এক শহরে ছিল এক ভারী হিংসুটে দৈত্য। তার বিশাল প্রাসাদ, আর প্রাসাদের চার পাশে বিশাল বাগান। সেখানে লাল, নীল, বেগনি, হরেক রঙের ফুল ফোটে, গাছ থেকে ঝোলে সোনালি ফল। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে মনে মনে এক আনন্দ পায় দৈত্য— ‘এ আমার বাগান, শুধু আমার।’ তাই সে বড় পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলে বাগান, ঝুলিয়ে দেয় নোটিস— ‘অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।’ ক্রমে শীত এসে পড়ে, গাছের পাতা ঝরে যায়, কুঁড়িরা মুখ লুকিয়ে নেয় ঘাসের ভেতর, বরফের চাদরে ঢেকে যায় বাগান, আসে না কোনও পাখি। দৈত্য প্রতীক্ষা করে, কবে ফুরোবে শীত, আবার আসবে বসন্ত।
কিন্তু শীত যেন ফুরোতেই চায় না। সেই শহরের কোথাও নেই বসন্তের এক চিলতে আভাস। শুধু বরফপাত আর উত্তুরে হাওয়ার দাপট। বাচ্চারা গরম পোশাক পরে কাঁপতে কাঁপতে সকালে স্কুলে যায়, আর স্কুল থেকে এসেই ঢুকে পড়ে বাড়িতে। সারা দিন আর বেরোয় না। প্রবল শীতে দৈত্যেরও ভারী কষ্ট হতে থাকে। সে দূর গ্রামে এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পায়, তাদের গ্রামে বসন্ত এসে গেছে।
সে দিনই বাক্স-বিছানা নিয়ে দৈত্য চলে যায় তার বন্ধুর বাড়ি। দেখে, তার বাগান জুড়ে খেলা করছে বাচ্চারা। তাদের কলকাকলিতে ভরে উঠছে আকাশ-বাতাস, পাখিরাও আনন্দে গান শোনাচ্ছে তাদের, ফুলেরা ফুটে উঠেছে, দখিন হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে তারা। প্রায় সাত বছর বন্ধুর বাড়ি কাটিয়ে শহরে ফেরে দৈত্য। এখন তার মন জুড়ে বসন্ত, মেজাজ ফুরফুরে। কিন্তু এ যে শীতের শহর, পা রাখলেই হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরে যায়। দৈত্যর মনে আর কোনও হিংসে নেই, রাগ নেই, সে জানে কোনও কিছুই শুধু ‘আমার’ হয় না, সে জানে কেমন করে বসন্ত আসে। সে পাঁচিল ভেঙে ফেলে, ভেঙে দেয় ‘অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’ লেখা নোটিস বোর্ড। রোজ প্রতীক্ষায় থাকে, কবে আসবে বাচ্চারা তার বাগানে খেলতে।
কিন্তু বাচ্চারা আসে না। তারা কেবল স্কুলে যায়, আর বাড়ি ফিরেই পড়াশোনা করতে বসে। তাদের নাকি সময় নেই। দৈত্য ভাবে, ওদের বাড়িতেই বোধহয় মাঠ আছে খেলার। সে এর-ওর দরজায় ধাক্কা দেয়, বাবা-মায়েদের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু না, কেউ খেলে না, কারও বাড়িতে খেলার জায়গা নেই। কিন্তু ওরা না খেললে যে পাখিরা ডাকবে না, ফুল ফুটবে না। দৈত্য তাদের মা-বাবাদের বলে, ‘ওরা বাগানে খেললেই বসন্ত আসবে।’ শুনে মা-বাবারা রেগে যায়, বলে, ওরা বাড়িতে ‘গেম’ খেলে তো, আর আপনি তো ভারী হিংসুটে, নিজের ভালর জন্য ওদের পড়াশুনোর ক্ষতি করতে চাইছেন? ওরা সক্কলে শীতকাল ভালবাসে।
বরফঢাকা বাগানে একা একা ঘোরে দৈত্য। তার শরীর ভেঙে যায়, মনও অবসন্ন। হঠাৎ এক দিন একটা মিষ্টি আওয়াজে সে চমকে ওঠে। পাখি ডাকছে একটা গাছের ডালে বসে, গাছের নীচে ছোট্ট এক ছেলে। অবাক হয়ে দেখছে দৈত্যকে। আত্মহারা হয়ে দু’হাত বাড়িয়ে তার দিকে ছুটে যায় দৈত্য।
—এসো এসো, আমার সাথে খেলবে না?
