বে শ খানিক ক্ষণ ধরেই ব্যাগটা নড়ছিল আর টুকাই আস্তে আস্তে ওর বাঁ হাতে চাপড় মারছিল ব্যাগে। ইচ্ছে করেই ও লাস্ট বেঞ্চে বসেছে। ওর পাশে আর কেউ নেই। শুধু স্কুলের বড় ব্যাগটা আড়াল করে একটা থলের ব্যাগ রাখা আছে।
এটা বাংলার ক্লাস। গগনবাবু এমনিতে ভাল হলেও পড়ানোর সময় খুব সিরিয়াস থাকেন। কারও নড়াচড়া টের পেলেও রেগে যান। তাই খাড়া হয়ে বসে ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করছিল ও।
টুকাই থাপ্পড় মারলেই ব্যাগের কাঁপুনিটা আসছিল। আর আস্তে করে নিঃশ্বাস ফেলছিল পেপসি। তিন-চার মিনিট পরে আবার ব্যাগে হাত দিয়ে চমকে উঠল ও। ব্যাগটা একদম চুপসে গিয়েছে। ফাঁস লাগানো দড়িটাও বেঞ্চের নীচে পড়ে আছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল পেপসির ল্যাজের শেষ অংশটা ক্লাসরুমের দরজার মধ্যে দিয়ে গলে চলে যাচ্ছে বাইরে। তার মানে পেপসি শুধু যে নিজেকে মুক্ত করেছে তা-ই নয়, এখন ও স্কুলময় চরতে বেরিয়েছে।
পেপসিকে এ বারের জন্মদিনে ওকে উপহার দিয়েছেন ছোটকাকা। লোম ঝুলঝুলে একটা মিষ্টি কুকুরছানা। স্থির হয়ে থাকলে খেলনা ডগি মনে হয়। কী কুক্ষণেই যে ওকে স্কুলে বেড়াতে নিয়ে আসার সাধ হয়েছিল টুকাইয়ের। এ বার ঠ্যালা সামলাও!
স্যর একটু টয়লেটে যাব? মরিয়া টুকাই আর্জি রাখে স্যরের কাছে। এখন? টয়লেট? পড়ানোয় বাধা পেয়ে গগনবাবুর ভ্রু কুঁচকে যায়।
হ্যাঁ স্যর। মাথা নিচু করে একটু চুলকে নেয় ও।
খুব জোর পেয়েছে?
হয়ে যাবে নাকি?
ও উত্তর দেওয়ার আগেই ক্লাস থেকে একটা সমবেত হাসির আওয়াজ ওঠে। হতেই পারে। ক্লাস সেভেনের কোনও ছেলে বাথরুমের বেগ সামলাতে না পারলে সবাই তো হাসবেই। ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় স্যরের মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে ও। বিরক্তি নিয়েই উনি বলেন, যাও।
শোনামাত্র ঝট করে বেরিয়ে পড়ে টুকাই। চার পাশে ক্লাসরুম, মাঝে উঠোন, পুরোটাই একদম ফাঁকা। পেপসি কোথাও নেই। গেল কোথায়? টুকাই হতাশ হয়ে তাকায় চার দিকে।
শুভ্র, তুমি এখানে কী করছ?
চট করে পেছন ফেরে ও। কণিষ্কস্যর প্রশ্নটা করেছেন ওকে। উনি আবার জেঠুর বন্ধু। তবু স্কুলে ওকে ভাল নামেই ডাকেন।
এই একটু টয়লেটে যাচ্ছিলাম। থতমত খেয়ে উত্তরটা দেয় ও।
টয়লেট তো এ দিকে নয়। বলতে বলতেই কণিষ্কস্যর এগিয়ে যান।
যাঃ বাবাঃ! নির্ঘাৎ জেঠুকে কথাটা বলবেন উনি। তবে সে নিয়ে ভাবার আর সময় পায় না টুকাই। চোখে
পড়ে উঠোনের শেষপ্রান্তে ঠিক হেডস্যরের ঘরের সামনের পাপোশে শুয়ে আছে পেপসি। নরম রোদ এসে পড়েছে ওর গায়ে। চেহারাটা একদম ঝকঝক করছে।
পা টিপে টিপে পেপসির দিকে এগোতে থাকে টুকাই। ওকে ধরতেই হবে। পরের মুহূর্তেই মনে হয় এখন ধরেই বা কী হবে? ক্লাসরুমে তো আর ঢোকানো যাবে না। তবে কোনও রকমে দোতলার ছাদে রেখে আসা যেতে পারে। ওই ছাদে কারও যাবার অনুমতি নেই। নাঃ! এক বার ধরতে পারলে ছাদেই রেখে শিকল দিতে হবে বাইরে থেকে।
সাতপাঁচ ভেবে এগোতে এগোতেই থমকে যায় ও। হেডস্যর আর করুণাদিদিমণি কথা বলতে বলতে এ দিকেই আসছেন। দেরি না করে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে টুকাই। একটু বাদে উঁকি মারতেই নজরে আসে সারা বারান্দায় কেউ নেই। মানে ওঁদের দু’জনের সঙ্গে পেপসিও অদৃশ্য হয়েছে। অগত্যা ক্লাসরুমেই ফিরে যায় মন খারাপ করে। আর বেশি দেরি করলে ওকেই নিলডাউন হতে হবে তো।
ক্লাসরুমে তখন লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শঙ্কর সেনাপতি’ গল্পটা পড়ানো হচ্ছিল। গল্পের ‘স্যর’ চরিত্রটি ছাত্র শঙ্করকে বলছিলেন— প্রকৃতি, জীবজন্তু চিনলে তবেই সঠিক জ্ঞান হয়, আর পৃথিবীকে চেনা যায়। টুকাই ভাবছিল, এ সব গল্পেই লেখা থাকে। না হলে পেপসিও তো ছোট্ট জীব একটা। কিন্তু স্যর যদি জানতে পারেন পেপসিকে ও ব্যাগে করে স্কুলে বেড়াতে নিয়ে এসেছে, নির্ঘাৎ পিটুনি দেবেন।
সারা দিন ভারী উৎকণ্ঠায় কাটল টুকাইয়ের। পেপসিকে ও মাঝেমাঝেই দেখেছে, কিন্তু ধরতে পারেনি এক বারও। সেকেন্ড পিরিয়ডে এক বার বেরিয়েছিল। পেপসি তখন রান্নাঘরের চাতালের কোণে চুপ করে বসেছিল। মিড-ডে-মিলে আজকের মেনু মাংস ভাত। তারই জোর তোড়জোড় চলছে। গন্ধে গন্ধেই নিশ্চয়ই ওখানে হাজির হয়েছে ও। টুকাইকে দেখে কাছে আসা দূরে থাক হস্টেলের সিঁড়ি বেয়ে টুকটুক করে দিব্যি ওপরে উঠে গেল। আবাসিক ছাড়া অন্য ছাত্রদের হস্টেলে যাওয়া বারণ। তা ছাড়া ক্লাসের সময় ও স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলে শাস্তি অবধারিত। তাই ক্লাসেই ফিরে গেল টুকাই।
টিফিনের সময় মিড-ডে-মিলের লাইনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে চার দিকে নজর ঘুরিয়েছে ও। কোথায় গেল পুঁচকে ছানাটা? কিন্তু তখনও দেখা দেয়নি। অনেক পরে দোতলায় ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে ওকে দেখতে পেল টুকাই। রান্নাঘরের পিছনের নর্দমার পাশে মাথা নিচু করে কী যেন খাচ্ছে পেপসি। অনেক কসরত করে ক্লাস মনিটরের অনুমতি নিয়ে ওখানে পৌঁছে দেখে ভোঁ ভাঁ! বাছাধন একদম ভ্যানিশ! ফিরে আসতে আসতে নিরুপায়ের মতো দেখল ও, হেলতে দুলতে দারোয়ান রামশরণজির ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন তিনি।
চারটেয় ছুটির ঘণ্টা বাজতেই ব্যাগ কাঁধে হুড়মুড় করে গেটের দিকে ছুটছিল ছেলেরা। শুধু চুপ করে নিজের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়েছিল টুকাই। পুরোটা দিন ধরে ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছে পেপসি। আর ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়িয়েছে সারা স্কুলে। এখনও টুকাই ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। পেপসিকে তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ওকে সঙ্গে না নিয়ে ও বাড়ি ফিরবে কেমন করে? দুশ্চিন্তায় চোখে জল আসছিল ওর। ঠিক সেই সময় নজরে এল একটা বাটি হাতে, সাবধানে, রামশরণ চলেছে হেডস্যরের ঘরের দিকে।
কী গো, রামশরণদা, কী নিয়ে যাচ্ছ? টুকাই কৌতূহলী হয়।
এই তো দুধ। গরম করে লিয়ে যাবার হুকুম হইছে।
কী হবে?
উসব হামি জানে না।
রামশরণের পিছুপিছু যায় টুকাই। পেপসির খবর যদি কিছু পাওয়া যায়। সারা স্কুলে চক্কর মারে তো এই লোকটাই। তা ছাড়া ওর ঘরেও তো ঢুকেছিল পেপসি।
স্কুল পুরো ফাঁকা। ছাত্র, স্যরেরা সব বাড়ি চলে গেছেন। শুধু হেডস্যরের ঘরের দরজা খোলা। সে দিকে না গিয়ে পেছনের জানলা দিয়ে উঁকি মারে ও। আর অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখে চমকে যায়! হেডস্যরের চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছে পেপসি। স্যর সামনে দাঁড়িয়ে। আর টেবিলে রাখা দুধের বাটি থেকে চামচে করে পেপসিকে দুধ খাওয়াচ্ছেন রাসভারী করুণাদিদিমণি। দু’জনের মুখেই আহ্লাদের বন্যা বইছে। এ বার হেডস্যরের দরজার দিকে বীরবিক্রমে এগিয়ে যায় টুকাই।
হেডস্যর বা করুণাদিদিমণি কাউকেই আর ভয় পেলে চলবে না ওর। টুকাইয়ের ভয় অন্য জায়গায়। পেপসির ঠিকানা বদল হয়ে যাবে না তো?