Advertisement
E-Paper

জীবনের মাঠেও হেরে যাওয়া মানুষটার পাশে আছি

আউট হয়ে মাথাটা নিচু করে সে যখন প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরছে, সে সময়টায় আমি তার সঙ্গে সব থেকে একাত্ম বোধ করি। লিখছেন রূপম ইসলামআউট হয়ে মাথাটা নিচু করে সে যখন প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরছে, সে সময়টায় আমি তার সঙ্গে সব থেকে একাত্ম বোধ করি। লিখছেন রূপম ইসলাম

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৩১

যারা ক্রিকেট দেখে শুধুই প্রিয় দলের জিত দেখার জন্য, আমি তাদের দলে পড়ি না!

আমি খুশি হই লড়াই দেখে, লড়াকু মনোভাব দেখে। মাঠে নেমে এগারোটা ছেলে তাদের সর্বস্ব পণ করেও ম্যাচ বার করতে না পারলে আমি মুহ্যমান হই না। বরং খুশি হই, উদ্দীপিত হই, ওদের লড়াইটা দেখে।

ক্রিকেট খেলাটা আমার ভাললাগার তালিকায় ঢুকে পড়েছিল ১৯৮৩-র বিশ্বকাপেই। ভারত সে বার প্রথম বিশ্বকাপ জিতল। কপিল দেবের সেই হাসি মুখ আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। আসলে, ১৯৮৩-র আগে আমি ক্রিকেটটা সে ভাবে বুঝতাম না।

এর পর ক্রিকেটের বই পড়ে পড়ে আমি খেলাটার নিয়মকানুন শিখি। ফিল্ড প্লেসিং, কোন শটকে কী বলে থেকে শুরু করে নানা খুঁটিনাটি রপ্ত হয়। ম্যাচ দেখতে দেখতে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা জন্মায় ধীরে ধীরে। ’৮৩-র ওই কাপ জয়ের পর ’৮৫-তে বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জেতে ভারত। চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়নস হন রবি শাস্ত্রী। ভারতের ক্যাপ্টেন ছিলেন সুনীল গাওস্কর। এই টুর্নামেন্ট জেতার পর তিনি অধিনায়কত্ব ছাড়েন। ভারত পরে হিরো কাপও জিতেছিল।

এই সব দেখতে দেখতে দিন কাটছিল। তবে, ২০০৩-এ বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতের হারাটা বিরাট দুঃখ দিয়েছিল আমায়। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে আমাদের দলের হারটা ধীরে ধীরে বেশ একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠছিল। মনে হত, ভারতীয় দলের খেলা দেখব, অথচ হার দেখে দুঃখও পাব, এটা হয় না। মানিয়ে নিতে হবে।

এ বারের বিশ্বকাপের কথায় ফিরি। এ বার বেশ কয়েকটা ম্যাচ দেখে ফেললাম। পর পর ছ’টা ম্যাচ জিতে ভারতের মনোভাব একেবারে তুঙ্গে। দেখতে দেখতে শেষ আটের চূড়ান্ত লড়াই দেখার পর্যায়ে পৌঁছে গেলাম।

এই লড়াইয়ের কথা উঠলেই আমার হেরে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। আমরা প্রত্যেকেই তো হেরে যাই। হেরে যাওয়ার মধ্যেই তো লুকিয়ে থাকে পরবর্তী জয়ের স্তম্ভ! আসলে কি জানেন, নিজের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের হারের সঙ্গে আমাদের টিমের হারটাকে মেলাই। আমি আসলে হেরে যাওয়া, একা মানুষের সঙ্গে ভীষণ নৈকট্য বোধ করি। বোধ হয়, একা একা থাকাটাও একটা সেলিব্রেশন। একাকীত্বের সেলিব্রেশন! পরের লড়াইটার জন্য ওই সেলিব্রেশনটাও ভীষণ জরুরি বলে মনে হয়।

মনে পড়ে গেল, আগের বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন আমাদের শো ছিল কল্যাণীতে। ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি ছিল শ্রীলঙ্কা। ঠিক করে ফেললাম, খেলাটা দেখেই যেতে হবে। না হলে চলবে না। বসে পড়লাম টিভির সামনে। ভারতের জয় দেখে রওনা হলাম কল্যাণীর উদ্দেশে। পথে প্রচুর জায়গায় নানা সেলিব্রেশন দেখতে দেখতে গেলাম সে বার। দারুণ এক অভিজ্ঞতা!

এ বার অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলা হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনেও হচ্ছে, গেলে বেশ হত! মজাই লাগে। দু’বছর আগে ৪ জুলাই লাস ভেগাসে পৌঁছই। সে দিন আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। সে বার ওখানে এক ভিন্ন ধরনের উন্মাদনার সাক্ষী হয়েছিলাম। তবে, সেই উন্মাদনার সঙ্গে আমি ক্রিকেটের উন্মাদনাকে মেলাতে চাই না। সিডনিতেও এর আগে গিয়েছি অনুষ্ঠানের জন্য। প্রকৃতি সেখানে অনাবিল, অকৃপণ। বড় আনন্দ পেয়েছি ওখানে গিয়ে। কার্ডিফেও গিয়েছি। তবে, শ্রীলঙ্কা আর অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসামান্য। অনেক পশু-পাখিও দেখা যায় ওখানে। অস্ট্রেলিয়ায় আরও একটা জিনিস দারুণ! ক্রিকেট মাঠের ধারে অনেকটা সবুজ। ওখানে বসে খেলাটা চমৎকার উপভোগ করা যায়।

‘ফসিলস’ও তো খেলাপাগল! ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে আমরা অ্যালবামও করেছি। আইপিএল-এ ইডেন গার্ডেন্সে কেকেআর-এর উদ্বোধনী ম্যাচের আগে ‘ফসিলস’ গান গেয়েছিল।

আর এখন যখন টিভির সামনে বসি ক্রিকেট দেখতে, ফাস্ট বোলারের দুর্মর ছুটে আসা, শ্বাপদের মতো মাঠ জুড়ে ফিল্ডারদের ওঁত পেতে থাকা, চরাচর কাঁপানো গ্যালারির চিৎকার ছাপিয়েও আমার চোখ চলে যায় ক্রিজে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানের দিকে! বাইশ গজে এই মুহূর্তে ওই লোকটা একা, সম্পূর্ণ একা! যা কিছু করার, যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তাকে সেই মুহূর্তে একাই নিতে হবে! যদি সে জয়ী হয়, ভাল। তার থেকেও আরও ভাল তার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটা। আর সে যখন আউট হয়ে মাথাটা নিচু করে প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরছে, সে সময়টায় আমি তার সঙ্গে সব থেকে একাত্ম বোধ করি। ভীষণ ভাবে ‘রিলেট’ করি তার সঙ্গে। ভাবি, এ বারে পারলাম না, পরের বার নিশ্চয় আবার চেষ্টা করব! আমি আসলে ওই লড়াকু, হেরে যাওয়া মানুষটার পাশে পাশেই হাঁটছি।

এ শুধু আমার ক্রিকেটীয় দর্শন নয়! জীবনেরও দর্শন!

rupam islam cricket
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy