Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: ভীম

প্রঃ / উঃ

ঢুকে দেখা গেল, ভদ্রলোক শর্টস আর স্নিকার্স পরে মুগুর ভাঁজছেন। অবিশ্বাস্য চেহারা, দেখলে আর্নল্ড শোয়ারজেনেগার-ও মুচ্ছো যাওয়ার হাই চান্স। তাঁর ট্রেনার একটু দূরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন। ইনস্ট্রাকশন বা বারণ শুনে ভদ্রলোক একটু রেগে গেলেই এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং সাইজের হাত হানবেন এ-গাল ও-গাল। ব্যাপার বুঝে আমরাও কাঁপতে লাগলাম।

ভীম, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায়, রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।

ভীম, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায়, রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।

কৃষ্ণেন্দু সান্যাল
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

[ঢুকে দেখা গেল, ভদ্রলোক শর্টস আর স্নিকার্স পরে মুগুর ভাঁজছেন। অবিশ্বাস্য চেহারা, দেখলে আর্নল্ড শোয়ারজেনেগার-ও মুচ্ছো যাওয়ার হাই চান্স। তাঁর ট্রেনার একটু দূরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন। ইনস্ট্রাকশন বা বারণ শুনে ভদ্রলোক একটু রেগে গেলেই এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং সাইজের হাত হানবেন এ-গাল ও-গাল। ব্যাপার বুঝে আমরাও কাঁপতে লাগলাম।]

ভীম: কী হল রে? শীত করছে? কয়েকটা ডন-বোঠকি দিয়ে দে না! ট্রেডমিল করবি? গুদামে একটা রাখা আছে। বক-রাক্ষসের মাংসের বড়া খাবি দুটো?

প্রতিবেদক: না না, থ্যাংক ইউ। বলছিলাম কী, আপনি যে শরীর-যত্নের একেবারে আদি পুরুষ, আর এখন প্রতি গলিতে তিরিশ লাখ জিম, কিন্তু কেউই আপনার নামও করে না ফোটোও টাঙায় না, সেই বঞ্চনা বিষয়ে কিছু...

ভীম: আরে ধুর, ও সব লোভ নিয়ে আমার কী হবে? যেখানে একটা গোটা মহাকাব্যের সবচেয়ে কালারফুল ক্যারেক্টার আমি? যুধিষ্ঠিরদা সারা ক্ষণ মিনমিন করে ন্যায় আর নীতি নিয়ে চুলচেরা ভ্যাজরভ্যাজর করছে। অর্জুনও ম্যাপের নানা প্রান্তে ক্যাসানোভা হতেই ব্যস্ত। কৃষ্ণ আজ একটা সভায় অমুক যুক্তি দিচ্ছে, কাল অন্য সভায় ফের উলটোটা বলে গলা ফাটাচ্ছে, ভাবছে কূটনীতির ভিয়েনে ইমেজ সাঁতলে জগৎ জয় করবে। আরে ভাই, লোকে ও সব চায় না। পাবলিক চায়, ভিলেনকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেওয়া হোক। সে কাজ করবে কে? এই শর্মা।

প্রতি: কিন্তু, আপনাকে তো সবচেয়ে কালারফুল বা ইম্পর্ট্যান্ট ধরা হয় না? বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, মহাভারতের নাটক যুধিষ্ঠির। অনেকেই কৃষ্ণকে সেই সম্মান দিয়েছেন। ক্লাস এইট-এর ছেলেপুলে কর্ণকে লেখে প্রিয় চরিত্র। আপনাকে বীর ধরা হয়, কিন্তু একটু কমিক ক্যারেক্টারও...

ভীম: তার কারণ হল, পণ্ডিতগুলো আর তাদের চ্যালারা এখনও এই কুসংস্কারের পাল্লায় চিৎপাত হয়ে আছে: শরীরটা বাইরের খোল, তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মগজটা ভেতরে ফ্যাৎফ্যাৎ করছে, তাই ওটা হেভি দামি। ‘বাহ্যিক’কে প্রায় ‘বাহ্যে’ ধরা হয়। কেন রে? এ দিকে, ডিমের সাদায় কিন্তু অধিক প্রোটিন, কুসুমটায় নয়। মেয়েদের বাইরের রূপ দেখেই নায়িকা করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা দিয়ে, মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখে নয়।

প্রতি: হ্যাঁ, তা করা হচ্ছে বটে, কিন্তু করা উচিত হচ্ছে কি? সেটাই আসল প্রশ্ন।

ভীম: উচিত কথাটাকে দুটো দিক থেকে দেখা যায়। এক হচ্ছে, তত্ত্বের উচিত। আর একটা হচ্ছে, বাস্তবের উচিত। তত্ত্বে এ কথাও প্রমাণ করা যায়, তুই যদি লাইটের চেয়ে বেশি স্পিডে সাঁইসাঁই করে চলতে পারিস, তুই তোর কিছু ক্ষণ আগের-আমিটাকে দেখতে পাবি। এ সব বলে প্রাইজ কুড়োনো যায়, কিন্তু এর আদৌ কোনও মানে আছে কি? বাস্তব বলবে, এ নিয়ে হল্লা অনর্থক, কারণ তুই কক্ষনও লাইটের চেয়ে বেশি স্পিডে ছুটতেই পারবি না। তেমনই, থিয়োরির দিক থেকে নিশ্চয়ই প্রতিভার খুব দাম, ভাবনার খুব জরুরত, কিন্তু আসলে পৃথিবীকে চালায় রূপ, আর বাহুবল। দুটোই বাইরের ‘গুণ’।

প্রতি: না। পৃথিবীকে চালায় যুক্তি, ভাবনা, দর্শন, শিল্প।

ভীম: বলিস কী? তোদের রাজ্যটাকে কে চালায়? যারা সন্ধেবেলা চ্যানেলে বসে ঝগড়া করে, ওরা? যারা খবরকাগজে তৎসম শব্দে ভর্তি কচকচিওলা বাইলাইন লেখে, ওরা? না, যারা গদিতে বসে নেচেকুঁদে মিথ্যে বলে কোটি কোটি টাকা মেরে তোদের কাঁচকলা দেখিয়ে নিজেরা বড়লোক হয়ে যায়, তারা? এখানে যুক্তি বুদ্ধি আলোচনা আসল, না হাতে-কলমে চুরি করতে পারা আর ভাল ভাল গুন্ডা ঠিক সময়ে লেলিয়ে দিতে পারাটা আসল? পৃথিবীকে চালায় কে?

প্রতি: গভর্নমেন্টরা, আবার কে?

ভীম: কচু। টেররিস্টরা। যারা ইস্কুলে ঢুকে বাচ্চাদের উড়িয়ে দেয়। যারা গ্রামে গিয়ে, যে লোকটা খাওয়ার জল এগিয়ে দিল, তাকেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। এদের সঙ্গে তুই কোন যুক্তি দিয়ে লড়বি? মানুষের সচেতনতা আর শুভবোধ জাগিয়ে, তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে, এয়ারপোর্টকে বন্দুক-পাহারাহীন করে ঘুরবি? না কি সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার কম্যান্ডো গড়বি? টেররিস্টের ঘাঁটিতে আরও উন্নত অ্যাটাক হেনে ওদের পান্ডাকে নিকেশ করবি?

প্রতি: ওটা আপনি খোসাটা দেখছেন। টেররিস্টেরও থিয়োরি আছে, তাই তো সে টেররিস্ট হচ্ছে।

ভীম: হ্যাঁ, সে থিয়োরিটা হল, আমি যুক্তিকে বাহুবল দিয়ে থাবড়াব। ওটাই পৃথিবীর চিরকালীন যুক্তি। ও বলে, আমার ভেতর চনচন করছে জোর, তাই আমি যা পারব দখল করব। ভাল-শরীর বলে, আমি এটাকে রোখার ক্ষমতা ধরি। ওকে ঘুরিয়ে এক থাপ্পড় মারব, মিটে যাবে। আর তোরা যাকে বলছিস শরীরের চেয়ে শ্রেয়, সে বলে, উঁহু, গোখরো সাপ এলেও আমাকে বহু ক্ষণ দাড়ি চুলকে ভাবতে হবে, তার পর আমি কর্তব্য ঠিক করব।

প্রতি: ‘ভাল’-শরীরটা কী? ভাল মন-ওয়ালা শরীর তো?

ভীম: হ্যাঁ, কিন্তু শরীরের প্রাধান্য স্বীকার করা মনওয়ালা শরীর। যে জানে, শেষ অবধি শরীরের জোর জিতবেই, তাই ভাল হওয়ার কোনও মূল্য নেই, যদি না তুমি শরীরটাকে অপরাজেয় করে তোলো। যেমন ধর, কীচক দ্রৌপদীকে জোর করে ভোগ করতে চেয়েছিল। কেন? দ্রৌপদীর সাংঘাতিক রূপ ছিল বলে। অর্থাৎ, শরীর। আবার, দ্রৌপদী এ নিয়ে আর কাউকে নালিশ করেনি, শুধু আমায় ব্যাপারটা বলেছিল। কেন? কারণ অন্যরা যত ক্ষণে বিরাট রাজার শালাকে মারলে তার কী রাজনৈতিক পরিণাম হতে পারে তার প্যাঁচোয়া ব্লুপ্রিন্ট ছকবে, তত ক্ষণে কীচক দ্রৌপদীকে বিছানায় পেড়ে ফেলবে। আমি কী করলাম? তুরন্ত কীচককে মার্ডার। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ দেখিস, দ্রৌপদী আমাকেই বেস্ট ভালবেসেছিল।

প্রতি: কিন্তু এখানে একটা গামবাটপনা কাজ করছে না? কিছু ভাবব না, জাস্ট পেটাব?

ভীম: প্রথমত, যেটাকে বলছিস গামবাটপনা, আমি বলি তেজোময়তা। যেটাকে বলছিস আগুপিছু না ভেবে হাত চালিয়ে দেওয়া, আমি বলি: ন্যানো-সেকেন্ডে ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। যেটাকে ভাবছিস কুলীন-চিন্তা বর্জন করে ভোঁতা মাস্ল-সর্বস্বতা, আমি বলি: মানুষের যথার্থ জীবন-প্রস্তুতি। দ্বিতীয়ত, তুই-ই তর্কটা গোঁড়া দিক থেকে করছিস। আমি বলিনি, ‘ভাবব না’, আমি কবিতা লেখার বিরুদ্ধে নই, মগজবিলাসে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি বলছি, বায়োলজিকাল কারণেই, শরীর অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যৌন উত্তেজনা, বা খিদে, বা পেটাবার ইচ্ছে, এই তাগিদগুলো এত সৎ, কোনও দিন দাবা খেলে তুই সেই তীব্রতা পাবি? আরে বাবা, তুই এত বাতেলা মারছিস, কারণ আজ দুবলা-পাতলারও টাকা বা ক্ষমতার জোরে সিংহাসনে বসার এলেম হয়েছে। কিন্তু আদতে মানুষ কী? একটা জন্তু। যে জোরে দৌড়ে হরিণ মারতে না পারলে, না খেয়ে মরবে। এটুকুই তো?

প্রতি: এইটুকুর বিরুদ্ধে যাওয়ার ইতিহাসটাই কিন্তু সভ্যতা। মহাভারতও তা-ই বলে। মানুষ এটাকে পেরিয়ে ছাড়িয়ে বহু দূর চলেছে বলেই তো সে মানুষ।

ভীম: শুনতে দারুণ। কিন্তু বাস্তবে ফক্কা। মানুষ যা-ই ভান করুক, রকেট আর ফিলসফি গজিয়ে নিজেকে যা-ই জপাক, জান্তব বৃত্তিই মানুষকে চালাচ্ছে, চালাবে। মহাভারত বলে, ধর্মযুদ্ধ বলে কিস্যু হয় না, সেই যুদ্ধে জয়ীরাও কোনও সুখ বা শান্তি পায় না, অবসন্ন হয়ে শেষ যাত্রায় ফ্যালফেলিয়ে পড়ে থাকে রুখা নির্জন জমিতে। ফলে, সে-ই লাভ করে, যে ম্যাক্সিমাম ভাল ভাল খাবার খেয়ে নিয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE