ঈশ্বর বিশ্বাস করি না, তবে সুন্দরের পূজা করি। বুধবার কলকাতায় এ কথা বললেন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ডেভিড গ্রস।
পদার্থবিদ্যা দেখিয়েছে, ব্রহ্মাণ্ড জটিল গণিত নির্ভর করে চলে। যে গণিত শিখতে বা বুঝতে কালঘাম ছুটে যায় পণ্ডিতদের, তা দেখেও কি মনে হয় না ব্রহ্মাণ্ড রচনার পিছনে কাজ করে কোনও সূক্ষ্ম মেধা?
প্রশ্ন শুনে একটুও ভাবলেন না গ্রস। বললেন, ‘‘না। জটিল গণিত ইঙ্গিত দেয় অসীম সৌন্দর্যের, শুধু তাকে চেনার চোখ চাই। সুন্দরের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞানী বিস্মিত হন বটে, কিন্তু তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাসী হন না। আর কাকে ঈশ্বর বলবেন, সেটাও তো পরিষ্কার হওয়া দরকার।’’
গ্রস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পরমাণুর কেন্দ্রে বসে থাকা প্রোটন আর নিউট্রন কণার উপাদান কোয়ার্ক-এর চরিত্র উদ্ঘাটন করে। নিজে বিশ্বাস করেন, স্ট্রিং থিওরি— ব্রহ্মাণ্ড চালনার মূলে একমেবাদ্বিতীয়ম সূত্র— এক দিন আবিষ্কৃত হবেই। সেই রকম এক সূত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। চেষ্টা করেছিলেন তা আবিষ্কারেরও, কিন্তু সফল হননি। মহাবিজ্ঞানীর সেই অধরা স্বপ্ন এখনও তাড়া করে ফেরে পদার্থবিদ্যার রথী-মহারথীদের। গ্রস দাবি করেন, ওই স্বপ্ন এক দিন পূরণ হবেই।
কিন্তু স্ট্রিং থিওরি যে এখন বলছে ব্রহ্মাণ্ড একটা নয়, অগুনতি (ইউনিভার্স নয়, মাল্টিভার্স)? একদল বিজ্ঞানী যে বলছেন, হয় ভগবান মানো, অথবা বিশ্বাস করো একের বদলে বহু ব্রহ্মাণ্ডে? কতগুলো ব্রহ্মাণ্ড? ১-এর পরে ৫০০টা শূন্য বসালে যে সংখ্যা হয়, তত?
অতগুলি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মাত্র একটা হল আমাদের এই বিশ্ব। তবে কি বলা যায়, স্ট্রিং থিওরি ব্যর্থ?
গ্রস: ‘‘মোটেই না। স্ট্রিং থিওরি নিয়ে নিরাশ হওয়ার সময় এখনও আসেনি। আসলে সমস্যা হল, স্ট্রিং থিওরির হাতে কাজ শুরু করার মতো তথ্য কম। একটা জরুরি তথ্য হতে পারত, এই ব্রহ্মাণ্ড শুরুর সময়কালীন পরিস্থিতি। তা তো আমরা জানি না, এমনকী গবেষণাগারে তৈরিও করতে পারব না। এ দিকে আমরা যে সব তত্ত্ব নিয়ে এর আগে কাজ করেছি, যেমন ধরুন নিউট্রন-প্রোটনের উপাদান কোয়ার্ক নিয়ে, তাতে আমাদের হাতে ছিল জোরদার তথ্য। যেমন কোয়ার্ক ক’রকমের, তাদের চার্জ কত ইত্যাদি। স্ট্রিং থিওরির বেলায় তেমন সব তথ্য গবেষকদের হাতে নেই।’’
স্ট্রিং থিওরির নিন্দুকেরা ওই তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন এই যুক্তিতে যে, সুন্দর গণিত-নির্ভর হলেও তত্ত্ব যে সঠিক, তা প্রমাণের উপযোগী পরীক্ষা সাজানো যাচ্ছে না। পরীক্ষা করতে গেলে এমন পেল্লায় যন্ত্র লাগবে, যার আকার হবে সৌরমণ্ডলের মতো বড়। সমালোচনাকে পাত্তা দিলেন না গ্রস। বললেন, ‘‘সেটা তো ওই তত্ত্ব এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তার জন্য। কে বলতে পারে আগামিকালই স্ট্রিং থিওরি এমন পরীক্ষার সুলুক-সন্ধান দেবে না, যা করা যাবে ছোট্ট গবেষণাগারে?’’
বিজ্ঞানীকে স্মরণ করানো হল নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেই ওঁর এক সাক্ষাৎকার। গ্রস পুরস্কার পেয়েছিলেন দুই ছাত্র ডেভিড পোলিৎজার এবং ফ্র্যাঙ্ক উইলচেক-এর সঙ্গে। একই সাক্ষাৎকারে উইলচেক জানিয়েছিলেন, গবেষণায় সাফল্যের পরেই তিনি জানতেন, নোবেল পাবেনই। আর গ্রস বলেছিলেন, গবেষণায় সাফল্যের পরে নয়, তিনি অপেক্ষা করেছিলেন পরীক্ষায় তত্ত্বের সমর্থন মেলা পর্যন্ত। তা হলে তো তিনি পরীক্ষামূলক প্রমাণের অন্ধ ভক্ত? গ্রস বললেন, ‘‘অবশ্যই। তত্ত্ব হতে পারে অনেক, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনটা ঠিক, তা বলে দেয় পরীক্ষা। সুতরাং এটা বলতেই পারেন যে, পরীক্ষায় সত্যি প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের স্ট্রিং থিওরির মুখ চেয়ে বসে থাকতেই হবে।’’
গ্রস কলকাতায় এসেছেন মণি ভৌমিক এডুকেশন্যাল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে। ফাউন্ডেশনের তরফে দক্ষিণ কলকাতার এক হোটেলে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করানো হয় ওই প্রতিষ্ঠানের তরফে সাহায্যপ্রাপ্ত তিন দুঃস্থ ও কৃতী ছাত্রকে, যাঁরা এখন চিকিৎসক এবং অধ্যাপক। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গ্রসের স্ত্রী জ্যাকলিন সাভানি এবং মণি ভৌমিক।