Advertisement
১১ মে ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০০:১৫
Share: Save:

পিনাকী ভট্টাচার্য

এক যে ছিল ফরাসি। নাম ছিল তার গাব্রিয়েল মাতো দ’ ক্লু। সে অনেক দূরে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এক ফরাসি উপনিবেশে থাকত আর বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখত। যদিও বড়লোক হওয়ার রাস্তা তার জানা ছিল না। প্রত্যেক বছরের মতো সে বারও দেশে ছুটি কাটাতে এসে, তার কানে এল, রাজার বাগানে কফি গাছ হয়েছে। ক্লু উল্লাসে ফেটে পড়ল, বড়লোক হওয়ার রাস্তা পেয়ে গেছে বলে। কফি গাছের একটা চারার জন্য রাজা পঞ্চদশ লুই-এর কাছে অনুরোধ পাঠাল। সেটা সে তার মার্তিনিক দ্বীপে নিয়ে যেতে চায় আর কফি চাষ করে জাভায় গড়ে ওঠা ওলন্দাজদের কফি সাম্রাজ্যের একাধিপত্য ভাঙতে চায়।

কিন্তু রাজার পরিকল্পনাও যে প্রায় একই রকম। তিনি এক উটকো প্রজার আর্জি পাত্তা না দিয়ে পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিলেন। আর এই কফির চারা অনেক কষ্টে পাওয়া গিয়েছে। ১৭১৪ সালে তিনি এই গাছের চারা তাঁর বাগানের জন্য উপহার পেয়েছেন। আর তার আগে সামান্য একটা চারার জন্য ওলন্দাজ আর ফরাসিদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি! আরব বণিকরা কিছুতেই কফির বীজ হাতছাড়া করেনি। ওদের ভয় ছিল, যদি অন্য দেশও কফি তৈরি শুরু করে, তা হলে ওদের এই ব্যবসায় মৌরসিপাট্টা চলে যাবে। তাই তারা কফি বীজের ক্ষমতা নষ্ট করে ইউরোপ আর অন্য দেশে রপ্তানি করত, যাতে তা থেকে নতুন গাছ না হয়। আরব দেশেই কফির স্বাদ আর গুণাগুণ বন্দি ছিল প্রায় ৫০০ বছর ধরে। অটোমানের আরব আক্রমণের জেরে কফি তুরস্ক পৌঁছয়, আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মদের (যা কিনা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ) বিকল্প হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে— এতটাই যে, এর নাম দেওয়া হয় ‘কাহ্ভে’, যার অর্থ আরবের মদিরা। তুরস্কে একাধিক কফি হাউসও গড়ে ওঠে সে সময়, প্রথমটা হয়েছিল ১৫৫৪ সালে ইস্তানবুলে।

তুরস্ক থেকে কফি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে যায়। গোঁড়া খ্রিস্টান মতাবলম্বীদের ঘোর বিরোধিতার জন্য পোপ অবধি গড়ায় ব্যাপারটা। পোপের কাউন্সিল যখন কফিকে শয়তানের তেতো আবিষ্কার ঘোষণা করার জন্য পোপকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, পোপ অষ্টম ক্লেমেন্টও বাধ্য হয়েই কফির পেয়ালায় চুমুক দিলেন। আর পোপের এই পানীয় এতই ভাল লাগল যে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘শয়তানের পানীয় বড়ই সুস্বাদু। আমরা বরং শয়তানকে ঠকিয়ে পানীয়টার শুদ্ধিকরণ করে নিই।’

ফলে ইউরোপের কোণে কোণে কফি হাউস চালু হতে লাগল— ভেনিসে ১৬৪৫-এ, ইংল্যান্ডে ১৬৫০-এ আর ফ্রান্সে ১৬৭২-এ। কিন্তু কফির রসদ পাওয়া যেত শুধু আরব বণিকদের কাছ থেকেই, যত দিন না ওলন্দাজরা মোকা বন্দরের কিছু আরব ব্যবসায়ীকে ঘুষ দিয়ে কফির চারা জোগাড় করে।

ফিরে আসি ক্লু-র কথায়। বড়লোক হওয়ার এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করে কী করে! অতএব রাতের অন্ধকারে পাঁচিল ডিঙিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাগানে প্রবেশ, আর গাছ চুরি, আর অবিলম্বে দেশ ছেড়ে পলায়ন। সে বারই ফেরত যাবার পথে একের পর এক চিত্তির— সমুদ্রের বুকে ঝড়ের কবলে পড়া, জলদস্যুর আক্রমণ, আর শেষে জাহাজে পানীয় জল শেষ হয়ে যাওয়া। নিজে জল কম খেয়ে গাছের চারাকে বাঁচিয়ে, ক্লু মার্তিনিক দ্বীপে পৌঁছে তার স্বপ্নের চাষাবাদ শুরু করে। আর সেই চুরি করে আনা চারা থেকে সেই দ্বীপে পরের পঞ্চাশ বছরে এক কোটি আশি লাখ কফি গাছ জন্মায়। এই মার্তিনিক দ্বীপ থেকেই কফি ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, দক্ষিণ আর মধ্য আমেরিকায়।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

প্রথম দিন ওঁর বাড়ি। দরজার সামনে একটা দড়ি ঝুলছে, আর একটা বোর্ডও ঝোলানো। বোর্ডে লেখা ‘দড়ি ধরে মারো টান, সাড়া দেবে সত্যবান’। যে পাড়ার ছেলেটি ওঁর বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিল, বলল— হ্যাঁ, উনি এখন ‘ইন’। বাড়িতে আছেন। দড়ি ধরে টানুন। টানলাম, ঘণ্টার শব্দ শুনলাম। দোতলার বারান্দায় উনি দেখা দিলেন। বলি— সত্যবান মিত্রর সঙ্গে দেখা করতে চাই। জবাব এল, আমিই সেই অধম।

অধম দরজা খুললেন। বাঁ দিকে জুতো রাখার র্যাক। ওখানে একটা বোর্ডে লেখা ‘জুতোর বাড়ি’। আমার চটিজোড়া জুতোর বাড়ির ভিতরে নয়, সামনেই রাখলাম। জুতোর বাড়ির উপরে মেন সুইচ, লাল আলোর ইন্ডিকেটর জ্বলছে, ওখানেও একটা কাগজের স্ট্রিপ সাঁটানো। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’। ভিতরের ঘরে বসানো হল। ওঁর একটি রস-রচনা পড়ে খুব ভাল লেগেছিল, রেডিয়োর জন্য ওঁর রম্যকথিকা চাইতে এসেছিলাম। বললাম সেটা। উনি বললেন, এ সব কঠিন কম্মো আমার ধম্মে নেই। আমি ‘কঠিন কিছু না’ ইত্যাদি বলতে বলতে ঘরটায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। বইয়ের তাকে একটা কৃষ্ণনগরের লেবু। ওটার গায়ে লেখা ‘বেশি কচলাতে নেই’। দেওয়ালে লেখা ‘নজর উঁচু করুন’। উপরেই তাকাই। দেখি, সিলিং ফ্যানের তিনটি ব্লেডের গায়ে লেখা ‘অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ’। মানে? উনি ফ্যান চালালেন। ‘আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’ মাথা নাড়াই। উনি বললেন, তবেই বুঝুন। বুঝলাম হাই থট। পরশুরামের ‘মহাপুরুষ’ অনেকটা এ রকম হাই থট ব্যাখ্যা করেছিলেন আঙুল ঘুরিয়ে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে মহাকাল। চলমান অবস্থায় সব একাকার। বাপ রে! সে দিন আড্ডা জমল সত্যবানের সঙ্গে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

যখন ফিরছি, এগিয়ে দিতে এলেন। ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বোর্ডটি উলটে দিলেন। উলটো দিকে লেখা ‘ঊর্ধ্বলোকে সত্য নাই, দড়ি টানা বৃথা তাই’। মানে, উনি এখন আউট।

ওঁর সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় হল। ওঁর বাড়িতে আরও গেলাম। প্রতি বারই নব-নব আবিষ্কার। বাথরুমের গায়ে লেখা ‘প্রাতঃস্মরণীয়’। সিস্টার্ন-এর গায়ে লেখা ‘সহস্রধারা’। রান্নাঘরের দরজায় লেখা ‘পাক-ই-স্তান’। ফ্রিজের গায়ে লেখা ‘অনাবাসী’। খাবার টেবিলের কাচের তলায় নানা সুখাদ্যের ছবি। যথা বিরিয়ানি, পিৎজা, ফ্রুট স্যালাড...। বললেন— খাই তো ডাল ভাত চচ্চড়ি। ছবিগুলো থাকলে মন্দ কী? দৃশ্যেন অর্ধভোজনম্।

কিছু দিন পরে গিয়ে দেখি ছবিগুলো নেই। ওঁর স্ত্রী জানালেন, আপনার বন্ধুর সুগার ধরা পড়েছে যে, তবুও আমটা ছাড়তে পারছে না। এ বার লক্ষ করি, টেবিলের কাচের তলায় আমের ছবি। গায়ে লেখা ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’।

এর পর ফোন করলে ভাল করে কথা বলতেন না সত্যবান। গলাটা বিমর্ষ। অফিসেও যেতেন না ঠিকমত। আবার ওঁর বাড়ি যাই। ওঁর স্ত্রীর কাছে শুনলাম ডিপ্রেশনে ভুগছেন। ডিপ্রেশনের কারণ মধুমেহ নয়, মধুচক্র। বাড়ির সামনের গাছে একটা মৌচাক হয়েছিল, মৌমাছির ভয়ে লোক ডেকে ধোঁয়া দিয়ে মৌচাকটিকে উচ্ছেদ করেছেন, সেই অপরাধবোধে ভুগছেন। এতগুলো মৌমাছিকে উচ্ছেদ করা হল, অথচ আমরা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কথা বলি। আমি বলি— এ জন্য ডিপ্রেশন? ওঁর স্ত্রী জানালেন, ওঁর আগেও হয়েছে। বাড়িটা দোতলা করার সময় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ কেটে ফেলতে হয়েছিল। তখনও।

এত রসিক মানুষের এত সহজে অবসাদ হয়? এক জন মনোবিদ আমাকে জানিয়েছিলেন, দেহে হিউমোরস নামক রসের আধিক্যে ফ্লেগম্যাটিক, মেলান্কলিক ইত্যাদি টাইপের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। সে সবও হাই থট। বুঝি না।

ওঁর মধুচক্র সিনড্রোম মিটতে বছরখানেক লেগেছিল। তার পর আবার আগেকার মতোই।

এই গ্রীষ্মে ওঁর বাড়ি গেলাম। দেখি, একটা স্প্লিট এসি মেশিন বসিয়েছেন। দেখি, ওটার শ্বেতগাত্রে রক্তবর্ণে লেখা ‘মা শীতলা’। আর ফ্যানের ব্লেডে এখন ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’। কিন্তু লোকটা বিমর্ষ। কথা বলছেন না তেমন।

আবার কী হল?

ওঁর স্ত্রী জানালেন, পর পর দু’দিন দু-দুজন লোক এসে বলল— কী সত্যবানবাবু, আপনি পালটে গেছেন দেখছি। সারা ঘরে ঠাকুর-দেবতার নাম। ভালই। এই বয়সে ধর্মে মতি হওয়া ভাল।

তার পর থেকেই...

দুঃখপ্রকাশ

২৭-৭, রবিবাসরীয়তে এই কলামে, ‘ইদ্রিস’ চরিত্রটির প্রসঙ্গে ইঙ্গিত ছিল যে তিনি সরকারি কর্মী ছিলেন না। ওঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি সরকারি কর্মচারীই ছিলেন। আরও কিছু তথ্যগত ত্রুটির কারণে ওঁরা ব্যথিত। উনি ওঁর এলাকায় সম্মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন। কেউ ব্যথা পেলে আমি দুঃখিত। প্রসঙ্গত জানাই, এই কলামটি ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ নয়। এখানে কল্পনার অবকাশ থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE