Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ভূতের সঙ্গে ইয়ে

ভূত এসে যৌনতা করে গেছে, এ দাবি অনেকের। কারও অবশ্য ব্যাপারটা ভালই লেগেছে। ইন্টারনেটে এই কাজের জন্যে ভূত/পেত্নিকে ডাকার ফর্মুলাও মজুত।হলিউডি ছবির অভিনেত্রী নাতাশা ব্ল্যাসিক কয়েক দিন আগেই বললেন, তিনি ভূতের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন! ‘আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম, বুঝতে পারলাম ঘরে অদৃশ্য কী একটা ঢুকল, তার পর আমাকে চেপে ধরল। আমি তার স্পর্শ আর উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলাম। ব্যাপারটা দিব্যি উপভোগ্য।’ মাসখানেক পরে এই অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে নাকি আবার তাঁর মোলাকাত হয়। মোলাকাত মানে, ওই আর কী, রতিক্রিয়া।

সুপ্রসাদ বৈরাগী
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

হলিউডি ছবির অভিনেত্রী নাতাশা ব্ল্যাসিক কয়েক দিন আগেই বললেন, তিনি ভূতের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন! ‘আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম, বুঝতে পারলাম ঘরে অদৃশ্য কী একটা ঢুকল, তার পর আমাকে চেপে ধরল। আমি তার স্পর্শ আর উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলাম। ব্যাপারটা দিব্যি উপভোগ্য।’ মাসখানেক পরে এই অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে নাকি আবার তাঁর মোলাকাত হয়। মোলাকাত মানে, ওই আর কী, রতিক্রিয়া।

ছোটবেলায়, আমাদের পাড়ার কৃষ্ণদা সম্পর্কে সকলেই বলাবলি করত, তাকে জিনপরিতে পায়। মাঝে মাঝে দু-এক মাস অন্তর সে রাতের বেলা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত। তার মা সকালে খুঁজতে গিয়ে দেখত, সে গাছের মগডালে বসে, বা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে। তার মা নাকি তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্বপ্নে একটা সুন্দরপানা মেয়ে তাকে বলেছিল, ছেলের বিয়ে দিলে সে তার ছেলেকে মেরে ফেলবে। অতএব, ধাপধাড়া হলধরপুরের মাটি বা ঝাঁ-চকচকে হলিউডের সিটি, ঘটনা একই ঘরানার!

ইউরোপীয় পুরাণ অনুযায়ী এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী এক রকমের দানো। তারা মানুষের অবয়ব ধারণ করে ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে। মানুষের মতোই তাদের নারী-পুরুষ শ্রেণিবিভাগ— মেয়েদের নাম ‘সাক্কুবুস’, আর ছেলে-ভূতরা ‘ইনকুবুস’। অনেকের মতে আবার, একই ভূত প্রথমে মেয়ে-রূপ ধরে পুরুষমানুষের কাছ থেকে শুক্র সংগ্রহ করে, তার পর ছেলে-রূপ ধরে মেয়েদের গর্ভবতী করে। অবশ্য, ভূতের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় কোনও মহিলা এখনও পর্যন্ত গর্ভবতী হয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যদিও দাবির অভাব হয়নি। মধ্যযুগে ইউরোপের মনাস্টারিগুলোতে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ব্রহ্মচর্য পালনের আদেশ ছিল। আদেশ যে সবাই মানবে এমন কোনও কথা নেই। সুতরাং, কোনও সন্ন্যাসিনী গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার দায় পড়ত ইনকুবুসদের উপর! ধর্মীয় গ্রন্থে এদের ছবি আছে। দেখতে দানোর মতো, কোনও ছবিতে তাদের পিছনে তিরের ফলার মতো লেজ। আর আছে ডানা। তবে মেয়ে-ভূতদের সব সময় খুব সুন্দরী হিসেবে দেখানো হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যের গন্ধ!

হলিউডের ‘দি এনটিটি’ ছবির দৃশ্য

মানুষের সঙ্গে ভূতের যৌন সংসর্গকে বলা হয় ‘স্পেক্ট্রোফিলিয়া’। এটি আসলে এক ধরনের তীব্র যৌন আকাঙ্ক্ষা, যার ফলে মানুষ আয়নায় দেখা নিজের প্রতিবিম্ব, এমনকী অশরীরীর প্রতিও আকৃষ্ট হয়। এক জন ৩৪ বছর বয়স্ক চিনা ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা বেশ করুণ। তিনি ১৬ বছর ধরে এক সাক্কুবুসের অত্যাচারের শিকার। তাঁর কথায়, ‘১৮ বছর বয়সে প্রথম তাকে স্বপ্নে দেখি। তার পর থেকেই দুর্ভোগের শুরু। চাকরিও চলে গেছে, কারণ কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। পাঁচ-পাঁচটা মেয়ে-বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করতে পারিনি।’

মডেল অ্যানা নিকোল স্মিথ আমেরিকার একটি পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর এই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘অনেক দিন আগে যখন টেক্সাসে থাকতাম, এক দানো আমার পা বেয়ে উঠে আসত এবং আমার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করত। প্রথম দিকে ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলাম, বোধহয় আমার বয়ফ্রেন্ড, কিন্তু এক দিন দেখলাম তা নয়।... প্রথমটা ভীষণ অস্বস্তি হত, ভয়ও, তার পর ভাবলাম, এ আমার কোনও ক্ষতিও করছে না, তুমুল আনন্দ দিচ্ছে, সমস্যা কোথায়?’

জিনা লেনিয়ার (এক জন ‘প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর’— অলৌকিকের গোয়েন্দাগিরি করা যাঁর কাজ) তাঁর ওয়েবসাইটে বলেছেন, তিনি কিছু দিন আগে ম্যারি জ্যানসেন ক্রস নামে এক মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যিনি মাঝে মাঝেই অশ্লীল ফোন কল পান। ম্যারি বলেছেন, ‘আমি জানি, যে আমায় ফোন করে সে একটা ভূত, কারণ জীবিত অবস্থায়ও সে আমাকে প্রায়ই ফোনে নানা নোংরা কথা বলে উত্ত্যক্ত করত এবং এর জন্যে পুলিশ তাকে বেশ কয়েক বার অ্যারেস্টও করেছিল। সে মারা যাওয়ায় ভাবলাম, যাক, অব্যাহতি পেয়েছি। কিন্তু আবার ফোন আসা শুরু হল। আশ্চর্য ব্যাপার, ফোন কোম্পানি কিছুতেই এই ‘কলার’কে ট্রেস করতে পারেনি। এমনও হয়েছে, আমি কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছি, তাদের ফোনে রিং হল, আমাকে ডেকে দিতে বলা হল, আর আমি ফোন ধরেই শুনলাম, সেই কণ্ঠস্বর।’

বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট ব্র্যান্ড স্টাইগারের লেখা একটি বই আছে, যার বিশাল নামটার গোড়াটা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: ‘ভৌতিক প্রেমকাণ্ড...’ এতে আছে ভূতে পাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকার কাহিনি, ভূত স্বামী-স্ত্রী’র গল্প, আর অবশ্যই ছায়াজগতের সেই সব শয়তানের কথা, যারা মানুষদের যৌন নিগ্রহ করার জন্যে রাতের পর রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে! হলিউডের একটা নামী ভূতের ছবি ‘দ্য এনটিটি’। সেখানে দেখানো হয়েছিল, নায়িকাকে প্রায়ই জোর করে ভোগ করে চলে যায় এক অশরীরী। উদ্দাম যৌনতার চিহ্ন নায়িকার সর্বাঙ্গে। গা ভর্তি কালশিটে, আঁচড়-কামড়ের দাগ। মন-চিকিৎসক দেখেশুনে বলেন, ভূতের ধর্ষণ আবার হয় না কি? এ সবই মেয়েটির মনগড়া। নিজের জীবনে সে অনেক যৌন অত্যাচার বা ‘অ্যাবিউজ’ সয়েছে, তার থেকেই জটিল এই মানসিক রোগ বাধিয়েছে। নিজেই নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এ দিকে অশরীরী কখনও কখনও সবার সামনেই অত্যাচার চালায়। তার পর অনেক কাণ্ড করে, প্রেতবিশেষজ্ঞদের সাহায্যে, কামাতুর প্রেতাত্মাকে রোখা হয়। এটা টুকে হিন্দি ফিল্মও হয়েছিল, ‘হাওয়া’। নায়িকা ছিলেন তব্বু।

এ রকম একটা ব্যাপার এই পর্নো-তাড়িত, নীলছবি-বুভুক্ষু আন্তর্জালের যুগে ব্যবসা না দিয়ে যায় না। শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা বা উপন্যাসের উপাদান নয়, অধুনা এর বিকিকিনি শুরু হয়েছে অন্য ভাবেও। সেই বেওসা-স্লোগান বলে: যাঁরা এ রকম ভূতের পাল্লায় পড়েছেন, তাঁরা তো ভাগ্যবান! কিন্তু যাঁরা পড়তে চান কিন্তু ‘তেনারা’ সদয় হননি, তাঁদের কী হবে? কয়েকটা অস্থিরমতি ভূত-প্রেত-দত্যি-দানোর মর্জির উপর ভরসা করে বসে থাকাটা তো কাজের কথা নয়। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। অন্তত আপনার ইচ্ছের জন্যে উপায় বের করতে লোকের অভাব হবে না, যদি সেখানে টু পাইস কামানোর সুযোগ থাকে। ইন্টারনেটে তাই পাবেন How to summon a Succubu—s সেই বহুকাঙ্ক্ষিত প্রেতিনীবাঞ্ছিত হওয়ার পদ্ধতি। পদ্ধতি নানা রকমের, কড়কড়ে টাকা গুনে শিখে নিতে হবে। তবে সদাশয় ব্যক্তিরাও আছেন, বিনে পয়সায় উপায় বাতলে দেন। একটা মেড-ইজি পদ্ধতি জনস্বার্থে এখানে দেওয়া হল!

উপকরণ: মোমবাতি (যে কোনও রঙের), কাগজ, কলম, সুচ। স্থান: যেখানে আপনি একা থাকেন এবং কেউ আপনাকে বিরক্ত করার নেই। সময়: রাত তিনটে। ক্রিয়াপদ্ধতি: যে কোনও ভাবে বসুন, শুধু খেয়াল রাখুন বসাটা যেন আরামদায়ক হয়। শুদ্ধ মনে ধ্যান করুন আপনি ঠিক কী কী করতে চাইছেন। এ বার একটা চিঠি লিখতে হবে ডাকিনীবিদ্যার দেবী লিলিথকে। ইহুদি পুরাণে ইনি আদমের প্রথম স্ত্রী। আদমের অনুগত থাকতে তিনি অস্বীকৃত হন এবং ইডেন ছেড়ে চিরতরে চলে যান। চিঠির সম্বোধনটা বেশ শ্রদ্ধাপূর্ণ হওয়া চাই।

হে মহীয়সী লিলিথ, আমি আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করি এবং আশা রাখি আপনি সদয় হবেন। (এর পর আপনার মনে যা অভিলাষ আছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করুন)। শেষ করুন এই ভাবে, ‘এই চিঠির প্রত্যেকটি শব্দ আমার হৃদয়প্রসূত এবং নিষ্ঠার সঙ্গে উল্লিখিত।’

লিলিথের কাছে লিখিত দরখাস্ত শেষ করার পর দস্তখত করুন যথাযথ ভাবে। আঙুলে সুচ ফুটিয়ে এক ফোঁটা রক্ত চিঠির উপর ফেলুন এবং শুকিয়ে যেতে দিন। এ বার সেটাকে জ্বলন্ত মোমবাতির সামনে রেখে, আপনি তাতে যা লিখেছেন, সেই কথাগুলো যথেষ্ট সময় নিয়ে নিবিষ্ট মনে ভাবুন এবং বলুন, ‘হে লিলিথ, সত্য এবং নিষ্ঠার সহিত দেওয়া আমার এই অঞ্জলি আপনি গ্রহণ করুন।’ এর পর চিঠিটাকে ভাঁজ না করে মোমবাতির আগুনে সেটাকে পোড়ান এবং মনে মনে বলুন, ‘বাতির এই উজ্জ্বল আলো পথপ্রদর্শক হয়ে তোমার কন্যাকে আমার কাছে নিয়ে আসুক।’ মোমবাতিটাকে অন্তত আধ ঘণ্টা জ্বলতে দিন।

এই তন্ত্রবিদ্যা আশু ফলদায়ক! আপনি আপনার গালের উপর ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করবেন। একই সঙ্গে মনে হবে রোমকূপে যেন একটা মৃদু সুচ-ফোটানো অনুভূতি, বুকে একটা চাপ। এই রকম হলে জানবেন কেল্লা ফতে, তিনি এয়েচেন আপনার কাছে। কিন্তু আলোর শিখা দেখে যেমন পতঙ্গরা হাজারে হাজারে আসে, সেই রকম আপনার এই বাতি-প্রজ্জ্বলিত প্রার্থনায় দত্যি-দানোরা যদি দলে দলে আসে, তা হলে আপনাকে একেবারে দলা পাকিয়ে দেবে। অতএব, এখানে একটু বিড়বিড় করে নিতে হবে, ‘হে লিলিথ-কন্যা, আমার কাছে আসার জন্য তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি আমার জীবনে এবং আমার স্বপ্নে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু অন্যান্য আত্মা-সত্তা, ভূত-প্রেত যারা তোমার সঙ্গে এসেছে, তাদের বিদেয় করো।’ এ বার বাতি নিভিয়ে বিছানায় যান।

এ কী, আপনি কি জোগাড়-যন্ত্রের জন্যে এখনই উঠে পড়লেন? রসুন। পেঁয়াজি করার আগে পরের লাইনটি পড়ুন। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: উপরে বর্ণিত ডাকিনীবিদ্যার প্রয়োগকালে কোনও রূপ প্রমাদ ঘটিলে এই কলমচিকে আপনি খামচি কাটিতে পারিবেন না।

বহু কাল ধরে চর্চিত এই রকম রোমহর্ষক ব্যাপারের বিজ্ঞানসম্মত কারণ থাকা বাঞ্ছনীয় এবং (দুঃখজনক ভাবে) আছেও। বিজ্ঞান একে ব্যাখ্যা করেছে ‘স্লিপ প্যারালিসিস’ হিসেবে। এটা সাধারণত হয় ঘুমের শুরুতে বা শেষের দিকে। এতে শরীরটা অবশ থাকে এবং অনেক রকম ‘হ্যালুসিনেশন’ হয়, যেগুলোকে ঘুমন্ত লোকটি একেবারে বাস্তব বলেই ভুল করে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও তার রেশ থেকে যায় এবং বোঝা যায় না ঘটনাটা আসলে ঘুমের মধ্যে ঘটেছে, না জাগ্রত অবস্থায়। মানসিক উৎকণ্ঠা, মাইগ্রেন, অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপ্নিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ এর জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই স্লিপ প্যারালিসিসই আসলে ভূতের সঙ্গে যৌনতা, ভ্যাম্পায়ার-আক্রান্ত হওয়া, বা এলিয়েনদের দ্বারা অপহৃত হওয়ার মোদ্দা ব্যাখ্যা।

তবে, খামখা বিজ্ঞানের ঘোরপ্যাঁচ এনে এমন রগরগে ব্যাপারকে মাটি করার দরকারই বা কী? বরং মটকা মেরে পড়ে থাকা যাক না!

bairagi.suprosad@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE