বিদ্যুৎশক্তি ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। তার চাহিদাও বিপুল। তাই বিদ্যুতের নিত্যনতুন উৎসের সন্ধানে বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলতেই থাকে। অনেক দিন ধরেই তাঁরা বিদ্যুতের উৎস হিসাবে পৃথিবীর নিজস্ব অক্ষ এবং ঘূর্ণন গতিকে কাজে লাগানোর কথা ভাবছিলেন। একাংশের বক্তব্য ছিল, বিদ্যুৎশক্তির অত্যন্ত কার্যকরী উৎস হতে পারে পৃথিবীর নিজস্ব গতি। কিন্তু তার পথে একটিই বাধা রয়েছে। পদার্থবিদ্যার সূক্ষ্ম তত্ত্বে এত দিনে সেই হিসাব মেলালেন বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষামূলক ভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিকে কাজে লাগিয়ে টেনে বার করলেন বিদ্যুৎ!
আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী নিউ জার্সিতে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার পরীক্ষাগারে পৃথিবীর আহ্নিক বা আবর্তন গতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই গতি এবং পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র আগামী দিনে অফুরন্ত বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠতে পারে, গবেষণার ফলাফলে মিলেছে সেই ইঙ্গিত। নতুন যন্ত্র দিয়ে তাঁরা পরীক্ষাগারে উৎপন্ন করেছেন কয়েক লক্ষ মাইক্রোভোল্ট বিদ্যুৎ। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ ক্রিস্টোফার এফ চাইবা। তড়িৎচৌম্বকীয় তত্ত্ব কী ভাবে শক্তি এবং গ্রহের ঘূর্ণনের সঙ্গে যুক্ত, তা গবেষণায় দেখিয়েছেন তিনি। যদি এই গবেষণা সফল হয় এবং আগামী দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্রিয় ভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণনকে কাজে লাগানো যায়, তবে বিশ্বের ভবিষ্যৎ বদলে যাবে। শক্তির উৎসে সৃষ্টি হবে বিপ্লব।
আরও পড়ুন:
পৃথিবী আসলে একটি ভূ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা আবৃত। বহির্ত্বকের ধাতব গতিবিধি এই চুম্বকের আবরণ তৈরি করেছে। পৃথিবী যখন নিজের কাল্পনিক অক্ষের চারপাশে ঘোরে, চুম্বক-ক্ষেত্র মোটের উপরে স্থির থাকে। পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত কোনও পরিবাহী এই ক্ষেত্রের উপর দিয়ে বিনা বাধায় বয়ে যেতে পারে। তবু সাধারণ উপায় এখানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়া সম্ভব নয়। পদার্থবিদ্যার স্বাভাবিক সূত্র বলে, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পরিবাহী দ্বারা সামান্যতম বিদ্যুৎ উৎপন্ন হলেও তা ইলেক্ট্রনের গতিবিধির কারণে তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু এই সূত্রেই একটি ফাঁক খুঁজে বার করেছেন ক্রিস্টোফারেরা। তার মাধ্যমেই সাফল্য এসেছে।
গবেষকদের বক্তব্য, একটি বিশেষ আকারের পরিবাহী যদি পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সংস্পর্শে আসে, তবে ইলেক্ট্রনের গতিবিধি এড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। খাতায়কলমে হিসাব মেলানোর পর এই তত্ত্বটি পরীক্ষাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশেষ আকারের পরিবাহী হিসাবে ব্যবহার করা হয় একটি ফাঁকা, ফাঁপা সিলিন্ডার। এক ফুটের এই সিলিন্ডার তৈরি করা হয় ম্যাঙ্গানিজ় জ়িঙ্ক ফেরাইট দিয়ে। ম্যাঙ্গানিজ় জ়িঙ্ক ফেরাইট বিদ্যুতের দুর্বল পরিবাহী হলেও চৌম্বকক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয়।
আরও পড়ুন:
সিলিন্ডারটিকে উত্তর-দক্ষিণমুখী রেখে ৫৭ ডিগ্রি বাঁকিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ঠিক যে ভাবে বেঁকে আছে পৃথিবীর নিজস্ব কাল্পনিক অক্ষ। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে উভয় দিকের ইলেক্ট্রোডের মাধ্যমে অনবরত সিলিন্ডারের দুই মুখে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে। সেই ভোল্টেজ পরিমাপও করা গিয়েছে। একই পরীক্ষায় ম্যাঙ্গানিজ় জ়িঙ্ক ফেরাইটে তৈরি ভর্তি সিলিন্ডার ব্যবহার করে দেখেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। কোনও বিদ্যুৎই উৎপন্ন হয়নি।
কৃত্রিম ভাবে আমেরিকার পরীক্ষাগারে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিকে কাজে লাগিয়ে যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা গিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী চাহিদার মুখে অতি নগন্য। আগামী দিনে পরীক্ষাগারের বাইরে এই পদ্ধতিতে যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন যাবে, তার নিশ্চয়তাও মেলেনি। তবে মার্কিন গবেষকেরা নতুন যন্ত্র তৈরি করে পথ দেখিয়েছেন। এই পথে যদি এগোনো যায়, তবে বিপ্লব তৈরি হবে। বিদ্যুতের জন্য আর চিন্তাই করতে হবে না। বর্তমানে সূর্য, জল, বাতাস, জোয়ার-ভাটা প্রভৃতি অনেক প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে পৃথিবীর ঘূর্ণনকে কাজে লাগানো গেলে যত দিন এই গ্রহের অস্তিত্ব থাকবে, তত দিন বিদ্যুতের অভাব হবে না।