আপনি দৌড়তে দৌড়তে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে দেখলেন, শেষ মেট্রো ঠিক দশ সেকেন্ড আগে বেরিয়ে গিয়েছে। মেট্রো স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ি অনুযায়ী, ঠিক সময়েই ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে। কিন্তু আপনার মোবাইলের ঘড়ি বলছে, শেষ মেট্রো ছাড়তে তখনও পাঁচ সেকেন্ড বাকি।
আপনাকে কলেজে ভর্তির ফি সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে জমা করতে হবে। আপনি নিজের মোবাইল থেকে ৫টা ৫৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে টাকা জমা করে দিলেন। কিন্তু কলেজের পোর্টাল জানাল, ঠিক সময়ে টাকা জমা পড়েনি। কলেজের পোর্টাল অনুযায়ী, টাকা জমা পড়েছে সন্ধ্যা ৬টার ৫ সেকেন্ড পরে।
সবই চলছে ভারতীয় সময় বা ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ মেনে। ‘গ্রিনিচ মিন টাইম’ বা জিএমটি-র থেকে এই ভারতীয় সময়ের ফারাক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার। কিন্তু সব মোবাইল, কম্পিউটারের ঘড়িতে একই সময় দেখাচ্ছে না। কিছু সেকেন্ডের হলেও ফারাক থেকেই যাচ্ছে। কারণ, মোবাইলের পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা বা কম্পিউটারের ইন্টারনেট পরিষেবা সংস্থা বিভিন্ন জায়গা থেকে সময় নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই মোবাইল বা কম্পিউটারে যে সময় দেখাচ্ছে, তা বিভিন্ন দেশের জিপিএস ঠিক করে দিচ্ছে। ফলে কয়েক সেকেন্ডের হলেও ফারাক থাকছে। তা হলে কোনটা ঠিক সময়?
এই সমস্যার সমাধানে এ বার কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ম জারি করে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করতে চলছে। খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে বিধিনিয়ম জারি হবে। মোদী সরকারের মন্ত্র হল, ‘এক দেশ, এক সময়’। ২০২৫-এর লিগাল মেট্রোলজি (ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম) বিধিনিয়ম মেনে সমস্ত বাণিজ্যিক, ডিজিটাল, আইনি ও প্রশাসনিক কাজের জন্য একটাই সময় ব্যবহার করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘দুর্ঘটনা এড়িয়ে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে এই নিখুঁত সময়ের হিসেব খুবই জরুরি। আমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার পরে তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।’’
কোনটা ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ বা সঠিক ভারতীয় সময়, তা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় উপভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রক, সিএসআইআর (কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ)-এর দিল্লি স্থিত ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো হাত মেলাচ্ছে। আমদাবাদ, ফরিদাবাদ, গুয়াহাটি, ভুবনেশ্বর, বেঙ্গালুরু— দেশের পাঁচটি রিজিয়োনাল রেফারেন্স স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিতে পরমাণু ঘড়ি বসানো হয়েছে। পরমাণুর কম্পাঙ্ক অনুযায়ী এই ঘড়িতে সময় নির্ধারিত হয়। ১০ কোটি বছরে মাত্র এক সেকেন্ডের তারতম্য হয়ে থাকে। তাই প্রতিটি মিলি, মাইক্রো বা ন্যানো সেকেন্ডেরও নির্ভুল হিসেব রাখা যায় এই ঘড়িতে। এক একটি ল্যাবরেটরিতে চারটি করে পরমাণু ঘড়ি বসানো হয়েছে। রাশিয়া থেকে আনা এই ঘড়িগুলির দাম প্রায় এক কোটি টাকা। পাঁচটি ল্যাবরেটরি থেকে দিল্লির ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে সঠিক ভারতীয় সময়ের তথ্য আসবে। সেখান থেকেই সমস্ত মোবাইল, কম্পিউটার, বিদ্যুৎ গ্রিড, শেয়ার বাজার, ব্যাঙ্ক, বিমানবন্দরে ‘নেটওয়ার্ক টাইম প্রোটোকল’ ও ‘প্রিসিশন টাইম প্রোটোকল’ কাজে লাগিয়ে মিলিসেকেন্ড থেকে মাইক্রোসেকেন্ডের সময়ের হিসেব পৌঁছে যাবে। আজ এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মহলের সঙ্গে বৈঠকের পরে কেন্দ্রীয় উপভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীর নাটকীয় মন্তব্য, ‘‘ভারতের সময় এসে গিয়েছে। ভারতের সময় এ বার শুরু হবে।’’
ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির মুখ্য বৈজ্ঞানিক ও টাইম ফ্রিকোয়েন্সি বিভাগের প্রধান আশিস আগরওয়াল বলেন, ‘‘কারগিল যুদ্ধের সময়ে সামরিক বাহিনীর হামলার জন্য নির্দিষ্ট অবস্থান ও সময় জানার প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু তখন বিদেশি কৃত্রিম উপগ্রহের উপরে নির্ভরতা টের পাওয়া যায়। তার পরে দেশীয় প্রযুক্তিগত সমাধান খোঁজা শুরু হয়। সে জন্য ভারতে তৈরি কৃত্রিম উপগ্রহ কাজে লাগিয়ে ‘নাবিক’ (নেভিগেশন উইথ ইন্ডিয়ান কনস্টেলেশন) ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। ভারতে তৈরি পরমাণু ঘড়ি উপগ্রহে করে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। আমেরিকার জিপিএস ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ভারতের এই নাবিক ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। এ জন্য সাতটি কৃত্রিম উপগ্রহ প্রয়োজন। চারটি চলে গিয়েছে। আরও তিনটি মহাকাশে পাঠানো হবে।’’
আগরওয়ালের ব্যাখ্যা, এই ‘নাবিক’ ব্যবস্থার জন্যও নিখুঁত সময়ের হিসেব প্রয়োজন। তা হলেই মোবাইলের দিকনির্ণায়ক ম্যাপে নির্দিষ্ট সময়, অবস্থান বোঝা যাবে। উত্তর ভারতে বিদ্যুতের গ্রিড ভেঙে পড়া, বিভিন্ন সময়ে শেয়ার বাজারে কারচুপির ক্ষেত্রে ‘এক দেশ, এক সময়’-এর প্রয়োজন বোঝা গিয়েছে। কারণ, সেখানে প্রতিটি মিলি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় উপভোক্তা সচিব নিধি খারে বলেন, ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে সময় নিয়ে ব্যবসায়িক সংস্থা, ব্যাঙ্কের মধ্যে বিবাদ হয়। শেয়ার বাজারে লেনদেনে কয়েক সেকেন্ডের তারতম্যে অনেক টাকার লাভ-ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
গোটা ভারতে একটাই ‘টাইম জ়োন’। পূর্ব ভারতের অরুণাচলে সূর্যোদয় হয় পশ্চিম ভারতের পঞ্জাবের আধ ঘণ্টা আগে। যদিও ঘড়ির কাঁটায় অরুণাচল প্রদেশে যখন সকাল ছ’টা, তখন পঞ্জাবেও সকাল ছ’টা হওয়ার কথা। কিন্তু এত দিন এক এক ঘড়ি এক এক সময় দেখাচ্ছিল। আর তা হবে না। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এই নির্দিষ্ট ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ মেনে কাজ হচ্ছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)