Advertisement
E-Paper

যেন অবতার! এই প্রথম গ্যালাক্সির প্রকাণ্ড জ্যোতির্বলয়ের হদিস পেল নাসা

দেখা গেল, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির চেয়ে আকারে অন্তত দু’গুণ বড় এমন একটি গ্যালাক্সির, যা আমাদের পার্থিব জগতের চেনা-জানা ‘অবতার’দের মতোই।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২০ ১৩:৩৮
অ্যান্ড্রোমিডার সেই জ্যোতির্বলয়। ছবি সৌজন্যে: নাসা।

অ্যান্ড্রোমিডার সেই জ্যোতির্বলয়। ছবি সৌজন্যে: নাসা।

এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘পাড়ার পাশের বাড়ির সদস্য’ও আমাদের আত্মারই আত্মীয়! এই প্রথম জানা গেল, সেই পড়শির সঙ্গেও রয়েছে আমাদের প্রায় ১৩০০ কোটি বছরের সম্পর্ক!

দেখা গেল, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির চেয়ে আকারে অন্তত দু’গুণ বড় এমন একটি গ্যালাক্সি, যা আমাদের পার্থিব জগতের চেনা-জানা ‘অবতার’দের মতোই। সেই গ্যালাক্সির চার পাশেও আছে সুবিশাল জ্যোতির্বলয় অর্থাৎ ‘হেলো’। এ-ও জানা গেল, আমাদের গ্যালাক্সির অনেকটাই ছোট জ্যোতির্বলয়ের সঙ্গে সবচেয়ে কাছে থাকা পড়শি গ্যালাক্সির জ্যোতির্বলয়ের ‘কোলাকুলি’ শুরু হয়ে গিয়েছে হাজার কোটি বছর আগেই।

দুই পড়শি: মিল্কি ওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা

আমাদের সবচেয়ে কাছে থাকা সেই গ্যালাক্সিটির নাম ‘অ্যান্ড্রোমিডা’। যার অন্য নাম ‘এম-৩১’। আকারে তা অনেকটাই বড়। আমাদের মিল্কি ওয়েতে তারার সংখ্যা যেখানে বড়জোর ৮০ হাজার কোটি, সেখানে অ্যান্ড্রোমিডায় তারার সংখ্যা কম করে দেড় লক্ষ কোটি। আকারে অনেক বড় বলে অ্যান্ড্রোমিডার অভিকর্ষ বলের টান অনেক বেশি জোরালো। সেই টানেই অ্যান্ড্রোমিডার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের মিল্কি ওয়ে। যার পরিণতিতে সাড়ে ৪০০ কোটি বছর পর অ্যান্ড্রোমিডার সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হবে মিল্কি ওয়ের। দু’টি গ্যালক্সিই তাতে চুরমার হয়ে যাবে।

‘হেলো’র হদিস পেল নাসার হাব্‌ল

নাসার হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ (এইচএসটি) সুবিশাল জ্যোতির্বলয়ের সন্ধান পেয়েছে এই অ্যান্ড্রোমিডারই চতুর্দিকে। এই প্রথম দেখা গেল, সেই সুবিশাল জ্যোতির্বলয়ের আছে দু’টি স্তর। একটি ভিতরের। অন্যটি বাইরের। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ। এই জ্যোতির্বলয়টি আকারে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির ১৫ থেকে ২০ গুণ।

কেন সহজে দেখা যায় না জ্যোতির্বলয়?

তুলনায় আকারে অনেক গুণ ছোট হলেও এমন জ্যোতির্বলয় আছে আমাদের মিল্কি ওয়েরও। কিন্তু বাড়ির ভিতরে থাকলে আমরা যেমন গোটা বাড়িটাকে দেখতে পাই না, ঠিক তেমনই আমরা মিল্কি ওয়ের বাসিন্দারা দেখতে পাই না আমাদের গ্যালাক্সির জ্যোতির্বলয়টিকে।

জ্যোতির্বলয় আছে ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের পাড়ায় (‘লোকাল গ্যালাক্সি ক্লাস্টার’) থাকা ৫৪টি গ্যালাক্সিরই। আছে অন্য গ্যালাক্সি ক্লাস্টারগুলিতে থাকা গ্যালাক্সিগুলিরও।

কিন্তু সেগুলি আমাদের থেকে এত দূরে রয়েছে যে, তাদের জ্যোতির্বলয় দেখা সম্ভব হয়নি এত দিন। অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের একেবারে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী আর তা আকারে প্রকাণ্ড বলেই এই প্রথম কোনও গ্যালাক্সির ‘অবতারত্ব’-এর প্রমাণ মিলল।

মিল্কি ওয়ের জ্যোতির্বলয়ের সঙ্গে ‘কোলাকুলি’

গবেষকরা জানিয়েছেন, এই জ্যোতির্বলয়টি এতটাই বিশাল যে, তা অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে মহাকাশে ১৩ লক্ষ আলোকবর্ষ (আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে) পর্যন্ত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। যা অ্যান্ড্রোমিডা থেকে আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি যতটা দূরত্বে (২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ), তার অর্ধেক। কোনও কোনও দিকে অ্যন্ড্রোমিডার সেই প্রকাণ্ড জ্যোতির্বলয় ছড়িয়ে পড়েছে আরও বড় এলাকা জুড়ে, কম করে ২০ লক্ষ বর্গ আলোকবর্ষ এলাকায়।

মূল গবেষক অধ্যাপক নিকোলাস লেনার (বাঁ দিকে), মতামতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী।

গবেষকদের মতে, এতটা দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে বলে এটা ধরেই নেওয়া যায় আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির জ্যোতির্বলয়ের সঙ্গে অ্যান্ড্রোমিডার জ্যোতির্বলয়ের ‘কোলাকুলি’ও শুরু হয়ে গিয়েছে।

আত্মার আত্মীয়তায় জড়িয়ে মিল্কি ওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডা

কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘অভিনবত্ব এখানেই, যা আগে কখনও দেখা সম্ভব হয়নি, কোনও গ্যালাক্সির সেই দ্বি-স্তরের জ্যোতির্বলয়ের হদিস মিলল এই প্রথম। এও জানা গেল, আমাদের সবচেয়ে কাছের হলেও ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে থাকা অ্যান্ড্রোমিডা শুধুই আমাদের পড়শি নয়, তার সঙ্গে রয়েছে আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির আত্মার সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কটা নতুন নয়। হাজার কোটি বছরেরও বেশি পুরনো।’’

সন্দীপের রসিকতা, ‘‘এখন যেখানে আমরা পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরও খবর রাখি না, বিপদে-আপদে এগিয়ে আসি না, তখন অ্যান্ড্রোমিডা আর মিল্কি ওয়ের এই আত্মার আত্মীয়তা যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ।’’

পাঁচ বছর আগে-পরে

মূল গবেষক আমেরিকার ইন্ডিয়ানাপোলিসে নোত্রে দাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিকোলাস লেনার জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আগে ২০১৫-য় প্রথম হদিস মিলেছিল অ্যান্ড্রোমিডার জ্যোতির্বলয়ের ভিতরের এই অংশটির। অ্যান্ড্রোমিডার কেন্দ্রস্থল থেকে মহাকাশে যা ৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এ বার সেই জ্যোতির্বলয়ের বাইরের অংশটির দেখা মিলল। যা আরও ৪ গুণ (সর্বাধিক ২০ লক্ষ আলোকবর্ষ) দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে মহাকাশে।

কী ভাবে তৈরি হল দ্বি-স্তর জ্যোতির্বলয়ের?

সন্দীপ জানাচ্ছেন, প্রতিটি গ্যালাক্সিরই এমন জ্যোতির্বলয় থাকে। আর সেগুলির দ্বি-স্তর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, যে কোনও গ্যালাক্সিতেই প্রতি মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ তারার মৃত্যু হচ্ছে। সেই মৃত্যুদশায় তারাগুলিতে হয় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। যাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘সুপারনোভা’। সুপারনোভা হলেই তারাদের অন্দরে থাকা লোহা, কোবাল্ট, নিকেল-সহ ভারী ধাতুগুলি ছিটকে বেরিয়ে আসে। প্রচণ্ড উত্তাপে তারা পৌঁছে যায় গ্যাসীয় অবস্থায়। তারাই ছিটকে বেরিয়ে তৈরি করে গ্যালাক্সির জ্যোতির্বলয়। সেটা আদতে জ্যোতির্বলয়ের ভিতরের অংশটি। এসকেপ ভেলোসিটি থাকে না বলে সেই গ্যাসের মেঘ গ্যালাক্সিকে ছেড়ে মহাকাশে খুব দূরে ছড়িয়ো পড়তে পারে না। আর জ্যোতির্বলয়ের বাইরের অংশটি তৈরি হয় কোনও গ্যালাক্সির জন্মের সময়। যে গ্যাসীয় পদার্থ দিয়ে গ্যালাক্সি তৈরি হচ্ছে, তার মেঘই আদতে জ্যোতির্বলয়ের বাইরের অংশটি। এই জ্যোতির্বলয়টিকে যদি আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা সম্ভব হত, তা হলে আমাদের আকাশের ৪৫ থেকে ৬০ ডিগ্রি জুড়ে ছড়িয়ে থাকত। আমাদের আকাশে একক ভাবে সেটাই হত কোনও মহাজাগতিক কাঠামো।

প্রকাণ্ড জ্যোতির্বলয়টিকে দেখা সম্ভব হল কী ভাবে?

সন্দীপ বলছেন, ‘‘খানিকটা কপালগুণে বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। কারণ, এই জ্যোতির্বলয় কোনও আলো বিকিরণ করে না। তাই তাকে চট করে দেখা মুশকিল। এ বার মহাকাশের বিভিন্ন দিকের ৪৪টি কোয়াসারকে ওই জ্যোতির্বলয় দিয়ে দেখা গিয়েছিল। দেখা যায়, জ্যোতির্বলয়ের বিভিন্ন দিক থেকে কোয়াসারগুলির আলো নানা রকম ভাবে কমে যাচ্ছে। তার ফলে, জ্যোতির্বলয়ের একটা ত্রিমাত্রিক ছবি পাওয়া গিয়েছে। যা আকারে আদতে গোটা অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির ১৫ থেকে ২০ গুণ।’’

ছবি সৌজন্যে: নাসা।

Milky Way Galaxy Killing Stone Sessho-seki NASA Lock Upp
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy