আনুমানিক ১৩০০-১৭০০ সালের কথা। গোটা গোটা পাথর খোদাই করে প্রকাণ্ড মুখের মূর্তি তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপে গেলে আজও এগুলি দেখা যায়। আবক্ষ ওই মূর্তিগুলির স্রষ্টা সেখানে বসবাসকারী প্রাচীন রাপা নুই জনগোষ্ঠী। এত দিন ধরে প্রচলিত ধারণা ছিল, রাপা নুই জনগোষ্ঠী মিলিত উদ্যোগেই এই মূর্তিগুলি তৈরি করেছিল। সেই ধারণা এ বার ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্ট একটি দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ড। আয়তন প্রায় ১৬৩ বর্গকিলোমিটার। চিলের মূল ভূখণ্ড থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে বিশাল পাথরের বিশাল মূর্তি। কী ভাবে এগুলি তৈরি হয়েছে, তা আজও এক বিস্ময়। স্থানীয়েরা এগুলিকে বলেন, মোয়াই। ইস্টার দ্বীপে এমন প্রায় এক হাজারটি প্রস্তর মূর্তি রয়েছে। গড়ে ১৩ ফুট উঁচু, ওজন প্রায় সাড়ে ১২ টন। কোনও কোনও মূর্তির ওজন আবার ২০ টনেরও বেশি।
প্রাচীন কালে কী ভাবে এই মূর্তিগুলি তৈরি হয়েছে, তা নিয়েও দীর্ঘ সময় বিস্ময়ই রয়ে গিয়েছিল। তবে এখন স্পষ্ট, এর ভাস্কর্যগুলির নেপথ্যে রয়েছে রাপা নুইয়েরা। এই জনগোষ্ঠী কবে থেকে ইস্টার দ্বীপে বাস করছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। অনুমান করা হয়, ৩০০-১২০০ সালের মধ্যে এই দ্বীপে বসতি গড়ে তুলেছিল রাপা নুই গোষ্ঠী। ইস্টার দ্বীপে এখনও এই জনগোষ্ঠীর বাস রয়েছে। চিলের ২০১৭ সালের জনগণনা অনুসারে, ইস্টার দ্বীপের ৪৫ শতাংশ বাসিন্দাই রাপা নুই। সেই গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা এই প্রকাণ্ড প্রস্তর মূর্তিগুলি তৈরি করেছিলেন এককালে।
রাপা নুই গোষ্ঠী এবং মোয়াই নিয়ে অতীতেও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ধারণা অনুসারে, রাপা নুই গোষ্ঠী মিলিত উদ্যোগে সংগঠিত ভাবে মোয়াইগুলি তৈরি করেছিল। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, এগুলি মোটেই মিলিত উদ্যোগে তৈরি হয়নি। রাপা নুই গোষ্ঠী অতীতে বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত ছিল। ওই ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলি আলাদা ভাবে তৈরি করেছে মূর্তিগুলি।
নিউ ইয়র্কের বিংহ্যামটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কার্ল লিপোর নেতৃত্বে একটি দল সম্প্রতি ইস্টার দ্বীপেই এই মূর্তিগুলি নিয়ে গবেষণা করে। তারা এই দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে ড্রোন উড়িয়ে প্রায় ১১ হাজার ছবি সংগ্রহ করে। ওই ছবিগুলির মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক দল একটি ত্রিমাত্রিক (থ্রি-ডি) মডেল তৈরি করে। তাতে বিভিন্ন স্থানে অসমাপ্ত মোয়াইয়ের ছবি ধরা পড়েছে। তা বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, অর্ধর্নিমিত মূর্তিগুলিতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য রয়েছে। দু’টি ভিন্ন জায়গায় কাজের নমুনার মধ্যেও অমিল রয়েছে। গত বুধবার প্লাস ওয়ান জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন:
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ত্রিমাত্রিক মডেলে অন্তত ৩০টি পৃথক এলাকাকে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে মূর্তিগুলি খোদাই করা হত। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, একটি এলাকার সঙ্গে অন্য এলাকায় পাথর কাটা বা মূর্তি খোদাইয়ের কাজে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ, এই মোয়াই তৈরির কাজ কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত হত না। প্রতিটি এলাকায় স্বতন্ত্র ভাবে মূর্তিগুলি তৈরি করা হত। এর থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, রাপা নুই জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ কোনও সমাজে বাস করত না। বরং, ছোট ছোট কিছু গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বাস করত তারা।
ইস্টার দ্বীপে ত্রিমাত্রিক মডেলের মাধ্যমে ৪২৬টি অসমাপ্ত মোয়াইয়ের ছবি ধরা পড়েছে। যেগুলি খোদাই করতে করতে মাঝ পর্যায়েই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আরও দেখা গিয়েছে, পাথরের গায়ে গর্ত করে ৩৪১টি ব্লক তৈরি হয়েছিল মূর্তি খোদাইয়ের জন্য। সেগুলিতে পরে আর খোদাই শুরু হয়নি। এ ছাড়া পাথরের গায়ে ১৩৩টি ফাঁকা জায়গাও দেখা গিয়েছে। সম্ভবত মূর্তি কেটে সেগুলি সরিয়ে নেওয়ার ফলে ওই ফাঁকা জায়গাগুলি তৈরি হয়েছে।
এখনও পর্যন্ত যে মোয়াইগুলির খোঁজ মিলেছে, সেগুলির গড় ওজন প্রায় সাড়ে ১২ টন। কোনওটির ওজন ২০ টনের আশপাশেও রয়েছে। মূর্তির গড় উচ্চতা প্রায় ১৩ ফুট। তবে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বড় মোয়াইটি অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে। গবেষকদলের প্রধান লিপোর মতে, এই মূর্তিটির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এটিই হত ইস্টার দ্বীপের সবচেয়ে বড় মোয়াই। অসমাপ্ত ওই মূর্তিটি লম্বায় প্রায় ৬৯ ফুট এবং এটি সম্পূর্ণ হলে ওজন হত প্রায় ২৭০ টন। বস্তুত, এই মূর্তিগুলি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে তা সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হত। লিপোর কথায়, “অন্যত্র সরানোর ক্ষেত্রে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে কিছু মূর্তি। আমার অনুমান, (রাপা নুইদের) বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে বড় আকারের মোয়াই তৈরির চেষ্টা হত। তবে এই অসমাপ্ত কাজগুলি তাদের সীমাবদ্ধতাকেই ইঙ্গিত করে।”