২২ ফেব্রুয়ারি, ১৪৯৮। ইউরোপে বসে ক্রিস্টোফার কলম্বাস লিখেছিলেন, ইটালির জেনোয়া শহরে আমার যে সম্পত্তি রয়েছে, তা আমার পরিবারের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। কারণ ‘আমি এখান থেকে এসেছি এবং এখানেই জন্মেছি’। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন, কলম্বাসের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে উদ্ভূত যাবতীয় বিতর্কের ইতি ঘটা উচিত এখানেই। কারণ এটা তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি। তবে কেউ কেউ এই মন্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের ধারণা, যা দেখা যাচ্ছে, তার সবটা সত্যি না-ও হতে পারে। হয়তো কলম্বাসের জন্মবৃত্তান্তের নেপথ্যে এখনও কোনও রহস্য গোপন থেকে গিয়েছে। সম্প্রতি ডিএনএ পরীক্ষাতেও তার ইঙ্গিত মিলেছে বলে দাবি করেছেন একদল বিজ্ঞানী।
ইতিহাস বলছে, কলম্বাস ইটালীয় নাবিক যিনি নতুন নতুন আবিষ্কার করতে ভালবাসতেন। সেই আবিষ্কারের নেশাতেই পঞ্চদশ শতকে ইউরোপ থেকে জাহাজ নিয়ে তিনি বেরিয়ে প়ড়েছিলেন অজানার উদ্দেশে। লক্ষ্য ছিল পূর্বের চিন এবং ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছোনোর সংক্ষিপ্ত রাস্তা আবিষ্কার। এর জন্য পূর্বে না গিয়ে তিনি পশ্চিমে জাহাজের মুখ ঘুরিয়েছিলেন। খোঁজ পেয়েছিলেন সম্পূর্ণ নতুন মহাদেশ আমেরিকার। স্পেনের ইউনিভার্সিটি অফ গ্রানাডার বিজ্ঞানী তথা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অ্যান্টোনিয়ো লরেন্টের নেতৃত্বাধীন একটি দল সম্প্রতি দাবি করেছে, আমেরিকার ‘আবিষ্কর্তা’ কলম্বাস আদৌ ইটালীয় বংশোদ্ভূত নন। বরং তিনি জন্মেছিলেন স্পেনে, কোনও ইহুদি বংশে। কয়েক দশক ধরে গবেষণা করে তাঁরা এই ফল পেয়েছেন বলে দাবি লরেন্টের।
আরও পড়ুন:
স্পেনের একটি টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কলম্বাস সম্পর্কে নতুন গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরেন বিজ্ঞানীরা। দাবি, কলম্বাসের পুত্র দিয়েগো এবং ফার্দিনান্দের দেহাবশেষ থেকে তাঁরা ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ওয়াই ক্রোমোজ়োম এবং মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, তা সেফার্ডিক ইহুদিদের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। পর্তুগাল এবং স্পেনের ইহুদিরা সেফার্ডিক নামে পরিচিত। স্প্যানিশদের সঙ্গে কলম্বাসের ডিএনএ যোগ রয়েছে বলে দাবি করেন লরেন্টেরা।
যদি লরেন্টেদের দাবি সত্যিও হয়, সে ক্ষেত্রেও কলম্বাসের জন্মস্থান হিসাবে ইটালির জেনোয়ার নাম একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইউরোপের অন্য কোনও শহরের নামও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ, পঞ্চদশ শতকের একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্পেন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার ধুম পড়েছিল। অনেক ইহুদি পরিবার তখন ইটালিতে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে তা ঘটে কলম্বাসের জন্মের অনেক পরে। কী ভাবে ১৪৫০-এর দশকে কোনও সেফার্ডিক ইহুদি জেনোয়ায় জন্মগ্রহণ করলেন, তা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা প্রশ্ন তুলেছেন।
লরেন্টে এবং তাঁর দলের গবেষণার নিয়ে যাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাঁদের প্রধান অভিযোগ, লরেন্টেরা ওই টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বক্তব্যের সপক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাননি। ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। কোন ডিএনএ কী ভাবে বিশ্লেষণ করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলেন, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তাই অনেকেই এর সত্যতা মানতে নারাজ।
ইতিহাসের তথ্য বলছে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস নামে এক জন ১৪৫১ সালের অগস্ট থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি কোনও সময়ে ইটালির জেনোয়া শহরে জন্মেছিলেন। আঞ্চলিক উচ্চারণে তাঁর নাম ক্রিস্টোফোরো কলাম্বো। যৌবনে তিনি পর্তুগালের লিসবনে চলে যান। জলপথে পূর্ব দিকে যাওয়ার জন্য পশ্চিম হয়ে একটি ‘শর্টকাট’ আবিষ্কারের ইচ্ছা ছিল ওই যুবকের। তার জন্য ধনী কোনও পৃষ্ঠপোষকের খোঁজ করছিলেন পর্তুগালে। এই তথ্যেই অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ভরসা রাখেন। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন নথিকেই এখন ফরেন্সিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তা সফলও হচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।