Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০০:২২

শান্তনু চক্রবর্তী

মেয়েটা যখন এল, টমাস তখন ফাইল-টাইল গুছিয়ে যাব-যাব করছেন। মেজাজটাও তিতকুটে। নতুন নাটকের নায়িকার খোঁজে সারা দিন ধরে গুচ্ছের ন্যাকা, আনাড়ি অভিনেত্রীদের অডিশন নিতে হয়েছে। এবং এক জনকেও পছন্দ হয়নি! সেলফোনে সেই কথাটাই বলছিলেন কাউকে। ভেঙিয়ে দেখাচ্ছিলেন মেয়েগুলোকে। আর তক্ষুনি হলের দরজাটা সটান খুলে ঢুকে পড়ল মেয়েটা। খুব নাটকীয় ঝড়ের মতোই সেই ‘প্রবেশ’! পরের দেড় ঘণ্টা সেই ঝড়টাই দাপিয়ে বেড়াবে গোটা থিয়েটার হল। কিন্তু শুরুতে কোথাও তার আভাস ছিল না। এই মেয়েটাও অডিশন দিতেই আসছিল। ঝড়-বৃষ্টি-ট্রাফিক জ্যামে আটকে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। আমাদের নাট্যকার টমাস অবশ্য এই মেয়েটা, তার দেরির অজুহাত, গায়ে-পড়া ভাব, বাড়তি স্মার্টনেস দেখানোর চেষ্টা, কোনওটাকেই খুব পাত্তা দিচ্ছিলেন না। তবু মেয়েটা, যার নাম ভ্যান্ডা জর্ডন, তার অজস্র নখরা, কুশলী ন্যাকামো আর অনর্গল কথার তোড়ে টমাসের শুরুর বাধাটাকে টুসকিতে সরিয়ে দেয়। টমাস রাজি হয়ে যান অডিশন নিতে। ভ্যান্ডা নাটকের নায়িকার সংলাপ পড়ে, আর টমাস নায়কের ‘কিউ’ দেন!

এমনিতে ছবিটা আমেরিকান নাট্যকার ডেভিড আইভ্স-এর নাটক ‘ভেনাস ইন ফার’-এর সিনেমা রূপান্তর। আইভ্সের নাটকটা আবার অস্ট্রিয়ান লেখক স্যাখার মাসখ-এর ১৮৭০-এর উপন্যাস ‘ভেনাস ইন ফার্স’ থেকে অনুপ্রাণিত। সিনেমায় টমাস যে নতুন নাটকটা নামাতে যাচ্ছিলেন, সেটাও ওই উপন্যাসেরই নাট্য-রূপান্তর। ওই জন্যই তো ভ্যান্ডা তাকে এক বার ঠেসও দেয়, তুমি আবার কীসের লেখক? তুমি তো স্রেফ ‘অ্যাডাপ্টর’— উপন্যাসের মাল নাটকে চালান করেছ।

ভ্যান্ডা এই খবরটাও রাখে, ঔপন্যাসিক স্যাখার মাসখ-এর নাম থেকেই ‘ম্যাসোকিজ্ম’ শব্দটা এসেছে। আর মাসখের উপন্যাসের নায়কের মতোই টমাসের কাছেও আঘাত আর যন্ত্রণার মতো সেনশু্যয়াস যৌন-উত্তেজক কিছু হয় না।

এই সিনেমার পুরোটা জুড়েই তো নাটকের সংলাপ আর টমাস-ভ্যান্ডার মনের কথাগুলো একাকার হয়ে গেছে। উপন্যাসের আখ্যান, নাটকের সিচুয়েশন আর চরিত্রদের সত্যিকারের ইচ্ছে-বাসনাগুলো একটা আর একটার ওপর চেপে বসেছে। তাই টমাস যখন বলছিলেন যন্ত্রণাতেই তিনি সবচেয়ে বেশি যৌন আনন্দ পান আর এক জন নারীই সেটা দিতে পারে, তখন ভ্যান্ডা তাকে বলেছিল, তুমি যা ভাবছ, তোমার স্বপ্নের নারী তার চেয়ে আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুর হতে পারে। টমাসের চোখের ইশারায় চ্যালেঞ্জ ছিল, পারলে চেষ্টা করে দেখো। টমাসের নাটকের নায়িকার মতোই ভ্যান্ডা যতই সেই আঘাতদায়িনী ‘আনন্দ-নারী’ হয়ে উঠতে চায়, পুরুষ আর নারীর চিরকালের ক্ষমতার লড়াইটাও পরদায় ততই গনগনে হিংস্র, হিসহিসে বিষাক্ত হয়ে উঠতে থাকে! রাজনীতিতে যেমন, তেমনই প্রেম বা বিছানার যুদ্ধেও তো ক্ষমতা সব সময় একটা পক্ষের হাতেই থাকে। আর কে না জানে, মানুষের সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়নের সুতোটা সব সময় ছেলেদের আঙুলেই জড়ানো থাকে!

ছেলেরাই আশকারা দিয়ে, নারীর হাতে চাবুক ধরিয়ে, তার পায়ে চামড়ার হান্টিং বুট পরিয়ে, ‘ক্ষমতাময়ী’ হান্টারওয়ালি বানায়। আহ্লাদ করে তার চাবুকের নীচে পিঠ পেতে দিয়ে বলে, আমি তোমার দাসানুদাস। আর এটা বলার সময়েও সে আসলে মেয়েটার ভাবনা, ইচ্ছে, শরীরের ওপর নিজের দখলদারি কায়েম রাখতে চায়। ভ্যান্ডা এখানে পুরুষের সেই ‘সহনশীল’, ‘নিপীড়িত’ সাজার খেলাটাকেই পুরো পালটে দিতে চেয়েছে। এ ছবির গোটা সেটটাই একটা ফাঁকা থিয়েটার হলের ভেতর মঞ্চের ওপর। মাঝেমাঝে বিদ্যুতের চমক, মেঘের ডাক, ঝড়ের শব্দ ছাড়া বাইরের দুনিয়ার কোনও পাত্তা নেই। ও দিকে জানি না জানি না করেও হলের আলোর প্যানেল- বোর্ডের নিয়ন্ত্রণটা ভ্যান্ডাই হাতে তুলে নিয়েছে। তার ডিজাইন করা আলোতেই মঞ্চ জুড়ে এক অদ্ভুত আঁধার— শাণিত, নির্মম, প্রতিহিংসাপরায়ণ— সেই আলোতেই ভ্যান্ডা টমাসের ঠোঁটে কমলা লিপস্টিক লাগায়। স্নিকার্স খুলে পরিয়ে দেয় হিলতোলা স্টিলেটো! অডিশন দিতে আসা মেয়েটা গলায় বকলস দিয়ে টেনে নিয়ে যায় নাট্য-পরিচালককে। থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলে টমাসকে। পরাজিত, বিধ্বস্ত, পুরুষটিকে বিজয়িনী, দর্পিনী নারীর জিম্মায় রেখে ক্যামেরা থিয়েটার হল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন ইউরোপীয় শিল্পীর আঁকা ভেনাসের ছবির ওপর এন্ড টাইটেল পড়ে।

sanajkol@gmail.com

magazine santanu chakraborty santanu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy