Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Science

একটানা না পড়লেই পড়া বেশি ভাল হয় কেন

পড়তে পড়তে খেলো। ভিডিও ফিল্ম দেখো। গান শোনো। গেমস খেলো। কিন্তু সেটাও খেলাচ্ছলে নয়। মন দিয়ে একটু খেলো, গান শোনো, ভিডিও ফিল্ম দেখো। তা হলেই ‘কেল্লা ফতে’!

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২০:৩২
Share: Save:

পড়তে পড়তে খেলো। ভিডিও ফিল্ম দেখো। গান শোনো। গেম্‌স খেলো। কিন্তু সেটাও খেলাচ্ছলে নয়। মন দিয়ে একটু খেলো, গান শোনো, ভিডিও ফিল্ম দেখো। তা হলেই ‘কেল্লা ফতে’!

একটানা পড়ো না। ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে একা একা দুলে দুলে মুখস্থ কোর না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শুধু বইয়ের মধ্যেই চোখ দু’টোকে বেঁধে রেখো না। তা হলে, যা পড়েছো, সব কিছুই চট করে ভুলে যাবে। পরীক্ষায় প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা কিছুতেই মাথায় আসতে চাইবে না। রেজাল্ট ভাল হবে না।

তার চেয়ে বরং পড়তে পড়তে একটু উঠে গিয়ে একটু খেলে এসো। কিছুটা সময় ডুব দাও ভিডিও গেমে। একটু গান শোনো। মনোযোগ দিয়ে। তা বলে আবার গান আর ভিডিও গেমে পুরোপুরি ডুবে যেও না। মনে রেখো, একটু ভিডিও গেম খেলে আর গান শুনেই আবার বইয়ে ফিরতে হবে। বাকিটা মুখস্থ করতে হবে। আগের মুখস্থ করা অংশটা ঝালিয়ে নিতে হবে। তা হলেই দেখবে, বাকি পড়াটা ঝটপট মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে। তা অনেক বেশি দিন মনে থাকছে। পরীক্ষার সময় প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা দ্রুত মনে পড়ছে। রেজাল্টও খুব ভাল হচ্ছে।


রবার্ট গ্রিন (ডান দিকে) ও অ্যালেক্স সোনেবর্ন

পড়তে পড়তে খেলা, পড়ার ফাঁকে উঠে গিয়ে গান শোনা আর ভিডিও গেম খেলাটাই পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার সেরা উপায় বলে জানাচ্ছে নিউরো-সায়েন্সের একেবারে হালের গবেষণা। সেই গবেষণা এও জানাচ্ছে, পড়ার ফাঁকে উঠে গিয়ে ভিডিও গেম খেললে বা গান শুনলে আর সেই সবই খেলাচ্ছলে না করে গভীর মনোযোগ দিয়ে করলে আমাদের স্মৃতিশক্তি হঠাৎ করেই অনেকটা বেড়ে যায়।

তার মানে, পড়ার মাঝে কিছুটা সময় খেলাধুলো বা ‘এন্টারটেনমেন্টের ব্রেক’টাই আমার, আপনার সন্তানের স্মৃতিশক্তিকে দ্রুত অনেকটা বাড়িয়ে তুলবে। আমরা সকলেই জানি, মস্তিষ্কে থাকা একটি বিশেষ রাসায়নিক ‘ডোপামাইন’ই আমাদের স্মৃতিশক্তির মূল চালিকা শক্তি। মস্তিষ্কে ওই রাসায়নিক ‘ডোপামাইন’-এর ক্ষরণের জন্যই আমরা মুখস্থ করতে পারি, কোনও কিছু মনে রাখতে পারি, বহু দিন পর সেই সব ঘটনা মনে করতে পারি। হালের গবেষণা জানাল, পড়ার ফাঁকে মাঝে-মধ্যেই উঠে গিয়ে একটু খেলে এলে বা ভিডিওয় ছোট্ট একটা সিনেমা দেখে এলে মস্তিষ্কে হঠাৎ করেই দ্রুত বেড়ে যায় ‘ডোপামাইন’ রাসায়নিকের ক্ষরণ। আর তার ফলে যে পড়াটা কিছু ক্ষণ আগেও মুখস্থ করতে গিয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছিল, সেটা ঝটপট মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে।


মস্তিষ্কে ‘ডোপামাইন’ ক্ষরণের চিহ্ন (লাল বা কমলা রং)

মস্তিষ্কে ডোপামাইনের চলার পথ (নীল রং) ও কাজকর্ম


মস্তিষ্কের যে সব জায়গায় মেলে ডোপামাইনের হদিশ

শুধু শিশুদের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের যে কোনও বয়সেই এটা সত্যি। ধরুন, কোনও কোম্পানির সিইও-কে তাঁর অফিসে গিয়ে অধস্তন কর্মীদের জাগিয়ে তোলার জন্য একটা লম্বা-চওড়া ভাষণ দিতে হবে। তাই অফিসে যাওয়ার আগে বাড়িতে লেখা সেই স্ক্রিপ্টটা তিনি বার বার পড়ছেন, মুখস্থ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই সেটা মুখস্থ হচ্ছে না। সেই সিইও তখন তাঁর বাড়ির লনে গিয়ে একটু টেনিস খেলে এলেন। আর তার পর বাড়িতে ফিরে সেই পুরনো স্ক্রিপ্টটায় চোখ বোলাতেই দেখলেন, তা ঝটপট মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, ওই টেনিস খেলার ‘ব্রেক’টাই ওই সিইও-র মস্তিষ্কে ‘ডোপামাইন’-এর ক্ষরণটা দ্রুত অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে, তাঁর স্মৃতিশক্তি হঠাৎই অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।


মস্তিষ্কে ডোপামাইনের ক্ষরণ (সবুজ রং)

স্মৃতিশক্তির ‘প্রেরণা’টা আদতে জোগায় কে, তাঁকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করার এই সাড়াজাগানো গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। গবেষণাপত্রটির নাম- ‘লোকাস সেরুলাস অ্যান্ড ডোপামিনার্জিক কনসলিডেশন অফ এভরি’ডে মেমোরি’। ব্রিটেনের ‘ইউটি সাউথ ওয়েস্টার্ন মেডিক্যাল সেন্টার’-এর নিউরো-সায়েন্স ও সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট গ্রিনের নেতৃত্বে ওই গবেষকদলে রয়েছেন এক জন বাঙালি নিউরো-সায়েন্টিস্টও। দেবযানী ঘটক। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো-সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক।

কী কী ভাবে মস্তিষ্কে ডোপামাইনের ক্ষরণ হয় বা তার পরিমাণ বাড়ে?


কেমন দেখতে হয় ডোপামাইনের অণু

গবেষকদের কাজের অভিনবত্বটা কোথায়?
দেবযানী বলছেন, ‘‘এটা অনেকেরই জানা ছিল, ‘ডোপামাইন’ আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। কিন্তু কোথায় তার উৎপত্তি আর কী ভাবেই-বা ‘ডোপামাইন’ বাড়িয়ে তোলে আমাদের স্মৃতিশক্তি, সেটা এত দিন জানা ছিল না। আমরা গবেষণায় দেখেছি, ‘ডোপামাইন’ বেরিয়ে আসে মস্তিষ্কের ‘লোকাস সেরুলাস’ (এলসি) অংশটি থেকে। যে কোনও ভাবে যদি মস্তিষ্কের সেই অংশটিকে উত্তেজিত বা উদ্দীপিত করা যায়, তা হলে সেখান থেকে হঠাৎই দ্রুত অনেক বেশি পরিমাণে বেরিয়ে আসে রাসায়নিক ‘ডোপামাইন’। আর তা ওই সময়ের ঘটনা বা ছবি অনেক তাড়াতাড়ি মনে রাখতে তো সাহায্য করেই, অনেক দিন পরেও যাতে সেই ঘটনা বা ছবি মনে থাকে, তাতেও সাহায্য করে। আর সেই উত্তেজিত বা উদ্দীপিত করার কাজটা ভাল ভাবে হয় তখনই, যখন খেলা বা গান শোনার মতো তুলনায় হাল্কা কোনও কাজ খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও, আমরা বেশ মন দিয়ে করি। মানে, একটা কাজ থেকে বের করে এনে কিছু ক্ষণের জন্য মস্তিষ্কটাকে অন্য কাজে ডুবিয়ে রাখলে, আগের কাজটা মনে রাখাটা বেশি সহজ হয়ে যায়। এটা আগে কখনও প্রমাণিত হয়নি।’’


মস্তিষ্কের ডোপামাইন (সবুজ রং)

পড়তে পড়তে খেলা শুধুই যে ঝটপট করে পড়া মুখস্থ করে ফেলতে সাহায্য করে, তা-ই নয়, সেই পড়ার সময় আশপাশের অন্য ঘটনাগুলিকেও অনেক বেশি দিন মনে রাখতে সাহায্য করে। মানে, বহু দিন পরেও মনে পড়ে যাবে, সেই কবে মন দিয়ে পড়ার সময় মা এক গ্লাস হরলিক্স নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন। হরলিক্স নিয়ে মায়ের ঘরে ঢোকার ঘটনা তুলনায় খুবই গৌঁণ হলেও, স্মৃতি থেকে সেটা হারিয়ে যায়নি। কারণ, সেই সময় পড়তে পড়তে খেলার ফলে ‘ডোপামাইনে’র ক্ষরণ অনেক বেশি হয়েছিল আর তার ফলে তা আশপাশের অনেক গৌণ ঘটনাকেও অনেক বেশি ধরে মনে রাখতে সাহায্য করেছে।


ডোপামাইন ও ডোপামাইন রিসেপ্টর

দেবযানীর কথায়, ‘‘যদি ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়ার ঘটনার ছবি দেখার সময় কোনও ভাবে আমাদের মস্তিষ্কে ‘ডোপামাইনে’র ক্ষরণ কিছুটা বেশি হয়ে থাকে, তা হলে এখনও সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে মনে পড়ে যাবে সেই সময় আমরা ঠিক কী করছিলাম, বাড়ির কে পিছন থেকে এসে জামা ধরে টেনেছিলেন বা মা ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলে চেঁচাচ্ছিলেন, এমন সব গৌণ ঘটনাও। তার মানে, খুব অবাক করা কোনও ঘটনাও আমাদের মস্তিষ্কে বড় ঝাঁকুনি দিতে পারে। যাতে বেশি করে ক্ষরণ হয় ‘ডোপামাইনে’র। আর তাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়ার ঘটনার অত দিন পরেও তার আগে-পরের গৌঁণ ঘটনাগুলিও আমরা ভুলে যেতে পারিনি।’’


ডোপামাইনের চলার পথ ও তার কাজকর্ম

২০১২ সালেই একটি গবেষণায় প্রথম দেখা গিয়েছিল, মস্তিষ্কের মূলত তিনটি জায়গা থেকে ‘ডোপামাইন’ বেরিয়ে আসে। একটি ‘ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া’, দ্বিতীয়টি ‘সাবস্টানসিয়া নাইগ্রা’ আর তিন নম্বর জায়গাটি হল- ‘লোকাস সেরুলাস’। ‘অ্যাম্ফিটামিন’ নামে একটি ওষুধও ‘ডোপামাইন’-এর ক্ষরণ বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু সদ্য আবিষ্কৃত প্রক্রিয়াটি একেবারেই প্রাকৃতিক। মস্তিষ্কের নিজের নিয়মেই সেটা হয়।


ডোপামাইন ক্ষরণের জায়গা (সবুজ রং)

এ ব্যাপারে কী ভাবে নিশ্চিত হলেন গবেষকরা?

মূল গবেষক রবার্ট গ্রিন আর অ্যালেক্স সোনেবর্ন তাঁদের গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন, ‘‘১২০টি ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ বার মানুষের মস্তিষ্কেও এটি পরীক্ষা করে দেখা হবে খুব শীঘ্রই। তবে মানব মস্তিষ্কে তার কোনও ব্যাতিক্রম হবে বলে আমাদের মনে হয় না।’’

ছবি সৌজন্যে: দেবযানী ঘটক, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন- শুধু হার্ট-ফুসফুসই নয়, মস্তিষ্কেও থাবা বসাচ্ছে দূষণের বিষকণা!

স্মার্টফোনের ক্যামেরায় জেনে নেওয়া যাবে আমার, আপনার স্পার্ম কাউন্ট!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE