কথায় বলে ‘ভক্তের ভগবান’ আর ভক্তি যেখানে প্রাধান্য পায়, সেখানে শ্রেণি, বর্ণ, বিত্ত মূল্যহীন। শুদ্ধ চিত্তে যে তাঁকে ডাকে, তিনি তার ডাকেই সাড়া দেন, ভালবেসে গ্রহণ করেন তার গুছিয়ে দেওয়া অতি সামান্য নৈবেদ্যের ডালিও, এমনই বিশ্বাস ভক্তজনের। তাই তো মরমি কবিদের কলমে অমর হয়ে রয়েছে এই দ্বিমুখী সম্পর্কের মূল সুর, ‘‘দেবতারে করি প্রিয়, প্রিয়েরে করি দেবতা’’। ঈশ্বর আর প্রিয়জন একই সত্তার দুই রূপ, যেখানে কিছুই অদেয় নয়। তাই কালে কালে মানুষ তার সাধারণ রান্নাঘরের ভোগ নিবেদনে জুড়ে দিয়েছে তার প্রাণের ঠাকুরের নাম। মোহনভোগ, গোকুলপিঠে, গোপালকালা। এই সব নামের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণপ্রেমের সৌরভ। অতি সাধারণ উপকরণে তৈরি এই সব ভোগের ডালি দেবতার স্পর্শে হয়ে উঠেছে বিশেষ।
মোহনভোগ। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।
যেমন মোহনভোগ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালি'তে অপু শৈশবেই যে ভাবে অনুভব করেছিল যে, বিত্তের পার্থক্যে মোহনভোগের স্বাদে কেমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়, ভগবানের এই ভোগের বসবাস সেই ভারী হয়ে থাকা উপলব্ধির থেকে অনেক দূরে। ঘি আর কিশমিশের আধিক্যে নয়, ভক্তিরসে ভরপুর হলেই প্রভু ভালবেসে গ্রহণ করেন তার প্রিয় এই ভোগ, ধারণা ভক্তদের।
মোহনভোগ
উপকরণ:
সুজি: ১ কাপ
ঘন দুধ: ৩ কাপ
চিনি: ৩/৪ কাপ
ঘি: ৩/৪ কাপ
এলাচ: ৩ টি
কাজু, কিশমিশ, কাঠবাদাম: ১ কাপ
তেজপাতা : ২ টি
পদ্ধতি:
কম আঁচে, শুকনো খোলায় ভাল করে সুজি ভেজে নিন। এ বার দুধ, চিনি আর সুজি ভাল করে মিশিয়ে সরিয়ে রাখুন আধ ঘন্টা। কড়াইতে ঘি গরম করে প্রথমে তেজপাতা দিন। তাতে কুচি করা বাদাম দিয়ে কম আঁচে নাড়ুন বাদামি রং না ধরা অব্দি। কিশমিশ দিয়ে সামান্য নেড়ে এতে সুজির মিশ্রণ দিয়ে দিন। ভাল করে খুন্তি নাড়তে থাকুন। প্রয়োজনে আরও দুধ দিন। ধারে ঘি বেরোতে শুরু করলে এলাচগুঁড়ো মিশিয়ে গোপালকে নিবেদন করুন গরম মোহনভোগ।
গোপালকালা। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।
শ্রীকৃষ্ণের অনেক রূপের মধ্যে তাঁর বালগোপাল রূপই ভক্তদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। ছোটবেলায় অন্য গোপবালকদের সঙ্গে যখন তিনি গরু চরাতে যেতেন তখন সকলেই সামান্য কিছু না কিছু খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতেন। দুপুরবেলায় শ্রীকৃষ্ণ সেই সব কিছু মিশিয়ে দিতেন নিজের হাতে। তাঁর স্পর্শে সেই সামান্য খাবার স্বাদে গন্ধে এতটাই অসাধারণ হয়ে উঠত যে, আজ মহারাষ্ট্রের জন্মাষ্টমীর বিখ্যাত ‘দহি হান্ডি’র প্রতিযোগিতার হাঁড়িতে লুকোনো থাকে ‘গোপালকালা’ নাম প্রসিদ্ধ এই ভোগ।
গোপালকালা
উপকরণ:
চিঁড়ে: ১/২ কাপ
দই: ১/২ কাপ
মুড়ি: ১/৪ কাপ
দুধ: ১/২ কাপ
চিনি: ২ চা চামচ
নুন সামান্য
শসা: ১ টি ছোট
ভেজানো ছোলার ডাল : ২ টেবিল চামচ
নারকেল কোরা: ১/২ কাপ
আদাকুচি: সামান্য
মাখন: ২ চামচ
কাঁচালঙ্কা কুচি: সামান্য
পছন্দের ফল (বেদানা, আপেল ইত্যাদি) ১ কাপ কুচি করা
প্রণালী:
চিঁড়ে ধুয়ে ভিজিয়ে জল ঝরিয়ে নিন। এ বার একটি বাটিতে চিঁড়ে সহ সব উপকরণে চিনি নুন মিশিয়ে হালকা হাতে মেখে নিন। উপর থেকে ফলের কুচি ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।
গোপালের পুজো মানেই তাতে তালের পদ থাকতেই হবে। জন্মাষ্টমীর দিনে পাকা তালের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে হেঁশেল জুড়ে। তালের বড়া, পায়েস কিংবা মালপোয়া তো রয়েছেই, এ বার তালের পিঠে বানিয়ে সাজিয়ে দিতে পারেন ভোগের থালায়।
তালের পিঠে
উপকরণ:
তালের ক্বাথ: দেড় কাপ
চালের গুঁড়ো: ১ কাপ
ময়দা: ১/৩ কাপ
সুজি: ১/৩ কাপ
খাওয়ার সোডা: ১/২ চামচ
চিনি ১ কাপ
দুধ: ১-২ কাপ
নারকেল কোরা: ১ কাপ
কিছু কলা বা কাঁঠাল পাতা
প্রণালী:
দুধ ছাড়া সব কিছু একটি বড় বাসনে ভাল করে মিশিয়ে নিন। এতে একটু একটু করে দুধ মেশান, যাতে বেশ ঘন একটি মিশ্রণ তৈরি হয়। ঢাকা দিয়ে সরিয়ে রাখুন আধ ঘন্টা, যাতে সুজি ও চাল নরম হয়ে যায়। প্রয়োজনে আরও একটু দুধ মেশান। কলাপাতার টুকরো অথবা কাঁঠালপাতাকে পানের খিলির মতো মুড়ে টুথপিক দিয়ে আটকে ছোট ছোট চোঙার মতো আকার দিন। এ বার একটি স্টিমার বা অন্য বড় বাসনে জল দিয়ে ভাপানোর জন্য প্রস্তুত করুন। জল ফুটে উঠলে ওই চোঙগুলিতে মিশ্রণটি ভরে একটি বাটিতে সব পাশাপাশি বসিয়ে কম আঁচে ভাপিয়ে নিন, ১৫-২০ মিনিট পরে একটি টুথপিক গেঁথে দেখে নিন, ভিতর অবধি সেদ্ধ হয়েছে কি না। হয়ে গেলে উপরে ক্ষীর আর নারকেল ছড়িয়ে ভোগের থালায় পরিবেশন করুন।