—না, আমার সময় নেই তো।
—কেন নেই সময়?
ছেলেটি নিজেই যেন প্রশ্নের উত্তর খোঁজে, বলে ‘জানি না, কিন্তু এখানে দেখি কারও সময় নেই, তাই আমারও নেই।’
—তুমি পড়াশুনো করো না?
শুনে ছেলেটা হাসে। ‘আমি তো পড়াশোনা করি না, আমি খেলব বলে এর-ওর বাড়ি গিয়ে দেখি ওরা অন্য কী জানি ‘গেম’ খেলছে— ওই যে বাগানে দৈত্য ঢুকে পড়েছে, ঘরের মধ্যে জানলার পাশে লুকিয়ে বন্দুক তাক করে দৈত্যকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে।’ বলে এক দৌড়ে পালায় ছেলেটি। পাখিটাও গান থামিয়ে উড়ে যায়। বুক কেঁপে ওঠে দৈত্যর। বাগানে ঘুরলে গুলি করে দেবে?
ভয়ে আর বাগানে যায় না সে। কিন্তু সময়ও তার কাটতে চায় না। দৈত্য এক দিন বসে বসে ভাবে, কীসের ভয় তার? কাকে ভয়? এক দিন তার ভয়ে এই বাগানে কেউ ঢুকতে পারত না, আজ সে কিনা ভয় করছে একটা ‘গেম’কে? কী এই ‘গেম’? খোঁজখবর নিয়ে দৈত্য নিজেই কিনে আনল এক যন্ত্র, বোতাম টিপলেই সেখানে ফুলে ফুলে সাজানো বাগান, আর তাতে ঘুরে বেড়ায় এক দৈত্য। না না, মোটেই তার মতো দেখতে নয়। ভারী ভিতু এক দৈত্য, তাকে জানলা দিয়ে তাক করে বন্দুক টিপলেই সে মরে যায়, আবার ভয়ে ভয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে, আবার তাকে খুঁজে বার করে মেরে ফেলা যায়। এ ভারী মজার এক খেলা। এই খেলা খেলতে খেলতে কেমন করে জানি দিন কেটে যায়, রাত কেটে যায়, কই আগের মতো তো আর শীতে কষ্ট হয় না, এক বারও তো মনে হয় না বসন্ত কেন এল না? এমনকী বাগানে যাওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না আর। হিংসুটে দৈত্য শুধু সারা দিন ধরে ভিতু দৈত্যকে মেরে যায়, আর তার খুব আনন্দ হয়। তার বয়স বেড়ে যায়, চুলে পাক ধরে, তবুও সে ভাবে এই দুনিয়ায় তার সবচেয়ে বেশি শক্তি। এর মধ্যে বেশ কয়েক দিন পাখি ডেকেছে বাগানে, আর সেই ছোট্ট ছেলেটা অপেক্ষা করেছে দৈত্যর জন্য। কিন্তু সে দিকে কোনও হুঁশই নেই তার। ভিতু দৈত্যটা লুকিয়ে আছে, তাকে খুঁজে বার করতে হবে, মারতে মারতে আধমরা করে তবেই না দৈত্যর শান্তি। এই বাগানে সে লিখে দেবে আগের মতো, ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’। যদিও এ বাগান তার তৈরি নয়, তাতে কী এসে যায়?
এক দিন হঠাৎ বাইরে নজর পড়ল তার। সেই বাচ্চা ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শুকনো, চোখের কোণে জল। ছেলেটি গাছের তলা থেকে চিৎকার করে বলল, ‘আমার সাথে খেলবে?’
—না, আমি আর বাগানে যাই না।
—এসো না, আমারও একটা বাগান আছে, অনেক দূর, কিন্তু সেখানে সব সময় বসন্ত।
দৈত্যর এক বার ইচ্ছে হল যায়, কিন্তু এ সেই ছেলেটা না, যে ‘গেম’-এর ভয় দেখিয়েছিল? সে দিন দৈত্য ভয় পেয়েছিল, কিন্তু আজ তো দৈত্যের দিন।
দৈত্য একটা সত্যিকারের বন্দুক তুলে তাক করল ছেলেটার দিকে, জানলা থেকে। ছেলেটা চিৎকার করে পালিয়ে গেল, পাখিটা উড়ে গেল, আর দৈত্য আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল। জিত, জিত, আজকে তার জিত।
chakraborty.piyali@gmail.com