Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Quantum Entanglement

কোয়ান্টাম এবং কফি

ভুতুড়ে যোগাযোগ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তা-ই নাকি পানীয় ঠান্ডা হওয়ার মূলে কোয়ান্টামের এ হেন এনট্যাংগলমেন্টও মানেননি আইনস্টাইন।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:৩০
Share: Save:

ঠিকই বলেছিলেন আইজ়াক আসিমভ। প্রয়াত কল্পবিজ্ঞান লেখক, যাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে এ বছর। তিনি বলেছিলেন, আজ যা কল্পবিজ্ঞান, কাল তা-ই বিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের লেটেস্ট খবর শুনে আসিমভের মন্তব্য মনে পড়ছে।

খবরটা কী? পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় জার্নাল ‘ফিজিকাল রিভিউ লেটার্স’-এ এক পেপার ছেপেছেন আয়ারল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজের দুই গবেষক মারলন ব্রেনস এবং জন গুল্ড ও ইতালিতে স্কুওলা ইন্টারনাজিয়োনালে সুপিরিয়রে দ্য স্টুডি আভানজাতি-র দুই বিজ্ঞানী সিলভিয়া পাপালার্দি এবং আলেসান্দ্রো সিলভা। চার গবেষক তাত্ত্বিক গণনায় আবিষ্কার করেছেন এক বিচিত্র যোগাযোগ। দেখেছেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে যা তথাকথিত এনট্যাংগলমেন্ট, তা ব্যাখা করতে পারে আমাদের চারপাশের জগতের এক অতিপরিচিত— অথচ অতীব রহস্যময়— এক ব্যাপার। যার বৈজ্ঞানিক নাম থার্মালাইজেশন।

থার্মালাইজেশন কী? এক কথায় চা বা কফি ঠান্ডা হওয়া। গরম ওই সব পানীয় রাখুন। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যাবে। মানে, পানীয় রুম টেম্পারেচারে পৌঁছবে। কেন এমনটা হবে? কেউ জানে না। শুধু জানে, উত্তপ্ত বস্তু তাপ ছেড়ে দিয়ে চারপাশের উষ্ণতায় পৌঁছয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এটাই নিয়ম, এর অন্যথা হয় না কখনও। হয় না বলেই, ওই নিয়মটা নির্ধারণ করছে সময়ের গতি। অতীত থেকে বর্তমান। বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ। আগে গরম কফি রাখলে, এখন তা ঠান্ডা। এখন গরম চা রাখলে, কিছু ক্ষণ পরে তা ঠান্ডা। ধুমায়িত এবং ধোঁয়া-ছাড়া কফিভর্তি কাপ দেখলে আপনি সহজেই বলে দিতে পারবেন, আগে বা পরের সময় কোনটা। এমনই অমোঘ নিয়ম এই থার্মালাইজেশন।

আর এনট্যাংগলমেন্ট? ইংরেজি শব্দটার আভিধানিক অর্থ জড়িয়ে-থাকা। আর, বিজ্ঞানে অতিন্দ্রীয় যোগাযোগ বা গাঁটছড়া। এমট্যাংগলমেন্ট জার্মান শব্দ ভারশ্রানকুং-এর ইংরেজি অনুবাদ। ভারশ্রানকুং এবং এনট্যাংগলমেন্ট শব্দ দুটো প্রথম লেখায় আমদানি করেন অস্ট্রিয়ার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আরউইন শ্রয়েডিংগার। কেন তা আমদানি করেন, সে এক বিচিত্র ইতিহাস! এবং সে ইতিহাস কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। সংক্ষেপে বলা যাক।

প্রথাগত বিজ্ঞান দুই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। রিয়ালিজম আর লোকালিজম। রিয়ালিজম কথাটা ইংরেজি রিয়াল থেকে এসেছে। রিয়ালিজমের অর্থ, কোনও ঘটনা বাস্তবে নিজে থেকে ঘটছে, তা সে শনাক্ত হোক বা না হোক। কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রথাগত বিজ্ঞান নয়, কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্স রিয়ালিজম মানে না। বলে, শনাক্ত না হলে কোনও ঘটনা ঘটে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এ দাবি অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওই দাবি মানেননি স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইনও। তাই বার বার প্রশ্ন তুলেছেন ওই দাবি সম্পর্কে। যেমন, জীবনীকার আব্রাহাম পায়াসকে এক বার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমিও কি বিশ্বাস করো যে, আমি না তাকিয়ে দেখলে (মানে, না শনাক্ত করলে), চাঁদটা আকাশে নেই? অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথনকালে আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত দাবি, আমি না তাকালেও তো অ্যাপোলোর মূর্তি তার জায়গাতেই থাকবে।

লোকালিজম হল প্রথাগত বিজ্ঞানের আর এক ভিত। এর মানে, কোনও কিছুর উপর কেবল স্থানীয় অন্য কিছুর প্রভাব পড়তে পারে। ব্রহ্মাণ্ডের অন্য প্রান্তে কোনও কিছুর প্রভাব পড়তে পারে না। আর, সেই প্রভাবও আবার তৎক্ষণাৎ পড়তে পারে না। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে আবিষ্কৃত তাঁর স্পেশাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটিতে দেখিয়েছিলেন, এই ব্রহ্মাণ্ডে কোনও কিছুর বেগ আলোর গতিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। সেই হিসেবে কোনও প্রভাবও ছুটতে পারে না আলোর চেয়ে বেশি বেগে। প্রভাব এসে পৌঁছতেও সময় লাগে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স লোকালিজম মানে না। বলে, হ্যাঁ, কণায়-কণায় এমন অদ্ভুতুড়ে গাঁটছড়া থাকা সম্ভব, যাতে কণাদুটো যত দূরেই থাক না কেন, এক কণার প্রভাব অন্য কণায় সঙ্গে-সঙ্গে পড়া সম্ভব। দুই কণায় এ রকম গাঁটছড়ার নাম এনট্যাংগলমেন্ট।

কোয়ান্টামের এ হেন এনট্যাংগলমেন্টও মানেননি আইনস্টাইন। মানা কি চাট্টিখানি কথা! তবে, তিনি যেহেতু আইনস্টাইন, না মেনে হাত গুটিয়ে থাকার পাত্র তো তিনি নন। একটা কিছু করতে হবে। করলেন তিনি। ১৯৩৫ সালে। দুই সহযোগী বরিস পোডলস্কি ও নাথান রোজেন-এর সঙ্গে ‘ফিজিকাল রিভিউ’ জার্নালে লিখলেন এক পেপার। ‘ক্যান কোয়ান্টাম মেকানিকাল ডেসক্রিপশন অব ফিজিকাল রিয়ালিটি বি কনসিডার্‌ড কমপ্লিট?’ প্রবন্ধটা ওঁদের উপাধির আদ্যাক্ষরে ইপিআর পেপার নামে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত। প্রবন্ধের উপজীব্য এক কাল্পনিক পরীক্ষা বা গেডাংকেন এক্সপেরিমেন্ট। মানে, যে পরীক্ষা ল্যাবরেটরির বদলে করা হয়েছে কল্পনায়।

বিজ্ঞানের এ ধরনের পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনও দাবি প্রমাণে বা নস্যাতে ও রকম গেডাংকেন এক্সপেরিমেন্টের চল রয়েছে। ইপিআর পেপারে যে কাল্পনিক পরীক্ষা বর্ণনা করা হল, তা নির্যাসে এ রকম: দুটো কণা। একটা আর একটার সঙ্গে এনট্যাংগল্‌ড। কিন্তু তারা বহু দূরে অবস্থিত। এনট্যাংগল্‌ড বলে তাদের একটায় কী পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার খবর অন্যটা পাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। সেটা তো হতে পারে না। সুতরাং, আইনস্টাইন, পোডলস্কি এবং রোজেন-এর সিদ্ধান্ত, কোয়ান্টাম মেকানিক্স বাস্তবের কমপ্লিট বর্ণনা নয়। ইনকমপ্লিট বর্ণনা। মানে, কোথাও ত্রুটি লুকিয়ে আছে কোয়ান্টামের দাবিতে। এনট্যাংগলমেন্ট? বন্ধু ম্যাক্স বর্ন-কে লেখা এক চিঠিতে ওটা নিয়ে আইনস্টাইনের মনোভাব ধরা পড়ল। বললেন, ওটা হল স্পুখাফ্ট ফার্নওয়ার্কুং। বাংলা করলে দাঁড়ায়, দূর থেকে ভূতুড়ে প্রভাব।

তা সে আইনস্টাইন যা-ই বলুন, পরীক্ষা বার বার প্রমাণ করেছে ভূতুড়ে হলেও এনট্যাংগলমেন্ট সত্যি। পরীক্ষা অনেক, তার মধ্যে ইদানিং কালে সবচেয়ে বিখ্যাত সাফল্য নেদারল্যান্ডসের ডেলফ্‌ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী রোনাল্ড হ্যানসেন-এর। জটিল পরীক্ষায় তিনি দেখান, এনট্যাংগলমেন্ট সত্যি ঘটনা।

তা হোক। তবে, এনট্যাংগলমেন্টের সঙ্গে কফি ঠান্ডা হওয়ার কী সম্পর্ক? ‘ফিজিকাল রিভিউ লেটারস’ জার্নালে ওই সম্পর্ক বিশদে ব্যাখা করেছেন আয়ারল্যান্ড ও ইতালির চার বিজ্ঞানী। ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক গুল্ড বলেছেন, এনট্যাংগলমেন্ট নির্ভর করে আগামী দিনে অনেক প্রযুক্তি বাজারে আসছে। বিভিন্ন কোম্পানি ওই প্রযুক্তির পিছনে অর্থ ঢালছে। এনট্যাংগলমেন্ট ব্যবহার করে নতুন নতুন উদ্ভাবনের যেন প্রতিযোগিতা চলছে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে। কোনও কোম্পানি এনট্যাংগলমেন্ট-ব্যবহারকারী ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে, তো অন্য কোম্পানি চাইছে ওটাকে ক্রিপ্টোগ্রাফিতে প্রয়োগ করতে। আমরা চেয়েছি এ সবের মধ্যে এনট্যাংগলমেন্ট ব্যবহার করে তাত্ত্বিক গবেষণা করতে। কফির ঠান্ডা হয়ে যাওয়া একমুখী প্রক্রিয়া। এর উল্টোটা কখনও ঘটে না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে এনট্যাংগলমেন্ট যুক্ত কি-না, তা দেখতে চেয়েছিলাম আমরা।

পুরো গবেষণা হয়েছে গণনার পর্যায়ে। জটিল গণনা। তাই সাহায্য নেওয়া হয়েছে সুপারকম্পিউটারের। ১০০,০০০,০০০,০০০, ০০০, ০০০, ০০০,০০০ অণু নিয়ে কারবার! কম্পিউটারের গণনা ক্ষমতাকেও বাড়াতে হয়েছে অনেক গুণ। গণনা দেখাচ্ছে, গরম কফি ঠান্ডা হয় এনট্যাংগলমেন্টের দৌলতেই।

এত দিন জানা ছিল, বিজ্ঞান নাকি খোঁজে শুধু বিচিত্র যোগাযোগ। তা বলে, কফি ঠান্ডা করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স? ভূতুড়ে যোগাযোগ আর কাকে বলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Quantum Entanglement Quantum Physics Thermalisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE