আজ থেকে প্রায় ১৩-১৪ লক্ষ বছর আগের কথা। আফ্রিকা জুড়ে তখন ঘুরে বেড়াত আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষদের নিকট আত্মীয় ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’রা। বানর এবং মানুষের মাঝামাঝি পর্যায়ের এক প্রাণী বলা যায়। এরা সরাসরি মানুষের পূর্বপুরুষ নয়। তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে এদের। সম্প্রতি কেনিয়ায় খুঁজে পাওয়া এক জীবাশ্ম এই বিলুপ্ত প্রজাতির বিষয়ে ধ্যানধারনাই সম্পূর্ণ বদলে দিল।
এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স)-এর সবচেয়ে প্রাচীন জীবাশ্মটির বয়স প্রায় তিন লক্ষ বছর। ধরে নেওয়া হয়, ওই সময় থেকেই আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। তার আগে মানুষের বিভিন্ন পূর্বপ্রজাতি ঘুরে বেড়াত পৃথিবীতে। যেমন— হোমো ইরেক্টাস, হোমো হাইডেলবার্গেনসিস, হোমো হ্যাবিলিস ইত্যাদি। প্রচলিত ধারণা অনুসারে, কেবলমাত্র আদিমানব (‘হোমো’ গণের বিভিন্ন প্রজাতি)-ই পাথরের অস্ত্র তৈরির কৌশল জানত। কিন্তু সেই ধারণা আদৌ ঠিক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল আদিমানবদের আত্মীয়ের নতুন জীবাশ্ম।
এত দিন পর্যন্ত ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’দের শারীরিক গঠন সম্পর্ক আমাদের কাছে সীমিত তথ্যই ছিল। আদিমানবদের এই আত্মীয়ের প্রথম জীবাশ্ম পাওয়া যায় ১৯৫৯ সালে তানজানিয়ায়। একটি মাথার খুলি পাওয়া যায় সেখানে। পরে তাদের বড় বড় কিছু দাঁতও পাওয়া যায়। এদের মোলার দাঁত (মারির শেষ প্রান্তের চওড়া দাঁত, যা খাবার চিবানোর জন্য ব্যবহার হয়) মানুষের তুলনায় প্রায় চার গুণ। যা থেকে অনুমান করা হয়, শক্ত খাবার চিবিয়ে খেতে পারত আদিমানবের এই আত্মীয়রা। সেই কারণে অনেকে এদের ‘নাটক্র্যাকার হিউম্যান’ও বলে থাকেন। তাদের বড় এবং শক্ত চোয়াল ছিল বলেও অনুমান করা হয়। তবে তাদের শরীরের বাকি অংশ কেমন ছিল, তা নিয়ে এত দিন ধোঁয়াশাই রয়ে গিয়েছিল। সেই ধোঁয়াশা কাটল সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া জীবাশ্মে।
আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে প্রায় ৫১৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে তুর্কানা হ্রদ। এই হ্রদের পূর্ব প্রান্তে কুবি ফোরা নামে একটি জায়গা থেকে পাওয়া গিয়েছে এক প্রাচীন কঙ্কালের অংশ। বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, এই কঙ্কালটি প্রায় ১৫ লক্ষ বছরের পুরনো। অর্থাৎ, ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’রা যে সময়ে আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াত, এই কঙ্কালটিও তার সমসাময়িক। গবেষণায় দেখা যায়, অতীতে আদিমানবের আত্মীয়দের যে মাথার খুলি এবং দাঁত পাওয়া গিয়েছিল, তার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। তা থেকে গবেষকেরা নিশ্চিত, এই কঙ্কালটি ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’রই।
মাথার খুলি এবং দাঁতের নমুনার পাশাপাশি পাওয়া গিয়েছে আদিমানবের আত্মীয়ের হাত এবং পায়ের হাড়ও। যা অতীতে কখনও পাওয়া যায়নি। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, এই কঙ্কালের হাত। এদের হাতের আঙুলের গড়নই জীবাশ্মবিদদের নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছে। হাতের আঙুলের হাড়গুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের বুড়ো আঙুলটি বেশ লম্বা ছিল। কনিষ্ঠাঙ্গুলি বা কড়ে আঙুলটি ছিল অল্প বাঁকা। বাকি আঙুলগুলি সোজা। আঙুলের গড়ন এমন ছিল, যাতে তারা শক্তভাবে কোনও কিছুকে আঁকড়ে ধরতে পারে। আধুনিক মানুষ যে ভাবে হাতুড়ি ধরে, অনেকটা সেই রকম। তবে তাদের আঙুলের চওড়া হাড় এবং অন্য বৈশিষ্টগুলির সঙ্গে গরিলার মিল পাওয়া যায়। নতুন এই খোঁজ থেকে গবেষকেরা নিশ্চিত যে এই প্রজাতি কোনও জিনিসকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারত।
আরও পড়ুন:
সম্প্রতি ‘নেচার’ জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষক দলের প্রধান জীবাশ্মবিদ তথা নিউ ইয়র্কের স্টনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ক্যারি মঙ্গেলের কথায়, “প্যারানথ্রোপাস বোয়েসির হাত-পায়ের হাড়ের গড়ন কেমন ছিল, তা এই প্রথমবার নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে।” জার্মানির লিপজ়িগের ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোলিউশনারি অ্যানথ্রোপলজি’র অধ্যাপক ট্রেসি কিভেলের মতে, হাতের হাড়গুলি থেকে পাওয়া তথ্য ‘বেশ অবাক করে দেওয়ার মতো’। কারণ যে ‘হোমিনিন’ (আধুনিক মানুষ, বিলুপ্ত মানব প্রজাতি এবং তাদের নিকটতম পূর্বপুরুষ)-দের বিষয়ে আমরা জানি, তাদের হাতের সঙ্গে গরিলার হাতের গড়নের এতটা মিল পাওয়া যায়নি। এই জীবাশ্মের আবিষ্কার বিবর্তনের ইতিহাসে হাতের ব্যবহার সম্পর্কে আরও বিশদে গবেষণার দরজা খুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
আরও পড়ুন:
‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’রা যে সময়ে আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াত, ওই সময়ে মানুষের তিন পূর্বপুরুষও আফ্রিকায় বাস করত— হোমো হ্যাবিলিস, হোমো রুডলফেনসিস এবং হোমো ইরেক্টাস। গবেষকদের অনেকেই অনুমান করতেন, পাথরের অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা এক মাত্র ‘হোমো’ গণের প্রজাতিগুলির মধ্যেই সীমিত ছিল। তবে নতুন খুঁজে পাওয়া জীবাশ্ম সেই ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। নতুন জীবাশ্ম থেকে ইঙ্গিত মেলে, ‘হোমো’র পাশাপাশি অন্য গণেরও পাথরের তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার জানার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
গবেষক দলের প্রধান মঙ্গেলের মতে, হাতের হাড় থেকে অনুমান করা যায় আফ্রিকায় সেই সময়ে বসবাসকারী মানুষের পূর্বপুরুষদের মতো এই নিকট আত্মীয়দেরও পাথরের অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা ছিল। যদিও ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’ পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতই, এমন কোনও তথ্য বা প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। গবেষকেরা তেমন দাবিও করেননি। তবে তাঁদের বক্তব্য, পূর্বপুরুষদের ওই আত্মীয়ের শারীরিক গঠন এমন ছিল, যাতে তারা পাথরের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করতে সক্ষম হতেই পারে। এটি নিয়ে নিশ্চিত হতে গেলে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। এর জন্য এমন কোনও জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন, যেটির সঙ্গে পাথরের অস্ত্র রয়েছে। কিংবা এমন একটি জায়গায় থেকে পাথরের প্রাচীন অস্ত্র খুঁজে পাওয়া দরকার, যেখানে শুধুমাত্র এই প্রজাতিরই উপস্থিতি ছিল। না-হলে ‘প্যারানথ্রোপাস বোয়েসি’রা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতই, তা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়।