Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০১:০৭

পিনাকী ভট্টাচার্য

খাবারের ইতিহাস না খুঁজে এই সপ্তাহে খাবারের নামের ইতিহাস তল্লাশ করা যাক। জন মন্টেগু ছিলেন ইংল্যান্ডের অ্যাডমিরালটি দপ্তরের প্রথম লর্ড। এ ছাড়াও ছিলেন উত্তরাঞ্চল দপ্তরের বিভাগীয় সচিব, পোস্টমাস্টার জেনারেল, স্যান্ডউইচ দ্বীপের চতুর্থ আর্ল— ক্যাপ্টেন কুক যাঁর নামে ১৭৭৮ সালে স্যান্ডউইচ দ্বীপের নামকরণ করেন। এই রকম দক্ষ এক প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও মন্টেগু ছিলেন এক কুখ্যাত জুয়াড়ি। সারা রাত ধরে জুয়া খেলতেন। এক বার খেলায় এতই মগ্ন, প্রাতরাশের জন্যও জুয়ার বোর্ড থেকে উঠতে অস্বীকার করেন। তার বদলে তিনি খানসামাকে নির্দেশ দেন, দু’পিস পাউরুটির মধ্যে চিজ আর ঠান্ডা মাংস ভরে আনতে, যেটা তিনি এক হাতে খাবেন। অন্য হাত দিয়ে জুয়ো খেলে যাবেন। এখান থেকেই আজকের স্যান্ডউইচের জন্ম।

নেলি মেলবা-র আসল নাম ছিল হেলেন পোর্টার মিশেল। এই জনপ্রিয় গায়িকা তাঁর মঞ্চ-নামের মধ্যে তাঁর জন্মের শহর প্রিয় মেলবোর্নকে স্থান দিতে ‘মেলবা’ পদবি ব্যবহার করতেন। তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফ্রান্সের কিংবদন্তি শ্যেফ এস্কফফ্যে। তিনি পিচ ফল, র্যাস্পবেরি সস আর আইসক্রিম মিশিয়ে এক ডিজার্ট তৈরি করেছিলেন, আর নাম দিয়েছিলেন পিচ মেলবা— আজ তা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিজার্টগুলির মধ্যে অন্যতম। এস্কফফ্যে তাঁর প্রিয় নেলি মেলবার জন্য এতই মাতোয়ারা ছিলেন যে একের এক কালজয়ী পদ তৈরি করেছেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে। এক বার নেলি মেলবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী, খাবার হজম করতে অসুবিধে হচ্ছে— খবর পেয়ে ব্যাকুল এস্কফফ্যে তৈরি করলেন মুচমুচে সহজপাচ্য শুকনো পাউরুটি দিয়ে মেলবা টোস্ট— যা আজও স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষদের প্রিয় খাদ্য। এতেই থেমে থাকেননি— তিনি এর পরেও বানিয়েছেন ভ্যানিলা আইসক্রিমের ওপর স্ট্রবেরি পিউরি ছড়িয়ে স্ট্রবেরিস্মেলবা আর টমেটোর মধ্যে মুরগির মাংস আর মাশরুমের পুর দিয়ে, আর সেটা ভেল্যুতে সস আর পোর্ট ওয়াইন দিয়ে রেঁধে মেলবা গারনিচার; রন্ধনশিল্পী তাঁর সংগীতশিল্পী মানসীকে নিবেদিত একের পর এক রান্না আবিষ্কার করে সেই পদ আর প্রেমিকার নাম অমর করেছেন গু্যরমে-জগতে।

এবার সাহিত্যের চরিত্রের গপ্প। রামে বাসি কেক ডুবিয়ে রেখে এক অনন্য ডিজার্ট তৈরি করেছিলেন পোলিশ রাজা স্তানিসোয়াভ লেজিন্সকি। এই ডিজার্ট তৈরির সময় তিনি ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ পড়তে মগ্ন ছিলেন। আলিবাবা চরিত্রটা তাঁর এতই ভাল লেগে গেল, এই নতুন ডিজার্টের নামকরণ করলেন ‘বাবা’!

অ্যাপ্ল শার্লট নামের ডিজার্টের নামের পেছনে আছে শার্লট বাফ্-এর গল্প— সাহিত্য ইতিহাসবিদরা এই রকমই মনে করেন। শার্লট বাফ্ হচ্ছেন, গ্যেটে’র কালজয়ী উপন্যাস ‘সরোস্ অব ইয়ং ওয়ের্তের-এ বর্ণিত ‘লোতে’।

রোববার সকালে যারা পার্ক স্ট্রিটে বিয়ারের সঙ্গে বিফ স্টেক খেতে শুরু করে দিয়েছেন বসন্ত সমাগমে, তাঁদের জানাই, সামনে রাখা শাতুব্রিয়া’র নামটা ফরাসি উপন্যাসিক ভিকম্তে ফ্রাসোঁয়া দ্যে শাতুব্রিয়া’র নামে তৈরি। ১৮০২ সালে তিনি তাঁর ‘দ্য জিনিয়াস ইন ক্রিশ্চিয়ানিটি’ বইয়ের সাফল্য উদ্যাপন করতে প্যারিসের এক রেস্তরাঁয় গিয়েছিলেন। সেই রেস্তরাঁর মালিক ছিলেন লেখকের ভক্ত, তিনি লেখকের জন্য এক বিশেষ স্টেক বানান, সেটাই পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তার অনন্য স্বাদের জন্য। আর লেখক শুধু তাঁর লেখার জন্য নয়, এই স্টেকের জন্যও অমরত্ব লাভ করেন!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

চোরা ঠাকুর আর তনুজা বাস

বন্ধুটি বলেছিল সকালবেলা সাবিত্রী পৌঁছে দেবে। সাবিত্রী একটি বাসের নাম। ভেবেছিলাম সতী সাবিত্রী স্মরণে। ভুল ভাঙার কথা পরে বলব। আমার এক বন্ধু সদ্য চাকরিতে ঢুকেছিল তখন, কয়লাখনির ডাক্তার, আসানসোল শহর থেকে ষোলো কিলোমিটার দূরে পোস্টিং। ওর কাছে গিয়ে শুনলাম ওখান থেকে বাসে চেপে আর ১২ কিলোমিটার গেলে বরাকর নদীর ধারে একটা জমাটি টুসু মেলা বসবে পর দিন।

বন্ধুটি ছুটি পেল না, নতুন চাকরি তো; বেলা ১১টা নাগাদ সাবিত্রীর মাথায় উঠলাম। ভিড়ের কারণে ভিতরে ঢোকার সাধ্যি ছিল না। বাস থেকে যেখানে নামিয়ে দিল, সেখান থেকে পিলপিল করে মানুষ জমির আল ধরে নদীর দিকে যাচ্ছে। ধান কাটা হয়ে যাওয়া মাঠের উপরই মেলার শুরু। উত্তরের বাতাসে পতপত শব্দ করা রঙিন পলিথিনের ছাউনির তলায় কাঁচালঙ্কা-ফুলুরি যোগে মুড়ি খেতে খেতে মেলার মানুষ দেখছি, দেখলাম আর একটা বাস মানুষ নামিয়ে চলে গেল। বাসটার গায়ে লেখা তনুজা। এ বার অঞ্জনা। সাবিত্রী, তনুজা, অঞ্জনা— এরা তো সব সিনেমা-নায়িকা। ‘দেয়া নেয়া’, ‘রাজদ্রোহী’ কিছু দিন আগে খুব হিট গেছে। নায়িকা তনুজা এবং অঞ্জনা ভৌমিক। চা খেতে খেতে হিরোইন রহস্য-কথা জিজ্ঞাসা করায় কাঁধে ট্রানজিস্টর রেডিয়ো ঝোলানো এক জন বলল, এগুলা একই মালিকের বাস বটে। মালিক এ গাঁয়ের ছেল্যা। চোরা ঠাকুরের বেটা।

চোরা ঠাকুর আবার কে? আমার এ হেন অজ্ঞতায় অনেকেই অবাক। এই এলাকার একমাত্র বামুনের নাম না শোনা অন্যায় নয়? মেলা ঘুরতে ঘুরতে দেখি, নদীর বালুচরে একটা কাঁটা ভরা বড় বাবলা গাছের তলায় জরির ঝালর বসানো হাতলওয়ালা চেয়ারে গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এক বৃদ্ধ বসে আছেন, গলায় দু-তিন রকমের মালা। অনেকেই ওঁকে প্রণাম করছেন, বিশেষত মহিলারা। জানলাম, উনিই চোরা ঠাকুর। এটা কি আদরের নাম? ননীচোরা গোপীনাথ কিংবা মনচোরা ব্রজবিহারী যেমন? ঠাকুরমশাইটিকে ভাল করে দেখি। দু’গালে লাল লাল ছোপ। আবির? ততটা লাল তো নয়। সিনেমা আর্টিস্টদের গালে যেমন প্রসাধন জনিত লাল আভা থাকে। ওটাকে বলে রুজ। এক ভক্তিময়ীকে জিজ্ঞাসা করি, ঠাকুরমশাই গালে রং মেখেছে কেন গা? ভক্তিময়ী বলে, অং নয়কো, উটা চুনকালি। লাল রংকে বলছ চুনকালি? শুনি, উনার বেটা বড়নোক বটেন, এক গন্ডা বাস। সেই জন্য লাল করে দেছে। কিন্তু উটা চুনকালি। রহস্য গাঢ় হয়। বলি, চুনকালি কেন? শুনি— রাজার হুকুম ছিল যে...

গল্পটা হল— এক রাজপুত বংশীয় ধনী ভূমালিকের গৃহদেবতার পূজারী ছিলেন এই বামুনঠাকুরের বাবা। এ অঞ্চলে কোনও ব্রাহ্মণ ছিল না, দূর থেকে আনতে হয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর ইনিই পুজো-আচ্চার ভার পান। কিন্তু বছর তিরিশ আগে দেবতার বেশ কিছু রুপোর বাসন এবং স্বর্ণালংকার চুরি যায়— এবং চুরির দায়ে ধরা পড়েন এই পূজারী বামুন। ধরা পড়লে কী হবে? চোর ছাপ পড়লে ব্রাহ্মণত্ব হানি হয় না, পূজকের অধিকারও যায় না। থানা-পুলিশ করা হয়নি, তবে ভূমি মালিক আদেশ করেছিলেন মুখে চুনকালি মেখে এই বামুনকে পৌষ-পার্বণের দিনে সর্বসমক্ষে হাজির থাকতে হবে। সেই হুকুম প্রথা হয়ে গিয়েছিল। মেলার বাড়তি মজা। মুখ চুনকালি প্রলেপিত হলেও ব্রাহ্মণ-মহিমা নষ্ট হয়নি। আশেপাশে কয়লা খাদান। টাকা উড়ছে। নিম্নবর্ণের ছেলেপুলেরা কয়লা পাচারের স্বনিযুক্তিতে। বাইক। বাইক পুজো। বাস্তু পুজো করে গৃহপ্রবেশ। শবযাত্রায় সাদা খইয়ের সঙ্গে কয়েন। বামুন অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী। চুরির কারণে গাঁয়ের মানুষের কাছে উনি চোরা ঠাকুর হয়ে গেলেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আশ্চর্য লীলাখেলায় মানুষ চোরা ঠাকুরকে প্রণাম করে এই পৌষ সংক্রান্তির পবিত্র দিনে, আশীর্বাদ চায়।

চোরা ঠাকুরের ছেলেটা কলেজে পড়া। ও পুজো লাইনে যায়নি। পলিটিক্স-এ গেছে। হাই কানেকশন। কয়লার কারবার করছে। তা ছাড়া বাস। একটা মন্দির বানাচ্ছে। কারণ এ গাঁয়ে মন্দির নেই। ও এ গাঁয়ে বড় বাড়ি করেছে। তার পরই বলেছে চুনকালি নয়, লাল মাখিয়ে দাও মুখে, প্রথাটা থাক।

ওর সঙ্গেও আলাপ হল। ও আসানসোলে পরিবার নিয়ে থাকে। বাবাকে নিতে পারেনি গাঁয়ের মানুষের স্বার্থে। কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এত হিরোইনদের নামে বাস করলেন, সুচিত্রা সেন নেই? উনি জিভ কেটে বললেন, ছিছি, উনি আমার মাথায়। লোকে বুইলবে সুচিত্রার টায়ার পাংচার হল কিংবা সুচিত্রা হর্ন মারছে— ভাল লাগবে শুইনতে?

লোকটা এ বার বলল, দু’বছর পর আসুন না কেনে। দেখবেন মন্দির হয়ে গেছে। বাপকে মাথায় পাগড়ি পরিয়ে সিংহাসনে বসাব। আর দেরি করবেন না। মাধবী ছেড়ে দিলে ফিরতে পারবেন না।

কিছু দিন আগেই ‘শঙ্খবেলা’ হিট করেছিল খুব। উত্তম-মাধবী।

ও সব পুরনো কথা। আজ ওই টলিউড-প্রেমিক লোকটাকে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হল, কারণ মেট্রো রেলে শুনছি তো, ক্ষুদিরামের জন্য কত দেব/ দশ টাকায় নেতাজি হয়? তা ছাড়া লোকটা সেই কবেই তো চুনকালিকে প্রসাধনে রূপান্তর করে দিয়েছিল।

swapnoc@rediffmail.com

anandabazar rabibasariya rabibasariya magazine pinakee bhattacharya susmita chakrabarty swapnamay chakrabarty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy