ঘটনা ১
নতুন চাকরির প্রথম মাসের মাইনেটা সদ্য হাতে এসেছে। এ বার একটা নতুন ফোন কিনবে কৌশিক। বহু দিনের শখ একটা বেশ ‘জমাটি’ ফোন কেনার। বড় ডিসপ্লে, তুখোড় ক্যামেরা, প্রসারিত স্মৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখ চাই বেশি ক্ষণ ছোটার মতো ব্যাটারির ক্ষমতাও। অনলাইনে-অফলাইনে বহু গবেষণার পর বোঝা গেল এই সব কিছুই পাওয়া যাবে পকেটকে বেশি না চটিয়েই। সব থেকে বেশি টানল ফোনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেনসরের সুবিধাটি। একই মডেল হওয়া সত্ত্বেও এই অতিরিক্ত সুবিধাটি পেতে কড়কড়ে হাজার টাকা গুণতে হল বেশি। তবু আঙুল ছাপের সুরক্ষা বলে কথা! মোটে হেলাফেলা নয়।
ঘটনা ২
আগের ফোনটা চুরি যাওয়ার পর হিয়ারও নজর ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেনসরযুক্ত ফোনের দিকেই। এক-দু’হাজার টাকা বেশি দিতে হলেও কুছ পরোয়া নেহি। আগের বার সাধের ফোনটি খোয়া যাওয়ার পর ফোনের শোক ছাপিয়ে মাথা চাড়া দিয়েছিল সুপ্ত ‘টেনশন’। সৌম্যের সঙ্গে মন্দারমণিতে তোলা ঘনিষ্ঠ সমস্ত ছবিই যে রয়েছে ফোনের মধ্যে! শুধু তাই নয়, হস্টেলের বন্ধুদের সঙ্গেও বেশ কিছু খোলামেলা ছবি রয়েছে। ডিলিট করব, করব করেও আর হয়ে ওঠেনি। এ দিকে ফোনের সুরক্ষা বলতে মামুলি একটা পাসওয়ার্ড। হিয়া শুনেছে, পাসওয়ার্ড ভাঙা হ্যাকারদের বাঁ হাতের খেল। বেশ কয়েকটা দিন চাপা দুশ্চিন্তার পর অবশ্য আস্তে আস্তে কেটে গিয়েছিল ভয়টা। তবু এ বার আর কোনও ‘রিস্ক’ নিতে চায় না হিয়া।
আরও পড়ুন: হ্যাকারদের থেকে কী ভাবে সুরক্ষিত রাখবেন মোবাইল? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কৌশিক আর হিয়া কেউ কাউকে চেনে না। তবু ওরা বিচ্ছিন্ন নয়। টেকস্যাভি জেন ওয়াইয়ের দুনিয়ায় কোথাও একটা মিলে গিয়েছে ওরা দু’জন। মিলে গিয়েছে আরও একটা উদ্বেগের চেনা ছকের গণ্ডিতে। সম্প্রতি একটি খবরে ওদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তবে কী ফোনের তথ্য সুরক্ষিত করার শেষ উপায়টাও এ বার হাতছাড়া? সদ্য প্রকাশিত সেই খবরে কিন্তু আশঙ্কাটা বাড়ছে বই কমছে না। সেই খবর থেকেই জানা গিয়েছে, ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষা করতে অপারগ ‘অত্যাধুনিক’ ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারও।
আরও পড়ুন: থাম্ব বা ভিক্ট্রি সাইন দেখিয়ে সেলফি তোলেন? বিপদে পড়ে যেতে পারেন কিন্তু
থাম্বস আপ ও ভিক্ট্রি চিহ্ন দেখিয়ে সেলফি তোলা নাকি জাপানিদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। আর সেটাই এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাপানের নিরাপত্তা আধিকারিকদের মধ্যে। দেখা গিয়েছে, থাম্বস আপ বা ভিক্ট্রি চিহ্নের সেলফি বা গ্রুপফি আজকালকার হাই রেজোলিউশন যুক্ত ক্যামেরার সৌজন্যে এতটাই পরিষ্কার হয় যে, সেখান থেকে নাকি আঙুলের ছাপ চুরি যাচ্ছে হামেশাই। শুধু তাই নয়, খোয়া যাওয়া ফোন থেকেও সহজেই হ্যাকাররা সংগ্রহ করছে আঙুলের ছাপ। তা থেকে বানানো হচ্ছে নকল ফিঙ্গার প্রিন্টও। আর এতেই কেল্লা ফতে! ব্যক্তিগত তথ্য নিমেষে হাটের মাঝে। বেবাক বনে যাচ্ছে কৌশিক-হিয়ারা।
আসলে মোবাইলের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা যে রকম ভাবি, বিষয়টা ঠিক তার উল্টো। তথ্যকে সুরক্ষা দিতে বেশির ভাগ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞই হেলছেন পাসওয়ার্ডের দিকে। আধুনিক মোবাইলে সাধারণত তিন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। পাসওয়ার্ড লক, প্যাটার্ন লক ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক। এর মধ্যে পাসওয়ার্ডের দিকেই ভোট দিয়েছেন বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ। সুরক্ষা দিতে ‘ফার্স্ট বয়’ পাসওয়ার্ড হলে দু’নম্বরে থাকবে ফিঙ্গার প্রিন্ট। আর তিন নম্বরে থাকবে প্যাটার্ন লক। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, পাসওয়ার্ডের ক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভাবনা আমরা ব্যবহার করতে পারি ততটা অন্য দু’ধরনের ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব। পাসওয়ার্ড যত বড় ও জটিল হবে ততই তা শক্তিশালী হবে।
পাসওয়ার্ডের ক্ষেত্রে A-Z, a-z , 0-9 এবং নানা রকম চিহ্ন মিলিয়ে কি-বোর্ড থেকে মোট ৯০ ধরনের অক্ষর ব্যবহার করতে পারি আমরা।
এর চেয়েও বড় পাসওয়ার্ড দিলে সম্ভাবনা বাড়বে আরও কয়েক ধাপ। ৬ অক্ষরের হলে ৫৩১,৪৪১,০০০,০০০ ধরনের সম্ভাবনা থাকবে।
অন্য দিকে প্যাটার্নের ক্ষেত্রে চৌহদ্দিটা অনেকটাই সীমিত। এক্ষেত্রে ‘অপশন’ মাত্র ৯টি বিন্দু। একটি বিন্দু দু’বার ব্যবহার করা যায় না।
৬ বিন্দু দিয়ে করলে সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়াবে ৬০,৪৮০। সহজ হিসেব বলছে এই সম্ভাবনা পাসওয়ার্ডের সম্ভাবনার তুলনায় অনেকটাই কম।
পড়ে রইল ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা বায়োমেট্রিক। এটা ঠিকই যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই অনন্য। ফলে তা অন্য কারও সঙ্গে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপের স্থান সবার উপরে। কিন্তু চিন্তার বিষয় এখানেই। আঙুলের ছাপের নকল তৈরি আজকাল আকছার ঘটছে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যে কোনও ফোটোগ্রাফ থেকে তো বটেই, খোয়া যাওয়া ফোনের ‘বডি’ থেকেই সংগ্রহ করা সম্ভব ব্যবহারকারীর আঙুলের ছাপ। আর সেই ছাপ থেকেই নানান আধুনিক প্রযুক্তিতে তা নকলও করা যাচ্ছে।
অন্য দিকে, ফোনের প্রতিটি অ্যাপ্লিকেশনের জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড তৈরি করা সম্ভব। সেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিন্তু সব অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে একই। পাশাপাশি, ফোন খোয়া যাওয়ার পরেও পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করা গেলেও, ফিঙ্গারপ্রিন্ট কখনওই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ফলে একবার সেটি নকল করতে পারলেই কেল্লা ফতে।
স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটার ফর সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক এভিডেন্স কেস বিভাস চক্রবর্তী জানালেন, পাসওয়ার্ড হোক বা প্যাটার্ন লক, হ্যাকারদের কাছে কোনও লকই ভেঙে ফেলা একেবারে অসম্ভব নয়। তবে কত জলদি সেটা সম্ভব হবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে পাসওয়ার্ডের শক্তির উপর। আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের ক্ষেত্রে যদি আঙুলের ছাপ আগে থেকে হ্যাকারদের হাতে না চলে আসে তা হলে তা ভাঙা খুব সহজ কাজ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy