Advertisement
E-Paper

পাবলো পিকাসো

গোয়ের্নিকা, উত্তর স্পেনের শহরতলি। তখন স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলছে। জার্মান বাহিনী বোমা ফেলল ছোট্ট শহরটির ওপর। চার দিকে ধ্বংসের ছবি। আর ধ্বংসের সেই ভয়াবহ চেহারা নিয়ে নিজের স্টুডিয়োয় ছবি আঁকা শুরু করলেন এক জন শিল্পী।

যোগেন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৪ ০০:০০

গোয়ের্নিকা, উত্তর স্পেনের শহরতলি। তখন স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলছে। জার্মান বাহিনী বোমা ফেলল ছোট্ট শহরটির ওপর। চার দিকে ধ্বংসের ছবি। আর ধ্বংসের সেই ভয়াবহ চেহারা নিয়ে নিজের স্টুডিয়োয় ছবি আঁকা শুরু করলেন এক জন শিল্পী। শোনা যায়, ছবির কাজ চলার সময় আচমকাই স্টুডিয়োতে হানা দেয় জার্মানরা। ছবি দেখিয়ে তারা প্রশ্ন করে, ‘কে করেছে?’ উত্তরও ছিটকে আসে, ‘তোমরা।’

এই ছবিটি প্রদর্শিত হবে ১৯৩৭ সালে, প্যারিসে ‘ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’-এ। ‘গোয়ের্নিকা’। শিল্পী, পাবলো পিকাসো। ছবির বেশির ভাগ জুড়েই সাদা-কালো রঙের আধিক্য। চার দিকে ধ্বংসচিত্র, মানুষ চিত্‌কার করছে, এক মা আলো নিয়ে এগিয়ে আসছেন, কিউবিস্ট ধাঁচ দেখা যায় ছবি জুড়ে। এটা তৈরির আগে ছবির মধ্যের বিভিন্ন এক্সপ্রেশনগুলোকে নিয়ে প্রায় দুশোর মতো স্কেচ করেছিলেন পিকাসো। মাদ্রিদে যাওয়ার পর ‘গোয়ের্নিকা’ দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।

পিকাসো তো শুধু ছবি-আঁকিয়ে ছিলেন না, এক জন ভাস্কর হিসেবে, সেরামিক আর্টিস্ট এবং ম্যুরালিস্ট হিসেবেও আমরা তাঁকে চিনেছি। আর্টের বিভিন্ন ধরনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। অদ্ভুত ছিল তাঁর ড্রইংয়ের জোর। সঙ্গে নিখুঁত অবজার্ভেশন। পিকাসোর এই সহজাত ক্ষমতা আমায় ভীষণ টানে। পাঁচ-ছ’বছর থেকেই অসম্ভব ভাল ড্রইং করতেন। ওই বয়সের বাচ্চাদের মতো কাঁচা হাতের টান নয়, সাবলীল টানে আঁকা তাঁর পায়রাদের ছোট ছোট ছবিতে সেনসিটিভ গড়ন ও ভঙ্গি স্পষ্ট। পিকাসো নিজেও বলতেন, ছোটবেলায় তিনি ওল্ড মাস্টারদের মতো আঁকতেন। আর বড় হয়ে শিশুদের মতো। তাঁর ছবিতে ছিল শিশুদের সেই স্বাধীন, কোনও কিচ্ছু পরোয়া না-করা মনটা। অর্থাত্‌, রিয়ালিজ্মের মূল জায়গাটাকে তিনি ছোট্ট বয়সেই অর্জন করেন। তার পর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, নানা ভাবে ছবিকে ভাঙার কাজ।

রাত দশটা-এগারোটা থেকে আঁকা শুরু করতেন তিনি। চলত সারা রাত। একের পর এক অসাধারণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে জীবনের শেষ দিন অবধি শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন। দর্শক যখন ছবি দেখে, সে তো শুধু বিষয়বস্তু দেখে না। কাজের মধ্যে শিল্পীর যে এনার্জি রয়েছে, যে মন এবং নান্দনিক বোধ রয়েছে, তাকেও অনুভব করে। মানুষের মুখ, চেহারা, ল্যান্ডস্কেপ পিকাসোর যে কোনও ছবি আমরা যখনই দেখি, তাঁর সেই প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক এনার্জি উপলব্ধি করা যায়। এই এনার্জির সঙ্গে মিশেছিল নন্দনতত্ত্ব। নানা পর্যায় রয়েছে তাঁর কাজে। একেবারে গোড়ার দিকে বাস্তবধর্মী ছবি। পরের পর্যায়টি ‘ব্লু পিরিয়ড’। তখন তিনি চরম দারিদ্রের মধ্যে। রেস্তোরাঁয় খেতে আসা রুগ্ন, জীর্ণ চেহারার গরিব মানুষের ছবি আঁকতেন। এ ছবিগুলো ছিল মূলত নীল রঙে আঁকা। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হতে শুরু করেন। শিল্পমাধ্যমের ওপর তাঁর ক্ষমতা, প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে থাকে।

এর পরে ‘রোজ পিরিয়ড’। স্প্যানিশ সার্কাসের হার্লেকুইন, কলাকুশলী, ক্লাউন, রিঙের খেলা হয়ে ওঠে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু। এই পর্যায়ের ছবিতে দেখি রঙের প্রাচুর্য। পিকাসোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি প্রত্যেক পর্যায়ে তাঁর আগের পর্যায় থেকে সরে এসেছেন, এক-একটা পর্যায়কে ভেঙে আর একটা পর্যায়ে গিয়েছেন। যেটা অনেক বড় বড় শিল্পীর মধ্যেও আমরা পাই না। যেমন, ভ্যান গখ সারা জীবন ধরে প্রায় একই ধরনের সুন্দর সুন্দর এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি এঁকেছেন। কিন্তু পিকাসোর সৃষ্টিশীলতা ছিল বাঁধনহারা, সব সময়ই নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করতেন। যদিও উনি নিজে বলতেন, ‘আমি কিছু খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই।’

সেজাঁ-র হাত ধরে তত দিনে ইউরোপে কিউবিজ্মের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছে। পিকাসো তাঁর ছবিতে কিউবিজ্মের সঙ্গে নিজস্ব স্টাইল জুড়ে নিরীক্ষা শুরু করলেন। এক সময় আফ্রিকান মুখোশ দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত ছবি লে দ্যমোয়াজেল দা’ভিয়ঁ (Les Demoiselles d’Avignon) এ সময়ই আঁকা। অ্যাভিঁয়-র দেহোপজীবিনীরা এ ছবির বিষয়বস্তু। আফ্রিকান মাস্ক-এর প্রভাব ছবিতে স্পষ্ট। ছবিতে তাদের মুখচোখশরীর প্রচলিত দৃষ্টিতে এমন ‘বিকৃত’, ছবিটি দেখে অনেকেই বলতে শুরু করলেন, পিকাসো নষ্ট হয়ে গিয়েছেন। বহু বছর ধরে ছবিটি স্টুডিয়োতে পড়ে ছিল। মজার কথা হল, এটা পিকাসোর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবিগুলির একটি। সেই সময় ছবিতে এই ধরনের নান্দনিক শারীরিক বিকৃতি অন্য কেউ আনতে পারেননি। আসলে পিকাসো নিজে জানতেন, কখন সৃষ্টিশীলতার কোন ঝোঁক প্রয়োগ করলে ছবি অসামান্য হয়ে উঠবে।

পিকাসোর আর এক বিখ্যাত ছবি ‘উইপিং উওম্যান’। সেই সময় প্রেমিকা ডোরা মার-এর সঙ্গে পিকাসোর বিচ্ছেদ ঘটছে, তিনি অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ডোরা’র কান্নামাখা বিকৃত মুখের ছবি আঁকলেন তিনি। শুধু ইনিই নন, পিকাসোর জীবনে অনেক মহিলা এসেছেন। এবং প্রত্যেকেই তাঁর শিল্পকাজকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেন। তাঁদের সংস্পর্শে এসে প্রচুর ছবি তিনি এঁকেছিলেন। অদ্ভুত শিল্পকীর্তির জন্ম দিয়েছিলেন। মারি থেরেস-এর খেলোয়াড়সুলভ চেহারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাস্কর্য করেছিলেন। শেষ জীবনটা যাঁর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, সেই জ্যাকেলিন নিজেও ছিলেন পিকাসোর অনেক ছবির মডেল।

নিছক শিল্পীসত্তার জন্য নয়, পিকাসোর এই বর্ণময় চরিত্রটার কারণেই তিনি আমার এত পছন্দের। নাটক লিখতেন, সঙ্গে ছোট ছোট কবিতাও। সেরামিক পট-এর ওপর তাঁর সাবলীল ড্রইং অপূর্ব। ভাস্কর্যগুলোও মোটেই গতানুগতিক ছিল না। নানা ছুটকো জিনিস জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে তিনি ভাস্কর্য করেছেন। তাঁর তৈরি ব্রোঞ্জের গর্ভিণী ছাগল বিখ্যাত। সেটার পেটের মধ্যে একটা ঝুড়ি ঢুকিয়ে তিনি এটি তৈরি করেন। আবার, একটা সাইকেলের সিটে সাইকেলের হ্যান্ডলটা শিং-এর মতো ফিট করে এক লহমায় এনে দেন পশুর মাথার আদল।

আর এই সব কিছুর সঙ্গেই তাঁর গভীর আত্মিক যোগ ছিল। আদ্যন্ত এক শিল্পীর জীবন তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন। তাঁর প্রত্যেকটা ছবির মধ্যেই আসল মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ওয়ার্ল্ড আর্ট’-এ তিনি যে বৈপ্লবিক অবদান রেখে গিয়েছেন, তা অন্য কারও মধ্যেই দেখা যায় না। সেখানে তাঁর অবস্থান এতটাই তীব্র, মনে হয় না অন্য কোনও শিল্পী পাবলো পিকাসোকে শিল্পে তাঁর জায়গা থেকে সরাতে পেরেছেন।

ini-on-uni pablo picaso jogen choudhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy