লাল গ্রহে কি সত্যিই প্রাণ ছিল? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীবের অস্তিত্ব কি ছিল মঙ্গলের মাটিতে? তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে একটি লাল পাথর।
নাসার ‘পার্সিভারেন্স’ রোভার লাল পাথরটি খুঁজে পেয়েছে মঙ্গলের একটি প্রাচীন ক্রেটারের তলদেশ থেকে। সেটি প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করেই নাসার বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, পৃথিবীর পড়শি গ্রহে হয়তো সত্যিই প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।
লাল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বকে এক সময়ে ‘সোনার হরিণ’ বলেই মনে করা শুরু করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনেকে। তাঁদের অনুমান ছিল, লাল গ্রহের পরিবেশ, প্রকৃতি এমনই যে, তাতে প্রাণের বিবর্তন হয়নি কোনও কালে। কিন্তু নাসার মার্স রোভার জেজ়েরো ক্রেটার থেকে যে পাথর খুঁজে এনে দিয়েছে, তাতে ক্ষুদ্র প্রাণের ছাপ মিলেছে।
দীর্ঘ দিন ধরেই মঙ্গলের মাটি ঘেঁটে প্রাণের সন্ধান করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন সময়ে এমন কিছু পাওয়া গিয়েছিল, যা দেখে প্রাথমিক ভাবে ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে লাফিয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁরা আবার হতাশ হয়েছেন। তবে এ বার মঙ্গলে সম্ভাব্য প্রাণের যে ‘প্রমাণ’ মিলেছে, তা সবচেয়ে জোরালো বলেই মনে করা হচ্ছে। ‘নেচার’ পত্রিকায় এই সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জোয়েল হুরোউইটজ়। তিনি জানান, ৩২০ থেকে ৩৮০ কোটি বছর আগে জেজ়েরো ক্রেটারে একটি হ্রদ ছিল। সেখানেই তৈরি হয়েছিল উদ্ধার হওয়া পাথরটি।
আরও পড়ুন:
নাসার অস্থায়ী প্রধান শন ডাফি জানান, ‘পার্সিভারেন্স’ পাথরটির যে ছবি পাঠিয়েছে, তা গত এক বছর ধরে পরীক্ষা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তার পরেই তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এক কালে মঙ্গলে হয়তো সত্যিই প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।
পাথরটির একটি ছবিও প্রকাশ করেছে নাসা। লালচে জং ধরা কাদাপাথরটির গায়ে চিতাবাঘের মতো গোলাকার ছাপ আর পোস্তর দানার মতো দাগ রয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীদের অনুমান, অণুজীবের উপস্থিতিতে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শিলা গঠনের প্রক্রিয়া চলার সময় ওই দাগ তৈরি হয়েছে।
তবে শুধু এটুকু প্রমাণ যে যথেষ্ট নয়, মানছেন বিজ্ঞানীরা। মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব আদৌ ছিল কি না, সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আরও অনেক তথ্য প্রয়োজন।
২০২১ সালে মঙ্গলের মাটিতে পা রেখেছিল ‘পার্সিভারেন্স’। তখন থেকেই উত্তর অংশে জেজ়েরো ক্রেটারে প্রাণের সন্ধান করে চলেছে সে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, একসময়ে নদীর জল ঢুকে এই ক্রেটার হ্রদে পরিণত হয়েছিল। ফলে ধারণা ছিল, সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব মিললেও মিলতে পারে।
তিন বছর ধরে ক্রেটারে খননকার্য চালিয়ে ২০২৪ সালে পাথরের এই নমুনা সংগ্রহ করেছে রোভার। নমুনাটির নাম ‘স্যাফায়ার ক্যানিয়ন’। রোভার নিজে নমুনা পরীক্ষা করতে পারে না। তার কাজ স্রেফ সেটি সংগ্রহ করে একটি টিউবের ভিতরে সংরক্ষণ করা।
কিন্তু কেন এই পাথর নিয়ে এত উল্লসিত বিজ্ঞানীরা? নাসা জানিয়েছে, কাদাপাথরটিতে দু’টি খনিজের অস্তিত্ব মিলেছে। একটি হল, ভিভিয়ানাইট, যা লোহা আর ফসফরাসের মিশ্রণ। দ্বিতীয়টি হল, গ্রেইগাইট, যা লোহা আর সালফারের মিশ্রণে তৈরি। হুরোউইটজ় জানান, সাধারণত কাদার মধ্যে থাকা জৈব পদার্থ এবং রাসায়নিক যৌগের বিক্রিয়ায় এই খনিজগুলি তৈরি হয়। আর এ ধরনের বিক্রিয়ায় অনুঘটকের কাজ করে বিভিন্ন অণুজীব। হয়তো এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল। তিনি বলেন, ‘‘পাথরে জৈব কার্বন, সালফার, ফসফরাস এবং লোহা পাওয়া গিয়েছে। এই ধরনের রাসায়নিক যৌগের মিশ্রণই অণুজীবের বিপাক প্রক্রিয়ার জন্য জরুরি শক্তির উৎস।’’
আরও পড়ুন:
তবে এতেও সন্তুষ্ট নন হুরোউইটজ়। তিনি বলেন, ‘‘আসলে যা প্রমাণ মিলেছে, তা প্রাণের অনুপস্থিতিতে স্রেফ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হতে পারে। ফলে শুধুমাত্র রোভারের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে এটা বলা সম্ভব নয় যে, মঙ্গল প্রাণ ছিল।’’
ফলে যত ক্ষণ না কাদাপাথরের নমুনা পৃথিবীতে আনা হচ্ছে এবং তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, তত ক্ষণ মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কবে মার্স রোভারকে ফিরিয়ে আনা হবে, তার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি নাসার তরফে। ডাফি বলেন, ‘‘কী ভাবে ওই নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা করছি।’’