কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? সন্দীপ চক্রবর্তী (বাঁ দিকে) ও আলোক চট্টোপাধ্যায়।
আলোক এও জানাচ্ছেন, এই প্রযুক্তির সাফল্যের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। প্রচুর খনিজ ও মূল্যবান ধাতুতে ভরা এই সব গ্রহাণুগুলি থেকে আগামী দিনে সেগুলি আমরা কী ভাবে উত্তোলন করব আর সে সব নিয়ে আসতে পারব উত্তরোত্তর প্রাকৃতিক সম্পদ ফুরিয়ে আসা পৃথিবীতে, তার অগ্নিপরীক্ষা হবে এই অভিযানেই। এ ছাড়াও এই গ্রহাণুগুলির রাসায়নিক উপাদান সঠিক ভাবে জানা গেলে সৌরমণ্ডলের সৃষ্টি-কাহিনী আর তার ভবিষ্যতে কী লেখা আছে সেটাও বোঝা যাবে স্পষ্ট ভাবে।
কেন বেন্নু?
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, এই সৌরমণ্ডলে প্রায় ৫ লক্ষ গ্রহাণু রয়েছে। এদের মধ্যে আমরা যেমনটি চাইছি অনেকটা সেই রকম গ্রহাণুই বেন্নু। পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব (যাকে বলা হয় এক ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট’ বা ‘এইউ’), আমাদের থেকে বেন্নু রয়েছে তার চেয়ে সামান্য দূরে। ১.৩ এইউ বা ২০ কোটি কিলোমিটারের কিছু বেশি। সূর্যকে প্রদক্ষিণের সময় যখন বেন্নু আমাদের সবচেয়ে কাছে চলে আসে তখন পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব হয় ৩ লক্ষ কিলোমিটারের মতো। মোটামুটি চাঁদের দূরত্বে। তা ছা়ড়া অন্য গ্রহাণুগুলির কক্ষপথ যতটা পাগলাটে, এর ততটা নয়। বহু বছর আগে দেখা তার কক্ষপথ সে ভাবে বদলে যেতে দেখা যায়নি। ফলে, এদের গতিবিধি আঁচ করাটাও সহজ। তাই বেন্নুতে অবতরণও অন্য গ্রহাণুগুলির তুলনায় সহজ। অনেকের ধারণা, আগামী শতাব্দীতে এই বেন্নুই ধাক্কা মারতে পারে পৃথিবীকে।
সন্দীপের কথায়, ‘‘বেন্নুকে বেছে নেওয়ার আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। তুলনায় আমাদের কাছেপিঠে থাকা ও অনেকটাই কম পাগলাটে কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা গ্রহাণু বেন্নুর মতো আরও অন্তত ২০০টি রয়েছে। তবু বেন্নুকে বেছে নেওয়ার কারণ এর ব্যাস ৫০০ মিটার। বাকিদের চেয়ে বেশি। তাতে মোটামুটি নিরাপদে অবতরণের জায়গা বেছে নিতে মুশকিলটা কম হয়। তবে সবচেয়ে বড় কারণ, বেন্নুতে রয়েছে প্রচুর কার্বন। অনেকটা আমাদের পৃথিবীর মতোই। প্রচুর কার্বনে ভরা যে ৫টি গ্রহাণুর উপর আমরা নজর রেখে চলেছি অবতরণের জন্য, বেন্নু পড়ে তাদের মধ্যেই।’’
আর তাদের মধ্যে বেন্নুই আমাদের সবচেয়ে কাছে বলেই সে আমাদের নজর কেড়েছে, জানাচ্ছেন সন্দীপ।
কেন উপড়ে আনা হচ্ছে বেন্নুর ‘মাংস’?
সন্দীপের বক্তব্য, অনেকগুলি উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা জানতে চাইছি এই গ্রহাণুগুলিতে কোন কোন রাসায়নিক মৌল ও যৌগ রয়েছে? তাদের রাসায়নিক গঠনটা ঠিক কী রকম? সেখানে এমন কোনও জৈব যৌগ রয়েছে কি, যেগুলি সৌরমণ্ডল সৃষ্টির আদিপর্বে তৈরি হয়েছিল? এটাও জানতে চাইছি, বেন্নুর মতো গ্রহাণুগুলিতে কোনও বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে কি না। কারণ, যদি আগামী শতাব্দীতে খুব কাছে এসে পড়ে বেন্নু, ধাক্কাও মারে আমাদের তা হলে কোনও বিষাক্ত পদার্থের নির্গমনে আমাদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে কি না। তাই ওসিরিস-রেক্স মিশন গোটা সভ্যতার পক্ষেই খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ফলাফলও যার সুদূরপ্রসারী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আগের চেষ্টায় ব্যর্থতা, কিছু সাফল্য
আলোক ও সন্দীপ দু’জনেই জানাচ্ছেন, গ্রহাণুতে অবতরণের চেষ্টা আগেও হয়েছিল। তবে সে ভাবে সফল হয়েছে, বলা যায় না। ২০০৩ সালে গ্রহাণু ‘ইতোকাওয়া’য় নামার চেষ্টা করেছিল জাপানের মহাকাশযান ‘হায়াবুসা-১’। বেশ কয়েক বারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। শেষমেশ মাত্র কয়েক মাইক্রোগ্রাম ওজনের ‘মাংস’ উপড়ে আনতে পেরেছিল। যা তেমন কাজে লাগেনি পরিমাণ খুব সামান্য হওয়ায়। পরে জাপানেরই ‘হায়াবুসা-২’ মহাকাশযান অবশ্য আরও দূরে থাকা গ্রহাণু ‘রিউগু’র অংশবিশেষ তুলে আনার চেষ্টা করে। তবে এখনও সেই মহাকাশযান ফিরে আসেনি। তাই তার সাফল্য কতটা, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।
ওসিরিস-রেক্সের দিকেই তাই তাকিয়ে আছে সভ্যতা। তার ভবিষ্যতের ভাবনাটা যে নির্ভর করছে নাসার মহাকাশযানের সাফল্যের উপরেই!
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা।