Advertisement
E-Paper

বাঘের মা

সে বারে অংশুলা বেড়াতে গিয়েছিল অসীমামাসিদের দেশের বাড়ি। সেই সুন্দরবনের ভেতরে। প্রায় দশ দিন ছিল। যে দিন বেড়াতে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলুম, ওখানে তো টিভি নেই, তা তোমার সময় কাটবে কী করে? উত্তরে সে বললে, কেন, সারা দিন তো নৌকায় হিঁয়াহুঁয়া ঘুরে বেড়াব। আর সন্ধেবেলা? পাশ থেকে অসীমামাসি বলল, কে বললে আমাদের ওখানে টিভি নেই। বাংলাদেশের চ্যানেল অবধি দেখতে পাই, তা জানো! এর পর আমি আর কথা বাড়ালুম না। ওদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। সায়েন্স সিটির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা বানতলা হয়ে গিয়েছে, ও দিক দিয়েই ওরা সোনাখালি অবধি যাবে।

রূপক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০০:৩২
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সে বারে অংশুলা বেড়াতে গিয়েছিল অসীমামাসিদের দেশের বাড়ি। সেই সুন্দরবনের ভেতরে। প্রায় দশ দিন ছিল। যে দিন বেড়াতে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলুম, ওখানে তো টিভি নেই, তা তোমার সময় কাটবে কী করে?

উত্তরে সে বললে, কেন, সারা দিন তো নৌকায় হিঁয়াহুঁয়া ঘুরে বেড়াব।

আর সন্ধেবেলা?

পাশ থেকে অসীমামাসি বলল, কে বললে আমাদের ওখানে টিভি নেই। বাংলাদেশের চ্যানেল অবধি দেখতে পাই, তা জানো!

এর পর আমি আর কথা বাড়ালুম না। ওদের গাড়িতে উঠিয়ে দিলাম। সায়েন্স সিটির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা বানতলা হয়ে গিয়েছে, ও দিক দিয়েই ওরা সোনাখালি অবধি যাবে। তার পর ভুটভুটি করে আরও ভেতরে। সে সব জায়গার নাম শুনলেই গা ছমছম করে— সজনেখালি, পীরখালি, নেতাধোপানির ঘাট। অংশুলা যাবে সজনেখালিতে।

দিন দশেক বাদে ফিরে সে যা বলল, তা শুনে আমি তাজ্জব। ও আমায় বাচ্চা পেয়ে নানা রকম গালগল্প ফাঁদল কি না, কে জানে? এ রকমও হয় নাকি! আমি তো আর ছিলাম না, ফলে আমায় কেউ বিশ্বাস করতে না-ই পারো, তাই অংশুলা যা বলেছে, তা-ই বলছি।

আমি তো গিয়ে উঠেছিলাম অসীমামাসিদের বাড়ি। সে ভারী শান্ত, নিরিবিলি, নির্জন জায়গা। বাড়ির চার পাশে বেড়া। এক পাশে বিরাট রান্নাঘর। শোওয়ার ঘরগুলো অন্য দিকে। মাঝে বিরাট উঠোন। উঠোনের মাঝখানে তুলসীমঞ্চ। বাড়ি ঢোকার সময় ছোট সুন্দর বাঁশের দরজা। ‘বাইরের ঘর’ বলে বড় একটা ঘর রয়েছে। সেখানে অতিথিদের বসতে দেওয়া হয়। বড় ঘরের সামনে দাওয়ায় বসে সবাই দুপুর-রাতের খাবার খায়। নারকেল পাতার আসন আর কাঁসার থালা-গেলাসে খাওয়া। নিমবেগুন ভাজা, মুসুরির ডাল, বেগুন ভাজা, কাগজি লেবু, কাঁকড়ার ঝাল। ওফ, সে যে কী খাওয়া, তা বলে বোঝানো যাবে না। সেখানে সবাই যে আমাকে কত ভালবেসেছে তা বলে বোঝাতে পারব না। সরষের তেল দিয়ে মুড়িমাখা, সঙ্গে পেঁয়াজি অথবা বেগুনি। হইহই করে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। এক দিন অসীমামাসির ছোট ভাই নিয়ে গেল নৌকো করে বেড়াতে। সে কী বলব! নদীগুলোর নাম ভাল করে মনে নেই। সরু একটা নদী দিয়ে আমরা তিন-চার জন যাচ্ছি। ও, তার আগে বলে নিই— আমাদের প্রত্যেকের পেছনে একটা মুখের মুখোশ বাঁধা। যেন হট করে দেখলে মনে হয় পিছন দিকেও আমার একটা মুখ রয়েছে। এ রকমই এ এলাকার দস্তুর। ধরো, নদীর ধারে ঘন ঘাসের জঙ্গলে বা কোনও একটা বিরাট মোটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে কোনও একটা মানুষখেকো ঘাপটি মেরে আছে। যেই তুমি পাশ দিয়ে চলেছ অমনি তোমার নৌকায় এক লাফ। সে যাক গে। ছোট নদী বা খাঁড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই দেখি একটু উঁচু ঘাসজমির ওপর দু’দুটো হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরবেলার আলো পড়েছে ওদের গায়ে। ওফ, মনে হচ্ছে যেন ক্যালেন্ডারের পাতা। ওরা বলল, যা-ই দেখো না কেন, টুঁ শব্দটি করবে না। আবার এক দিন অসীমামাসিদের বাড়ির গেটের সামনের নিচু কৃষ্ণচূড়া গাছটায় দেখি কী সুন্দর নীল রঙের একটা পাখি। লম্বা তার ঠোঁট। এ রকমই চার পাশে যখন যা দেখছি সবই ভীষণ ভাল লাগছিল। তার পর এক দিন ভোরবেলা ঘটল সেই ঘটনা। বাবা রে, ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় এখনও। তার আগের দিন আবার নৌকো করে গিয়েছিলাম চুনাখালি বাজার থেকে রাধানগরের দিকে। ছোট ভাই বলছিল, সেখান থেকে গাদিখালি দ্বীপের দিকেও নিয়ে যাবে। সে-ই বলল, এখন অমাবস্যায় ভরা কোটাল। নদীগুলো ভর্তি জল। ওই দেখ কত লোক চিংড়ি মাছ, এমনি মাছ, কাঁকড়া ধরতে এসেছে। সত্যিই তো! অবাক লাগছিল। ছোট ভাই তখন বলল, বাঘ কিন্তু সব খবর রাখে জানো তো?

— যাঃ, সে কী করে খবর রাখবে?

— আরে বাবা মানুষের গন্ধ পায় ওরা।

আর তার পর দিনই ভোরবেলা।

চিৎকার তো নানা রকমের হয়। আনন্দের চিৎকার, রাগারাগির চিৎকার— যা আমার মা সব সময় করে। খেলা দেখার চিৎকার, মিছিলের চিৎকার। কিন্তু আমার যে চিৎকারটা শুনে ঘুম ভেঙে ছিল, তা হল ভয়ের চিৎকার। হুড়মুড় করে উঠে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি অসীমামাসির দিদি ঝর্নামাসি রান্নাঘরের দরজার সামনে ঠকঠক করে কাঁপছে। বাড়ির আরও অন্যান্য লোকরাও বেরিয়ে এসেছে। ঝর্নামাসি ভেজানো রান্নাঘরের দরজা দেখিয়ে শুধু বলছে, বাঘ, বাঘ।

বাড়ির ছেলেরা পাশের বাড়ি, পাড়ায় খবর দিতে দৌড়ে গেল। যারা ছিল তারা বাড়ির ভেতর থেকে টাঙি, বল্লম, খিল, বাঁশ নিয়ে আসতে গেল। একটুক্ষণের মধ্যে অনেক লোক চলে এল। ভিড়ের মধ্যে দু’এক জন বলল, বন দফতরের মোবাইলে ধরো, ওরা আসুক। কেউ কেউ বলল, না না অত মায়া দেখাবার দরকার কী। এখানেই সাবড়ে দাও। ও যদি আমাদের কাউকে পেত সাবড়ে দিত না?

নিচু গলায় কে বললে, আরে বাবা, বাঘ বলে কি মানুষ না! মারবে কেন হে!

এরই মধ্যে ঝর্নামাসি বলল, আরে আগে তো সবাই শোনো, কী হয়েছে!

আবার চিৎকার উঠল, ঘরের মধ্যে বাঘ। এখন গল্প শুনব?

— আরে না না, শোনো শোনো। ভোরবেলা রান্নাঘরের কাছাকাছি আসতেই আমি বাঘের গায়ের গন্ধ পেয়েছিলাম। ভাবলাম একটু আগেই এ দিক দিয়ে হয়তো ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু রান্নাঘর খুলে দেখি বাঘটা রান্নাঘরের মেঝেয় শোয়া। আমি দরজা খুলে ওকে দেখে ভয়ের চোটে নড়তে পারছি না। ও-ও আমাকে দেখছে, কিন্তু শুয়েই রইল, এক বারের জন্য ওঠার চেষ্টাও করল না।

ঝর্নামাসির কথা বলার ফাঁকেই এসে পড়েছে বন দফতরের লোকজনেরা। এক জনের হাতে বন্দুক। সবাই-ই জানে ওরা দেখেশুনে বুঝেসুঝে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়বে। তাই করলও। এক জন দরজাটা একটু ফাঁক করেছে, অমনি প্রথম বার বাঘটা ‘হা-লু-ম’ বলে ডাক দিয়েছে। কত লোক যে যার মতো সেই ডাক শুনে দৌড় দিল। যে লোকটার হাতে বন্দুক ছিল, সে এ বার দরজার ফাঁক বড় করে একটু ক্ষণ লক্ষ স্থির করে তার পর গুলি চালাল।

খানিক ক্ষণের অপেক্ষা। তার পর বন দফতরের লোকেরা একটা বাঁশের সঙ্গে বাঘটাকে চার পা বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে একটা লরির দিকে যেতে যেতে বলাবলি করছিল, এ রকম সাধারণত হয় না। বাঘটা এক বার একটা ডাক ছেড়ে চুপ করে রইল। মাথা মাটিতে দিয়ে শুয়ে পড়ল। আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য!

সারা দিন চলল বাঘ নিয়ে গবেষণা। সে গবেষণা এতটাই গভীর যে কোনও রকমে দুপুরে নাকেমুখে গুঁজে আবার বাঘের গল্প।

সন্ধ্যাবেলার দিকে এল খবরটা— ওটা আদৌ বাঘ ছিল না। সবাই হা।ঁ চোখের সামনে দেখলাম যে। খবর নিয়ে এসেছে হাফিজ সরদার। সে বলল, না, আসলে ওটা বাঘিনি। জঙ্গল ছেড়ে গ্রামে ঢুকেছিল বাচ্চা দিতে। কেন না ও তো জানে, অন্য বাঘ এসে ওই দুধের বাচ্চা মুখে নিয়ে চলে যাবে। তাই বাঘিনি মানুষকেই সবচেয়ে ভরসা করেছে। যার জন্য অত মানুষ দেখেও সে তার শরীর ছেড়ে দিয়ে শুয়েছিল। এখানকার বন দফতরের ঘরে তাকে রাখা হয়েছে। চার পাশে তার এখন চার চারটে খেলনার মতো ছানা।

খবরটা পাওয়া মাত্র গোটা গ্রামে খুশির হাওয়া বয়ে গেল। অসীমামাসি, ঝর্নামাসিদের চোখে জল, ‘আহা রে, মেয়েটা বাচ্চা বিয়োতেই আমাদের কাছে এসেছিল। মেয়েরা তো তা-ই আসে বাপের বাড়িতে।’ ফোঁত ফোঁত করে নাকের জল টেনে তারা চোখ মুছল। অসীমামাসি গিয়ে টাকা এনে হারুকে ডেকে বলল, যা মিষ্টি নিয়ে আয়, আজ সবাইকে মিষ্টিমুখ করাব।

এ গল্প আমার না। অংশুলার। আমাকে এ গল্প বলে সে লাল টুকটুকে একটা টিফিন বাক্স খুলে বলল, ‘নাও মিষ্টি খাও। বাঘের বাচ্চা হওয়ার মিষ্টি। অসীমামাসি পাঠিয়েছে।’ মিষ্টি না খেয়ে পারা যায়? তোমরাই বলো।

rupak chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy