Advertisement
E-Paper

জনগণেশের খোঁজে বিজ্ঞানী

হকিং-এর লেখা ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ কেন এত জনপ্রিয়? উত্তর খুঁজলেন পথিক গুহ হকিং-এর লেখা ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ কেন এত জনপ্রিয়? উত্তর খুঁজলেন পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৮ ১৯:১১
যাঁদের বিজ্ঞান শিক্ষা নেই সেই আমজনতার জন্যই হকিং লিখেছিলেন  ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’।  ছবি:রয়টার্স।

যাঁদের বিজ্ঞান শিক্ষা নেই সেই আমজনতার জন্যই হকিং লিখেছিলেন ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। ছবি:রয়টার্স।

কোথায় পেলেন বইটা?

ওই প্রথম প্রশ্নে আমাকে অবাক করে দিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। জগদ্বিখ্যাত ওই পদার্থবিজ্ঞানী বড় একটা দেখা করেন না কারও সঙ্গে। সাংবাদিক তো নয়ই। কারণ ওঁর স্ত্রীর মতে, প্রাণান্তকর পরিশ্রমে যাঁকে বাক্যালাপ চালাতে হয় (মূক উনি, কথা বলে ওঁর হয়ে এক কম্পিউটার), তাঁর মোটে সময় নেই আজেবাজে কাজে। দশ মিনিটের সাক্ষাতের অনুমতি মিলেছিল এই অছিলায় যে ওঁর হাতে তুলে দেওয়ার আছে (ওঁকে নিয়ে) সামান্য একটা প্রবন্ধ।

হাতে ছিল ওঁর বইখানা। হ্যাঁ, যা প্রায় রাতারাতি জগদ্বিখ্যাত করেছে ওঁকে। করেছে কিংবদন্তির নায়ক। এতটাই যে, এই মুহূর্তে আধুনিক বিজ্ঞানীকুলে দেবাদিদেব অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পরে উনিই হয়তো সাধারণ্যে সর্বাধিক আলোচিত নাম। চিরুনি-অস্পৃশ্য চুলে আইনস্টাইনের প্রোফাইল যেমন, ঠিক তেমনই পরিচিত হুইলচেয়ারে বসা অথর্ব হকিং। কেমব্রিজে গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর। আসীন সেই চেয়ারে যা একদা অলঙ্কৃত করেছিলেন স্বয়ং নিউটন। ঠাট্টা করে নিজে আরও একটা উত্তরাধিকার ক্রমশ উল্লেখ করেন হকিং। সেটা জন্মসূত্রে। ওঁর জন্মতারিখ ১৯৪২-এর ৮ জানুয়ারি। অর্থাৎ, গ্যালিলিওর ত্রিশততম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে।

ঠাট্টা নয়, গ্যালিলিও, নিউটন এবং অবশ্যই আইনস্টাইনের সার্থক উত্তরসূরী হকিং বিশ্বতত্ত্ব সম্বন্ধে কাজ করেছেন সাঙ্ঘাতিক উঁচু পর্যায়ে। গবেষণার দৌড়ে ব্যাটনখানি হাতে নিয়েছেন আইনস্টাইনের কাছ থেকে। আইনস্টাইন যেমন ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন নিউটনকে, তেমনই তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার বাসনাও বিজ্ঞানী মনে চিরজাগরুক। এ কাজে যাঁরা আগুয়ান, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক জন হলেন স্টিফেন। বিজ্ঞানীদের কাছে তাই উনি রীতিমতো শ্রদ্ধার।

আরও পড়ুন: মুম্বইয়ের সেই সন্ধ্যা, ছাঁইয়া ছাঁইয়ায় দুলে চলেছেন তিনি...

কিন্তু সাধারণ্যে? সেখানে হকিং রীতিমতো ‘মিথ’ ভিন্নতর কারণে। তাঁর পঙ্গুত্ব তাঁকে করেছে মহান। দিয়েছে বিজ্ঞানের রাজ্যে সম্রাটের মর্যাদা। সত্যি বড় করুণ অবস্থা ওঁর। বয়স কুড়ির কোঠায় পা দিতেই ধরেছে অ্যামিওট্রপিক ল্যাটারাল স্কেলরোসিস বা এএলএস। স্নায়ুশক্তি ক্রমশ নিঃশেষের সেই ব্যাধি যার আক্রমণে মৃত্যু নিশ্চিত দু’-তিন বছরের মধ্যে। এই রোগই ছিনিয়ে নিয়েছিল ব্রিটিশ অভিনেতা ডেভিড নিভেনের জীবন। বিশ্ববাসীর সৌভাগ্য, হকিং হারিয়ে যাননি। ওঁর বেলায় রোগের গতি রয়েছে স্থগিত। আর উনি কাজ করে চলেছেন সমানে। এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে মুখের ভাষা। অপারেশ‌নে বাদ গেছে গলার নালি। হাতের কয়েকটা আঙুল ছাড়া চালনা করতে পারেন না কিছুই। খাইয়ে দেন সেবিকা বা স্ত্রী। তা-ও গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। হুইলচেয়ারে জড়বৎ জীবনযাপন। দেহের খাঁচায় বন্দি যখন প্রাণপাখি, তখন মেধা— শুধুই চিন্তা সম্বল করে ওঁর গবেষণা পাড়ি দিচ্ছে মহাবিশ্বের দিগদিগন্ত। খাতার পাতায় একটা আঁচড় কাটার সামর্থ্য নেই যাঁর তাঁর মস্তিষ্ক কি না অঙ্ক কষছে রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টাম মেকানিকসের। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অপার রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানের প্রচেষ্টার এক প্রতিনিধি হকিং। এক দিকে মহাকাশের বিপুল বিস্ময়, অন্য দিকে সীমিত ক্ষমতাধারী মানুষের তাঁর পিছনে ধারণা। এমন মানুষ কিংবদন্তী না হয়ে পারেন!

আরও পড়ুন: বিজ্ঞানের ঈশ্বরকে আমি কাছ থেকে পেয়েছি

মজার কথা, বিজ্ঞানীদের কাছে শ্রদ্ধার এই মানুষটি কিন্তু স্টার হয়েছেন হালফিল। অর্থাৎ, ১৯৮৮ সাল থেকে। উনি যখন ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ লিখেছেন। লেখক উনি বহু কাল। ব্রিটি‌শ বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’-এ প্রবন্ধ লিখেছেন বহু কাল। লিখেছেন বইও। জর্জ এলিসের সঙ্গে ‘দ্য লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেস-টাইম’। কিন্তু সে সব বোদ্ধাদের জন্য। আমজনগণের পাতে দেওয়ার নয়। সে তুলনায় ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ একেবারে নতুন উদ্যম। ওঁর নিজের কথায়: ‘‘এ বই লেখা তাঁদের জন্য যাঁদের কোনও বিজ্ঞান শিক্ষা নেই।’’ ১৯৮৮-র এপ্রিলে বইখানার প্রকাশ একেবারে হইচই ফেলে দেয় রেডিও, টিভি আর পত্রপত্রিকায়। শিরোনামেই প্রকাশ— ‘ফ্রম দ্য বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাক হোলস।’ অর্থাৎ মহা বিস্ফোরণ থেকে অন্ধকূপ পর্যন্ত মহাকাশের জটিল জীবনীর সরল ধারাপাত। তাও আবার ওঁর মতো কুশলী এক জন বিজ্ঞানীর কাছ থেকে। চারিদিকে একেবারে ধন্যি ধন্যি। এবং মিডিয়ার কল্যাণে বইটার নাম লোকের মুখে মুখে। ইউরোপ-আমেরিকার তো বটেই, এমনকী, এই বঙ্গদেশেও। প্রকাশনার মাসখানেকের মধ্যেই কলকাতার বাজারে চলে আসে বইখানা। বাঁধাই সংস্করণ— দাম সওয়া দু’শো টাকা। এর বছরখানেক পরে এক্সপোর্ট এডিশন পেপারব্যাকে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দামে। ও রকমই একখানা বই সঙ্গে ছিল আমার। হকিং বিস্মিত হয়েছিলেন তাই দেখে। জানতে চেয়েছিলেন কোথায় পেয়েছি। কলকাতায় কিনেছি শুনে বললেন, ওঁর জানাই ছিল না যে বইটার পেপারব্যাক সংস্করণও বেরিয়ে গেছে।

হকিং-এর ফ্যাকাশে মুখে হাসির রেখা ফোটে না। তাই ওঁর খুশি সে দিন টের পাইনি চোখেমুখে। তবু অনুমান করে নিতে পারি, গর্ব নিশ্চয়ই সে দিন হচ্ছিল ওঁর। নিজের লেখার পেপারব্যাক সংস্করণ যে কোনও লেখকেরই শ্লাঘার বিষয়। কারণ তা প্রচার সাফল্যের প্রতীক। ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ অবশ্যই বেস্টসেলার। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই না কলম ধরেছিলেন উনি। এয়ারপোর্টের স্টলে সিডনি শেলডন কিংবা টম ক্ল্যান্সির পাশে ওঁর বইও ঠাঁই পাক, এ রকম একটা বাসনা ছিল।

জনপ্রিয় লেখক হতে গিয়েই যে হকিং ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ লিখেছেন তাতে সন্দেহ নেই। ওঁর নিজের কথায় (‘ব্রিফ হিস্ট্রি’র শুরুতে যার উল্লেখ আছে): ‘‘আমি ঠিক করেছিলাম স্থান (স্পেস) আর কাল (টাইম) নিয়ে একটা জনপ্রিয় বই লেখার চেষ্টা করব। মহাবিশ্বের শুরু এবং অন্ধকূপ নিয়ে বেশ কিছু বই আছে। যার তালিকার ভালর দিকে যেমন স্টিভেন ওয়েনবার্গের ‘দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস’, তেমনই খুব খারাপের দিকে কয়েকখানা, যাদের নাম নেব না। যে যা-ই বলুক, আমার কিন্তু মনে হয়েছে যে সব প্রশ্নের তাড়নায় বিশ্বতত্ত্বের অধ্যয়নে আগ্রহী হয়েছি, সেগুলির জবাব ও সব বইতে নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এল কোথা থেকে? কী ভাবে ও কেন এর উৎপত্তি? সব কিছু কি বিনাশ হয়ে যাবে? হলে কী ভাবে? এ সব প্রশ্নে উৎসুক নন এমন কেউ নেই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আজ এতটাই জটিল হয়ে পড়েছে যে মাত্র অল্প কিছু বিশেষজ্ঞই পারেন ও সব বোঝার উপযোগী গণিত আয়ত্ত করতে। অথচ বিশ্বের ভূত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মূল ধারণাগুলো অঙ্ক ছাড়া এমন ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যাতে বিজ্ঞানের তালিম নেই, এমন লোকেও বুঝতে পারেন। এই বইটিতে ওই কাজটিই করা চেষ্টা করেছি আমি।’’ নানা জনের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে গিয়ে হকিং আরও এক জায়গায় লেখার জনপ্রিয়তা অর্জনের ব্যাপারে নিজের আস্থা প্রকাশ করেছেন। ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’-র পাঠকদের ‘দ্য লার্জ স্কেল’ পড়তে মানা করে লিখেছেন, ‘‘আরও বেশি জানার জন্য ও বইটা পড়তে বলব না। কারণ, ওটা রীতিমতো জটিল। আর নিতান্তই অপাঠ্য। আশা করি, এত দিনে আমি শিখে ফেলেছি সহজবোধ্য লেখার কায়দাটা।’’

হ্যাঁ, এক দিকে হকিং-এর দাবি এবং অন্য দিকে মিডিয়ার প্রচার— দুইয়ে মিলে ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ রাতারাতি বেস্টসেলার। বইটা প্রকাশের আগে ‘টাইম’ পত্রিকায় বিজ্ঞান-লেখক এবং একদা ‘ডিসকভার’-এর ম্যানেজিং এডিটর লিওন জ্যারফ লেখেন ‘রোমিং দ্য কসমস’। দু’পৃষ্ঠা জুড়ে মহাকাশের ওই পরিব্রাজকের জীবন জীবিকা এবং ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’-র আগাম ঘোষণা। বইটা বেরনোর পর ‘নিউজউইক’-এর প্রচ্ছদকাহিনিতে লেখা হল, ‘মাস্টার অব দ্য ইউনিভার্স’। তত দিনে হকিং ষোলো আনা স্টার। এয়ারপোর্টের স্টলে ওঁর বই থরে থরে। পঙ্গুত্ব উপেক্ষা করে হকিং-এর গবেষণা যে কোনও সাংবাদিকের কাছেই লোভনীয় লেখার বিষয়। বলা বাহুল্য, ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ রিভিউ করতে গিয়ে সমালোচকরা সেই লোভেরই শিকার হলেন। না হলে ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’-এ লেখা হয়, ‘‘বিশ্বতত্ত্ব উনি ব্যাখ্যা করেছেন কল্পনাশক্তি দিয়ে। কখনও কখনও কবির মতো করে। পাঠককে উনি ভাগ করে দিয়েছেন নিজের বিস্ময়বোধের।’’ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ লেখে, ‘‘মিস্টার হকিং এক জন মাস্টারমশাই সুলভ দক্ষতার অধিকারী— সহজ সাবলীল এবং মজা করে বলতে পারেন অত্যন্ত দুরূহ বিষয়গুলোকে।’’ আর একটি পত্রিকায় লেখা হয়, ‘‘উনি অসাধ্যসাধন করেছেন। এমন বই লিখেছেন যা প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা, ভাল লেখা, মৌলিক চিন্তা কিংবা দুরন্ত কল্পনার একটা মডেল হয়ে থাকবে।’’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বোধহয় ‘নিউজডে’ পত্রিকার মন্তব্য: ‘একটা কথা পাঠকের মনে হবেই। যাঁরা পদার্থবিদ নন, তাঁদের জন্য আইনস্টাইন যদি কোনও বই লিখতেন তা হলে সেটা বোধহয় হত এমনই।’

এমন বইয়ের কাটতি রোখে কে? হু হু করে বিক্রি হয় হকিং-এর বই। শুধু ১৯৮৮-র এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে ১৪টা মুদ্রণ ফুরুৎ। কত লক্ষ কপি কে জানে। এখন তো পেপারব্যাক হয়ে আরও লাখে লাখে। একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে ব্যাপারটা। গ্র্যান্ড হোটেলের দেওয়ালের গায়ে যে একচিলতে দোকান তপন চ্যাটার্জির (যাঁর কাছে প্রথম ভাল বইয়ের খবর পান কলকাতার অনেক পড়ুয়া), সেখান থেকেই এ পর্যন্ত ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ বিক্রি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার। তপন জানালেন, ‘‘একমাত্র বার্গম্যানের ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ন’ (যা বিক্রি হয়েছিল ১০ হাজার কপি) ছাড়া আর কোনও বই এত বিক্রি করিনি আমি।’’ কারা কিনছেন? ‘‘কে নয়?’’ তপনের জবাব, ‘‘অধ্যাপক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, অভিনেতা, কোম্পানি ডিরেক্টর, আমলা, ডাক্তার, কলেজ, এমনকী স্কুলের ছাত্রও আছে তাঁদের মধ্যে।’’ সুতরাং, বিক্রি যদি জনপ্রিয়তার নিরিখ হয়, তা হলে বলতে হয়, হকিং সফল হয়েছেন তাঁর উদ্যমে। কিন্তু বিষয়বস্তু? তা কি সত্যিই হয়েছে ততটা প্রাঞ্জল? যতটা প্রচার করেছেন সমালোচকেরা কিংবা দাবি করেছেন স্বয়ং হকিং? মেধায় উনি হতেই পারেন আইনস্টাইনের সার্থক উত্তরসূরী। কিন্তু তা-ই কি সহজবোধ্য লেখার কায়দা অর্জনের পক্ষে যথেষ্ট? ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ কিনেছেন দুনিয়াভর যে সব লাখো লাখো মানুষ তাঁদের ক’জন পৌঁছতে পারলেন স্পেসটাইম সিঙ্গুলারিটি কিংবা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির চক্রব্যূহে?

বিশ্বের সৃষ্টিকালে অপরিমিত পদার্থ যদি অধিকার করে থাকে বিন্দু পরিমাণ স্থান তবে তার চরিত্র নির্ধারণে বিজ্ঞানের নিয়মকানুন অকেজো হয়ে যায়। স্থান ও কালের ওই অদ্ভুত চেহারাই হল সিঙ্গুলারিটি। আর কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি? হায়! ওটা তো স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনেরও। মহাবিশ্বে প্রকাণ্ডের বিধান দেয় যে গ্র্যাভিটি আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের চরিত্র নিরূপণ করে যে কোয়ান্টাম মেকানিকস তারা যে ভিন্ন নয় বরং একই নিয়মের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ, এ রকম একটা চিন্তা ছিল রিলেটিভিটি প্রণেতার। উনিও চাইতেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে মেলাবেন গ্র্যাভিটি। হকিং তা-ই করেছেন। নাম দিয়েছেন কোয়ান্টামগ্র্যাভিটি। সহজ নয়, বেশ কঠিন আইডিয়াটা।

জানি, অর্বাচীন প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় সত্যিটা কবুল করেন না অনেকেই। তবে এটা ঠিক, তথাকথিত অনেক সমজদার পাঠকই বইটা পড়তে গিয়ে টের পেয়েছেন যে আমজনতার কম্ম সেটা নয়। সত্যি বটে, বইটায় অঙ্কের কচকচি নেই। কেন নেই তার ব্যাখ্যাও হকিং দিয়েছেন শুরুতেই। লিখেছেন, ‘‘কে যেন আমায় বলেছিল বইটায় একটা করে গাণিতিক সমীকরণ রাখা মানেই নাকি বিক্রি অর্ধেকটা করে কমে যাওয়া। আমি তাই ঠিক করেছি একটাও সমীকরণ রাখব না। শেষে অবশ্য একটা রেখেছি। আইনস্টাইনের E+mC2, আশা করি আমার পাঠককুলের অর্ধেক তাতে ঘাবড়াবেন না।’’ বইটার গোড়ায় হকিং আর একটি জিনিসের জানান দিয়েছেন। তাঁর আত্মবিশ্বাসের। লিখেছেন, ১৯৭৩-এ ‘দ্য লার্জস্কেল স্ট্রাকচার অব স্পেসটাইম’ লেখার ১৫ বছর পর তা জানা হয়ে গিয়েছে ‘‘কী ভাবে লিখলে তা সহজবোধ্য হয়।’’

‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে হকিং বলেছেন, ‘‘সৃষ্টিকালের ব্রহ্মাণ্ড কিংবা অন্ধকূপ (ব্ল্যাক হোল) নিয়ে বেশ কিছু বই আছে। ওদের মধ্যে বেশ ভালর তালিকায় পড়বে স্টিভেন ওয়েনবার্গের ‘দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস’। খারাপের তালিকায় যেগুলো, সেগুলোর নাম করব না। তবে, আমি বলব ওগুলোর কোনওটাতেই মেইন প্রশ্নগুলোর জবাব নেই যেগুলোর তাড়নায় একদা আমি বিশ্বতত্ত্ব কিংবা কোয়ান্টাম থিওরিতে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এই ব্রহ্মাণ্ড এল কোথা থেকে? কী ভাবে ও কেন এর উৎপত্তি? সব কিছু কি বিনাশ হয়ে যাবে? যদি হয়ে যায় তবে তা কী ভাবে? এই সব প্রশ্ন, আমি জানি, আমার একার নয়, সকলের। অথচ, আধুনিক বিজ্ঞান এতটাই জটিল হয়ে পড়েছে যে স্বল্প সংখ্যক কিছু বিশেষজ্ঞ পারেন সব কিছু বোঝার মতো গণিত আয়ত্ত করতে। কারণ, ও সব বোঝানো হয় দুরন্ত গণিতে। অবশ্য, ব্রহ্মাণ্ডের যদি আদি ও অন্ত গণিত ছাড়া এমন ভাবে বলা যায় বলে আমার মনে হয় যাতে বিজ্ঞানে তালিম নেই এমন মানু‌ষও বুঝতে পারেন। আমার বইতে ওই চেষ্টাই করেছি আমি। সফল হয়েছি কি না বলবেন আমার পাঠকেরা।’’

(আনন্দবাজারের ‘পত্রিকা’ বিভাগে ১৯৯০-এর ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিবন্ধের অংশবিশেষ)

Stephen Hawking Cosmology Physicist A Brief History Of Time
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy