Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১

ম্যাজিক বাক্স

কলকাতা দূরদর্শন গতকাল পা দিল চল্লিশে। তার ‘প্রথম কর্মী’র কিছু সাদা-কালো ও কিছু রঙিন ফিরে দেখা।১৯৭৫ সালের ৯ অগস্ট বাঙালির জীবনে যেন একটা বিপ্লব ঘটে গেল, কলকাতায় টেলিভিশন এল। কিন্তু সেই বিপ্লবের তরঙ্গ ঘরে ঘরে পৌঁছতে অনেক সময় লাগল। একটি টিভি কিনে ফেলা তখন খুব সহজ ছিল না। টিভির অনুষ্ঠান দেখতে গেলে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হত, তার জন্যও বেশ একটা খরচ ছিল। টিভি লাইসেন্সের দিক থেকে এক নম্বর লাইসেন্স ছিল বি কে সাহা পরিবারের, তাঁরা বড় চা-ব্যবসায়ী ছিলেন।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

পঙ্কজ সাহা
শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

১৯৭৫ সালের ৯ অগস্ট বাঙালির জীবনে যেন একটা বিপ্লব ঘটে গেল, কলকাতায় টেলিভিশন এল। কিন্তু সেই বিপ্লবের তরঙ্গ ঘরে ঘরে পৌঁছতে অনেক সময় লাগল। একটি টিভি কিনে ফেলা তখন খুব সহজ ছিল না। টিভির অনুষ্ঠান দেখতে গেলে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হত, তার জন্যও বেশ একটা খরচ ছিল। টিভি লাইসেন্সের দিক থেকে এক নম্বর লাইসেন্স ছিল বি কে সাহা পরিবারের, তাঁরা বড় চা-ব্যবসায়ী ছিলেন। একটা করে লাইসেন্সের সংখ্যা বাড়ছে আর আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠছি, আমাদের পরিবার বাড়ছে। তখন দর্শকরা আর আমরা মিলে যেন একটা পরিবার। আমরা কী পারছি, আর কী পারছি না, কেন পারছি না, তা খোলাখুলি আমি ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠান মারফত জানাতাম। সেটা ছিল কলকাতা টেলিভিশন কেন্দ্রের পলিসি। তখন তো ‘দূরদর্শন’ নামটাই আসেনি। অনেক পরে টেলিভিশনের একটা ভারতীয় নামের খোঁজে ‘দূরদর্শন’ নামটি প্রস্তাব হয়ে এল। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তখন ভারতের জাতীয় অধ্যাপক। আমি গেলাম তাঁর কাছে তাঁর সম্মতির জন্য। তিনি সম্মতি দিলেন এবং আমার নিয়ে যাওয়া কাগজে সই করে দিলেন। পরে, সুনীতিবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনি আমাদের কাছে কী চান?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো কোনও দিন টিভি দেখিনি, তবে আপনারা কখনও ‘নমস্কার’ বলবেন না, ‘নোমস্কার’ উচ্চারণ করবেন।’

আমাকে প্রথম থেকেই ঘোষক-ঘোষিকাদের কাজ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান কী ভাবে প্রচারের জন্য সাজানো হবে, সেই প্রেজেন্টেশন ইউনিট দেখতে হত। আমি চেয়েছিলাম টেলিভিশনের একটা নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি গড়ে তুলতে, যেটা অন্য কোনও মাধ্যম— যেমন রেডিয়ো, মঞ্চ বা খবরের কাগজের মতো হবে না। আমার সহায় হয়েছিলেন আমাদের প্রথম ডিরেক্টর মীরা মজুমদার এবং সহকারী ডিরেক্টর শিপ্রা রায়। তাঁরা প্রথম থেকেই আমাকে যে সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কোনও দিন ভুলব না। আমরা নতুন কিছু শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করলাম। ‘সংযোজক’, ‘সংযোজনা’... এগুলো দরকার হল, কারণ আকাশবাণীর মতো ‘ঘোষণা’, ‘ঘোষক’, ‘ঘোষিকা’ শব্দগুলিতে আমাদের কাজের ধরনটা ঠিক বোঝানো যাচ্ছিল না। পরে ‘সংযোজনা’ শব্দটি দেখলাম সকলে গ্রহণ করে নিলেন, অন্য মাধ্যমেও ব্যবহৃত হতে থাকল।

পৃথিবীতে রেডিয়ো চালু হওয়ার খুব অল্প দিনের মধ্যেই ভারতে, কলকাতায় রেডিয়োর অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়, তার একটা কারণ বোধহয় ভারতে ব্রিটিশ শাসন। কিন্তু টিভি চালু হওয়ার অনেক বছর পরে আমরা কলকাতায় টিভি পাই। বহু দিন আমাদের দেশে টেলিভিশন পরীক্ষামূলক ভাবে দিল্লিতেই আটকে ছিল। কলকাতার আগে অবশ্য মুম্বইতেও টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। আকাশবাণী থেকে প্রকাশিত ‘বেতারজগৎ’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় একটি নিবন্ধে লেখা হয়েছিল, পৃথিবীতে এমন একটা ব্যাপার চালু হয়েছে, যাতে রেডিয়োতে ছবিও দেখা যায়, তার নাম টিভি, কলকাতাতে টিভি এসে গেল বলে। তা হলে আমরা তরকারি কুটতে কুটতে আঙুরবালার গান শুনতেও পাব, তাঁকে দেখতেও পাব।

ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম অডিয়ো- ভিশুয়াল কাজের। তাই কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ‘ইনস্টিটিউট অব অডিয়ো ভিশুয়াল কালচার’ নামে প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে টিভি আসার জন্য নানা ভাবে জনমত গড়ে তোলার কাজ চালাচ্ছিলাম, সেমিনারের আয়োজন করছিলাম, তেমন এক সেমিনারে সন্তোষকুমার ঘোষ বললেন, টিভি এলে কেমন ভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত।

প্রথম সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং। বাঁ দিক থেকে: অনুষ্ঠান পরিচালক পঙ্কজ সাহা,

বনফুল, গোপাল হালদার, রাধারাণী দেবী, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সংযোজক স্বপন মজুমদার।

এর মধ্যে হঠাৎ কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরলো, টিভিতে লোক নেওয়া হবে। আমি স্বভাব-আলস্যে গুটিয়ে রইলাম, তখন আকাশবাণীতে চাকরি করছি। আমার সিনিয়র সহকর্মী উপেন তরফদার উদ্যোগ নিয়ে আমার টিভিতে চাকরির আবেদনপত্র জমা দিলেন, আমায় বললেন, তুমি শুধু একটা সই করো। এত আবেদনপত্র এল যে আকাশবাণী ভবনে জায়গা কুলোল না। চাকরির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের প্যারিশ হল ভাড়া নেওয়া হল, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য লোকে লোকারণ্য। বিয়েবাড়ির টানা লম্বা টেবিল বিছিয়ে, ভাঁজ করা চেয়ার সাজিয়ে দেওয়া হল। সাংবাদিক, অধ্যাপক, নাট্যকর্মী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা এবং আকাশবাণীর কর্মীরা দলে দলে চাকরির আবেদন করেছেন, চারিদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছে, কলকাতায় টিভি আসছে। সারা দিন ধরে পরীক্ষা হল। প্রথমে স্ক্রিপ্ট লেখার পরীক্ষা, চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট, বিকেলে ভিশুয়ালাইজেশনের পরীক্ষা। কিছু দিন পরেই প্রাথমিক নির্বাচনের তালিকা বের হল; আকাশবাণী ভবনে ইন্টারভিউয়ের ডাকা পড়ল। ইন্টারভিউ নিতে বসলেন মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, প্রয়াত তথ্যচিত্র পরিচালক শান্তি চৌধুরী, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র অধিকর্তা দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত এবং ভারতীয় টেলিভিশনের প্রথম ডি.জি— পি ভি কৃষ্ণমূর্তি।

কলকাতা টেলিভিশনে চাকরিতে নিয়োগের খবর এল টেলিগ্রামে এবং পুণে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে আমাদের সরাসরি চাকরিতে যোগ দিতে বলা হল। ওখানে আমরা টেলিভিশন ফ্যাকাল্টির প্রথম ব্যাচ। প্রিন্সিপাল হিসেবে পেলাম সহৃদয় বাঙালি ভদ্রলোককে— সাধন মল্লিক। তিনি প্রথম দিন থেকেই বলতে লাগলেন, ‘বাবা, টেলিভিশন এত সহজ ব্যাপার নয়, তোমাদের দিনরাত পরিশ্রম করতে হবে।’ অধ্যাপক জসওয়ানি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শেখাতে লাগলেন যত্ন করে, আর অনেক অধ্যাপক শেখালেন টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের কাজ। সত্যজিৎ রায় এলেন টেলিভিশন ফ্যাকাল্টির উদ্বোধন করতে, আমরা ছুটোছুটি করে অনুষ্ঠানের কাজ করতে লাগলাম। সে দিন একই সঙ্গে ইনস্টিটিউটে উপস্থিত ছিলেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনও। অনুষ্ঠান শেষে মৃণাল সেন আমাদের দু-এক জনকে নিয়ে গেলেন ডিনার খাওয়াতে।

কোর্স শেষ করে যখন কলকাতায় ফিরলাম, তখনও টালিগঞ্জের পুরনো রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োকে বদলে টেলিভিশন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। টেলিভিশন তখন আকাশবাণীর একটা অংশ। সবাই আকাশবাণী ভবনেই বসতে লাগলেন। আমি যেহেতু আকাশবাণীর অনুষ্ঠানকর্মী ছিলাম, তাই চাকরির খবর আসার প্রথম দিনেই কাজে যোগ দিলাম, আর কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম কর্মী হিসেবে শনাক্ত হলাম।

মীরা মজুমদার কাজে যোগ দিয়ে, প্রথম দিনই নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতে এলেন। তাঁকে বসতে দেওয়ার জন্য খুঁজেপেতে একটা কাঠের প্যাকিং বাক্স জোগাড় করে আনলাম। তার পর চোখের সামনে একটু একটু করে সব গড়ে উঠল। স্টুডিয়ো অসমাপ্ত, তবু একটা ওবি ভ্যান, আউটসাইড ব্রডকাস্ট ভ্যানকে সম্বল করেই আমরা অনুষ্ঠান রেকর্ডিং শুরু করে দিলাম। ঠিক হল ৯ অগস্ট একটা বিশেষ দিন, শহিদ দিবস, সে দিনই শুরু হবে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচার। আমাকে পাঠানো হল কাগজের অফিসগুলোতে খবর জানাতে। ফিল্ম ইনস্টিটিউটের নতুন বন্ধু ওম পুরি, সুরেশ ওবেরয়, ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক নাসিরুদ্দিন শাহ’কেও জানালাম। দিল্লি থেকে তথ্য ও বেতার বিভাগের মন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী এলেন। রাজ্যের তরুণ তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন। বাংলাদেশ টিভির সেই সময়কার ডিরেক্টর জেনারেল জামিল চৌধুরী কয়েক জন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে যোগ দিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

টেলিভিশনের পরদায় প্রথম যে মুখটি ভেসে উঠল, তা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তের। সুব্রত কর, শাক্যসিংহ ধর আর বনবিহারী পাহাড়ী ছিলেন স্টুডিয়োতে ক্যামেরাম্যান, ধ্রুব মিত্র ফ্লোর ম্যানেজার। একটা লম্বা প্যান শটের পরে শর্মিষ্ঠার মিড শট এল। শর্মিষ্ঠা হাত জোড় করে ঘোষণা করলেন— নমস্কার, আজ থেকে কলকাতা টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হল।

‘নমস্কার, আজ থেকে কলকাতা টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হল।’ ৯ অগস্ট, ১৯৭৫। প্রথম দিনের প্রথম ঘোষণায় শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত।

তার পর স্রোতের মতো অনুষ্ঠান। কবি শঙ্খ ঘোষ তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের জন্য অসাধারণ সব স্ক্রিপ্ট লিখছেন। একেবারে শুরুতেই প্রথম তথ্যচিত্র ‘জন্মদিন-মৃত্যুদিন’, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন, অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র ‘রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে’, তাতে সংযোজিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর স্মৃতিচারণ। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রের জন্য মৈত্রেয়ী দেবীকে শুটিংয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম মংপুতে। শঙ্খদা শুধু স্ক্রিপ্ট লিখে দিচ্ছিলেন তা-ই নয়, শুটিং-এও থাকতেন আমাদের সঙ্গে, সারা রাত ধরে এডিটিং-এও। কী যে সব অসাধারণ স্মৃতি! কত বিশিষ্ট মানুষকে দেখেছি, তাঁদের সঙ্গ পেয়েছি! প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রাণী চন্দ, রাণী মহলানবীশ, প্রমথনাথ বিশী, মৈত্রেয়ী দেবী, মুকুল দে। নেতাজির সহযোগী কর্নেল জি এস ধিলোঁ, ক্যাপ্টেন রাম সিংহ— যিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর গানগুলি সৃষ্টি করেছিলেন, কর্নেল আবিদ হাসান, কর্নেল লক্ষ্মী সেহগল। এম এফ হুসেন, নীরদ মজুমদার, শানু লাহিড়ী, বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, সুনীল দাশ, প্রকাশ কর্মকার। সাহিত্যিকদের মধ্যে তো কেউ বাকি থাকেননি। নিয়মিত আসতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্যাল, রাধারাণী দেবী, অমিয় চক্রবর্তী, মণীশ ঘটক, জরাসন্ধ। আবার দেবিকা রানি, রোয়েরিখ, মাদার টেরিজাও এসেছেন।

‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠানটি, প্রথমে ঠিক হয়েছিল, চলচ্চিত্রের নায়করা কেউ করবেন। বিকাশ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলকুমার— এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল, কিন্তু অভিনয়ের কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রথম দিন কেউ সময় দিতে পারেননি। তাই শেষ মুহূর্তে ‘জন্মদিন-মৃত্যুদিন’ অনুষ্ঠানের এডিটিং থেকে আমাকে জোর করে তুলে পাঠানো হল, কোনও রকমে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানটা উতরে দেওয়ার জন্য। আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুতিহীন। স্টুডিয়োতে ঢুকতেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল, পরদায় ক্যাপশন ফুটে উঠল, ‘দর্শকের দরবারে’। লাইভ অনুষ্ঠান শেষ করে বেরোতেই দেখি স্টুডিয়োর বাইরে মীরাদি, শিপ্রাদি। তাঁরা বললেন, ‘তুমি কি জানো, কী কাণ্ড করেছ!’ অনুষ্ঠান চলার সময় ফোন আসছিল তাঁদের ঘরে, দর্শকদের ভাল লাগার কথা জানিয়ে। মীরাদি বললেন, ‘আর দু-একদিন করে দাও, তার পর ফিল্মের কোনও বিখ্যাত নায়ক করবে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত দর্শকদের ভালবাসায় টানা প্রায় দশ বছর এই ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠানটি একা আমি লাইভ করে গেছি। এ রকম দৃষ্টান্ত কোনও দেশের টিভিতে আছে কি না জানি না। আমি বিবিসি-তে চলে যাওয়ার পর, ফর্ম্যাট বদলিয়ে এক জন ঘোষিকা আর এক জন প্রযোজক অনুষ্ঠান করবেন ঠিক হয়। কলকাতায় ফিরে আমার আর এই অনুষ্ঠানটি করার পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু তৎকালীন ডিরেক্টর ডেকে বলেন, ‘অতুল্য ঘোষ, রথীন সেনগুপ্ত, যতীন চক্রবর্তী— এঁদের মতো মানুষেরা ফোন করছেন— তুমি কলকাতাতে ফিরেছ, কিন্তু দর্শকের দরবারে কেন করছ না?’ পরবর্তী পর্বে ‘দর্শকের দরবারে’ করতে গিয়ে সঙ্গে পেয়েছি চৈতালী-শাশ্বতীকে। দূরদর্শনে যে একটা স্বতন্ত্র ভাষা, অন্য রুচি আনবার সচেতন প্রয়াস চালিয়েছিলাম, তাতে আমি ঘোষিকাদের কাছে তাঁদের সহায়তার জন্য বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে চৈতালী-শাশ্বতীর কাছে। এঁদের দুজনকে আবিষ্কার করা এবং দূরদর্শনের পরদার জন্য তৈরি করে নিতে পারা আমার প্রফেশনাল জীবনের এক বিশেষ তৃপ্তির ব্যাপার।

প্রথম বছরেই মীরাদি আমাকে মহালয়ার অনুষ্ঠান করতে বলেন, আমি বলি— এই ট্র্যাডিশনটা তো রেডিয়োর, আমরা একটা ধর্মনিরপেক্ষ নতুন ট্র্যাডিশন গড়ব, সেটা বাংলা নববর্ষ নিয়ে। দ্বিতীয় বছর থেকে শুরু করলাম ‘নববর্ষের বৈঠক’। সেখানে আড্ডার ফর্ম্যাট’টাকে কাজে লাগালাম। আড্ডা এখন তো সব টিভি চ্যানেলেই খুব জনপ্রিয়। প্রথম আমি এই আড্ডার ফর্ম্যাটে অনুষ্ঠান করি ‘ভূপেন হাজারিকার আপন ভুবন’। ভূপেন হাজারিকা, রুমা গুহঠাকুরতা ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। রেডিয়োতে তখন সংগীতের অনুষ্ঠান মানে ছিল কেবল গান শোনানো। এটাকে ভাঙতে চাইলাম, তাই গল্প, আড্ডা, সঙ্গে সঙ্গে গান আনলাম পরীক্ষামূলক ভাবে। খুব জনপ্রিয় হল অনুষ্ঠান। একই ফর্ম্যাটে পরের অনুষ্ঠান করলাম রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রাজেশ্বরী দত্তকে নিয়ে, সঙ্গে ছিলেন গৌরী ঘোষ। অনুষ্ঠান রেকর্ডিং-এর ছ’দিন পরেই প্রয়াত হলেন রাজেশ্বরী। তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুষ্ঠান হিসেবে এটি প্রচারিত হয়। নববর্ষের অনুষ্ঠান প্রথমে হত সন্ধ্যায়, পরে এটিকে প্রভাতী করে দেওয়া হয়। প্রভাতী অনুষ্ঠানটিতে কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি! কখনও চলন্ত রেলগাড়িতে, কেননা ঘটনাচক্রে ভারতে প্রথম রেল চলেছিল এক পয়লা বৈশাখে। কখনও গঙ্গায় নৌকো ভাসিয়ে। ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে, পাতাল রেলের স্টেশনগুলোর নাম থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণের প্রয়াসে মেট্রো রেলে অনুষ্ঠান।

‘রবীন্দ্রনাথ নব্বই দশকে’ নামে একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন গোপন রেখে। যাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না, শুটিং চলছে। যে শহুরে মধ্যবিত্তরা বলছিলেন তাঁরা সব সময়ই রবীন্দ্রনাথেই ডুবে আছেন, তাঁরা কেউই মনে করে সম্প্রতি পড়া কোনও রবীন্দ্রকবিতার কথা বলতে পারলেন না। গ্রামের হাটে এক জন নিজেকে রবীন্দ্রভক্ত জানিয়ে নজরুলের কবিতা উচ্চ কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন। আবার কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউতে ছোট্ট চায়ের দোকানের এক হাফপ্যান্ট-পরা মালিক বললেন: বলেন কী! রবীন্দ্রনাথকে জানব না? আমরা দুজন তো একই গ্রামের লোক! কোন গ্রাম? — কেন, ভুবনডাঙা? ওখানকার এক ডাক্তারের মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে এলাম কলকাতায়, কী জানতে চান রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে? চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, তাসের দেশ, ডাকঘর— সব আমি জানি, কত দিন পাঠভবনের কিচেনে কাজ করেছি, কত রিহার্সাল দেখেছি, জানব না!

আবার মনে পড়ে, শান্তিনিকেতনে শুটিং। আম্রকুঞ্জে বসে রামকিঙ্কর ক্যামেরার উলটো দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘ঘুরছে, সব ঘুরছে, কেবলই ঘুরছে।’ চলন্ত রেলগাড়িতে ‘নববর্ষের বৈঠক’ অনুষ্ঠানে সলিল চৌধুরী বলছেন, ‘এই প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্য একটা গান লিখলাম’, বলে গেয়ে উঠছেন— এসো এসো নববর্ষ। তার পর ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাব’ গাইতে গাইতে সলিল চৌধুরী ট্রেন থেকে নেমে গেলেন।

রেডিয়োর ‘মহিষাসুুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের স্মৃতির অনুষ্ঠান হচ্ছে টিভিতে। স্টুডিয়োতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, আঙুরবালা, সুপ্রীতি ঘোষ সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন যাঁর জন্য, সেই রাইচাঁদ বড়াল এসে বললেন, ‘আমি তো ওদের সঙ্গে একসঙ্গে বসব না, ওরা তো সবাই আমার আন্ডারে চাকরি করত।’ তার পর, আলাদা করে তাঁর স্মৃ্ৃতিকথা রেকর্ড করতে হল। ‘আশ্রমজননী’ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং চলছে ওবি ভ্যানে, শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায় একটা ঘটে মাইক রেখে ফুল সাজিয়ে মাইকটাকে গোপন করা হয়েছে, আশ্রমজননীদের মধ্যে ক্ষিতিমোহন সেনের স্ত্রী হঠাৎ বললেন, ‘এই ঘটটা আবার আমাদের মধ্যে কে এখানে এনে রাখল?’ বলে ঘটাং করে ঘটটা সরিয়ে দিলেন। অনেকে যখন ছুটে যেতে চাইছেন ঠিকঠাক করে দিতে, আমি নিরস্ত করছি সবাইকে, যেমন চলছে চলতে দিন, ওঁরা এত দিন পরে এক জায়গায় হয়েছেন, গল্পে মেতে উঠেছেন, ভুলেই গেছেন যে শুটিং চলছে।

পঙ্কজকুমার মল্লিকের শেষযাত্রা, আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বললাম, ‘হেমন্তদা, এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অনুষ্ঠানে কোনও কথা বলতে চাই না, থাকবে শুধু গান আর গান, গানে গানে ভরিয়ে দিতে চাই আমাদের চোখের জলের এই অনুষ্ঠান।’ হেমন্তদা বললেন, ‘আমি সব ব্যবস্থা করে দেব, তুই আমার গাড়িতে উঠে আয়।’ শেষযাত্রা এগোচ্ছে, রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে লাল আলো দেখে এক অবাঙালি ট্রাফিক পুলিশ শোকমিছিল থামিয়ে দিলেন। হেমন্তদা রেগে আগুন হয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেলেন, ‘কে পঙ্কজদার শেষযাত্রা আটকাল দেখি’ বলে পুলিশের কলার ধরলেন চেপে, পুলিশও উদ্যত হলেন হেমন্তদাকে চড় মারতে, তখন এক জন পুলিশ অফিসার বাইক নিয়ে ছুটে এসে অবস্থা সামাল দিলেন। বললেন, ‘ইনি কে জানো— হেমন্ৎকুমার।’ নাম শুনেই ট্রাফিক পুলিশ একটা লম্বা স্যালুট ঠুকলেন।

প্রথম কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যখন লাইভ টেলিকাস্ট করতে চাই, তখন আপত্তি উঠেছিল: গান-বাজনা, কবিতাপাঠ তো স্টুডিয়োতেই হতে পারে। লাইভ হবে খেলা, বা কোনও রাজনৈতিক সমাবেশ। অনেক লড়াই করে প্রথম লাইভ টেলিকাস্ট করাই জোড়াসাঁকো থেকে পঁচিশে বৈশাখের প্রভাতী অনুষ্ঠান। দর্শকদের প্রিয়তা অর্জন করার পরের বছর থেকে রবীন্দ্রসদন এবং জোড়াসাঁকো থেকে সরাসরি প্রচার শুরু করি, পরে আরও অন্য রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও যুক্ত করতে থাকি। তার পর এক এক করে বইমেলা উদ্বোধন, চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন, শান্তিনিকেতন থেকে বসন্তোৎসব লাইভ টেলিকাস্ট ইত্যাদি শুরু করতে পেরেছিলাম। এগুলো কালক্রমে দূরদর্শনের নিজস্ব ট্র্যাডিশন হয়ে ওঠে।

রদ্যাঁর ভাস্কর্য নিয়ে কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শনী চলছে, হাতে হঠাৎ একটা রঙিন ক্যামেরা এসে গেল। তখনও কলকাতা টিভিতে সাদা-কালো অনুষ্ঠানই প্রচারিত হয়। তার মধ্যে হঠাৎ একটা রঙিন অনুষ্ঠান পেয়ে দর্শকরা চমকে উঠেছিলেন। যত দিন বিজ্ঞাপন ছিল না, তত দিন দূরদর্শনের চরিত্র ছিল ভিন্ন ধরনের। ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপনই হয়ে উঠল প্রধান নিয়ন্ত্রক। বেসরকারি চ্যানেল আসার পর দূরদর্শনের সামনে এল অন্য এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলা চলচ্চিত্র, থিয়েটার, সংবাদপত্র এবং আকাশবাণীর সঙ্গে। খুব জোর লড়াই চালাতে হয়েছিল নিজেদের জায়গা করে নিতে। আমার যে সহকর্মীরা সারা জীবন নেপথ্যে থেকে কাজ করে গেছেন, তাঁদের কথা দর্শকরা জানতেও পারেননি। তাঁদের আজ আমি প্রণাম জানাই।

দূরদর্শন চল্লিশে পা দিল। অনেকে বলেন, চল্লিশ পেরোলেই চালশে। আবার সুকুমার রায় বলে গিয়েছেন, চল্লিশে পৌঁছে বয়সটা ঘুরিয়ে দিতে হয়। নইলে ‘শেষটায় বুড়ো হয়ে মরি আর কি!’ আমার স্থির বিশ্বাস, চালশের ফাঁদে পা না দিয়ে, দূরদর্শন ঠিকই নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে গড়ে নিতে পারবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE