কের আগে, শ্রীমদ্ভাগবত থেকে একটা গল্প জেনে নেওয়া যাক। বৈকুণ্ঠে নারায়ণের দুই প্রহরী: জয় আর বিজয়। ঋষিদের অভিশাপে এঁদের দু’জনকে মর্তে জন্মাতে হয়। মর্তে জন্মানোর আগে দু’জন প্রচুর কান্নাকাটি করলে নারায়ণ তাঁদের একটি অপশন দেন। ঋষিদের শাপ কাটানো যাবে না। কিন্তু নারায়ণের ভক্ত হিসাবে মর্তে থাকলে সাত জন্ম কাটাতে হবে। শত্রু হলে মাত্র তিন জন্ম! জয় আর বিজয় শর্টকাট শত্রু-রাস্তা বেছে নেন। অতঃপর সত্যযুগে তাঁরা হিরণ্যাক্ষ-হিরণ্যকশিপু, ত্রেতাযুগে রাবণ-কুম্ভকর্ণ, আর দ্বাপরে কংস-শিশুপাল জুটি হিসাবে জন্মান। চারশো বছর আগে দিল্লির এক শাহজাদা এইসব শ্রীমদ্ভাগবত, যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ মন দিয়ে পড়েছিলেন বলেই তাঁর ‘সির ই আকবর’ বইয়ে লিখেছিলেন, যিনি তাঁর আরাধনা করেন আর যিনি শত্রুতা করেন, দুজনে একই গন্তব্যের দিকে ছুটে যান। তিনি আওরঙ্গজেবের বড়দা দারাশিকো। সাক্ষী মহারাজ, প্রবীণ তোগাড়িয়া, মোহন ভাগবতদের অযথা হিন্দুত্ববাদী বলার কারণ নেই। গাঁধীর দেশে তাঁদের প্রস্তাবিত গডসে-মন্দির শাহজাদা দারাশিকোর নীতিকেই কুর্নিশ জানাচ্ছে!
আরও একটা গল্প বলি? এটা বৃহদারণ্যক উপনিষদের। গল্পটা শোনার আগে মনে রাখতে হবে, এই দেশটা হল ভারত, এখানে পাশ্চাত্যের মতো সরল সমীকরণে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও শিংওয়ালা শয়তান নেই। মানুষ, দেবতা, দানব সকলেই ব্রহ্মার পৌত্র। গল্পটা হল, এক দিন, তিন নাতিই প্রজাপতির কাছে হাজির, ‘দাদু, উপদেশ দিন।’ প্রজাপতি ব্রহ্মা বললেন, ‘দ’। দেবতারা বললেন, ‘ও, বুঝেছি। আপনি বলছেন, দাম্যত। মানে, দমন করো।’ মানুষকেও দাদু সেই এক কথা বললেন, ‘দ’। তারা বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। দত্ত, মানে দান করো।’ আর অসুররা ‘দ’ শুনে বলল, ‘এ তো সহজ কথা। দয়ধ্বম, মানে দয়া করো।’ মর্মার্থ: দেবতাদের প্রচুর আছে, তাই তাঁদের দরকার আত্মদমন; মানুষ কৃপণ, তাই তাকে শিখতে হবে দান; নির্দয় অসুরকে শিখতে হবে দয়া। বৃহদারণ্যকই বুঝিয়ে দেয়, দেবতা-দানবের তফাত মোটেই চেহারার নয়। তফাত প্রবৃত্তির। একই শব্দে তাই বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম বোঝে। ‘গ’ বললে কেউ গাঁধী, কেউ গডসে স্লোগান দিতেই পারে। তখনই বোঝা যাবে, কে মানুষ আর কে অসুর!
শাঁখের করাত অন্যত্র। ১৯৪৪ সাল, কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গাঁধী তখন পুণের কাছে পঞ্চগনিতে। সেখানে গাঁধীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে ঢুকে পড়ে এক দল বিক্ষোভকারী। ২৩ জুলাই কাগজে খবর, স্বেচ্ছাসেবকরা নাথুরাম গডসে নামে এক জনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। ছুরি উঁচিয়ে গাঁধীকে মারতে যাচ্ছিলেন তিনি। গাঁধী তাঁকে ছেড়ে দিতে বলেন, বিক্ষোভকারীদের নেতা নারায়ণ আপ্টে-কে আলোচনায় বসার জন্য বাড়ির ভিতরে ডাকেন। আপ্টে ও গডসে দুজনেই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে যান।
গাঁধী সে দিন ছেড়ে না দিলে, চার বছর পর কতটা বীরত্ব দেখাতে পারতেন নাথুরাম? ভক্তেরা খেয়াল করেননি, প্রস্তাবিত মন্দিরের যশোগাথা শেষ অবধি মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর জয়। তিনি সে দিন আততায়ীকে ক্ষমা করতে পেরেছিলেন বলেই ভবিষ্যতে নাথুরামের কীর্তি এ ধরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।