Advertisement
E-Paper

আকাশের বুকেও মালিকানা, তোমার নামে তারার নাম

চাঁদে জমি কেনা, মঙ্গলে বাড়ি বানানোর স্বপ্ন হয়তো এখনও ছোঁয়া হয়নি, কিন্তু গ্যাঁটের কড়ি খরচা করলেই পাওয়া যাচ্ছে নক্ষত্রের মালিকানা। বড়দিনের মরসুমে রঙিন কাগজ বা রাংতার তারা নয়, একেবারে আকাশের গায়ে ঝিকমিক করা, যাকে বলে আসল তারা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২৬
তারার নাম লেখা উপহার। অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

তারার নাম লেখা উপহার। অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

চাঁদে জমি কেনা, মঙ্গলে বাড়ি বানানোর স্বপ্ন হয়তো এখনও ছোঁয়া হয়নি, কিন্তু গ্যাঁটের কড়ি খরচা করলেই পাওয়া যাচ্ছে নক্ষত্রের মালিকানা। বড়দিনের মরসুমে রঙিন কাগজ বা রাংতার তারা নয়, একেবারে আকাশের গায়ে ঝিকমিক করা, যাকে বলে আসল তারা। সেই যে জুহি চাওলার দিকে তাকিয়ে শাহরুখ খান গেয়েছিলেন, চাঁদ-তারে তোড়কে লাউঁ... সেই শপথ এখন বাস্তবায়িত করার দিন এসেছে।

শাহরুখ না-হয় নিজেই তারকা। কিন্তু সৌরমণ্ডলে নক্ষত্র কেনাবেচার দুনিয়ায় আমি-আপনি, হরিপদ কেরানিও স্বাগত। মহাকাশ চর্চায় এই তারা-বাজির কোনও বৈধ স্বীকৃতি না-ই থাকুক, মনের মধ্যে তারা ঝিলমিল করলেই হল! বৈধতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কে!

প্রতাপাদিত্য রোডের পৌলমীর এক অনুরাগী চাকরি করেন বিদেশে। পৌলমীর জন্য সুদৃশ্য বাক্সে ‘তারা’ কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। মানে, আকাশ থেকে একেবারে পেড়ে আনেননি। আকাশের তারা আকাশেই আছে। কিন্তু যে তারাটি কিনে পৌলমীর নামে নামকরণ করে দেওয়া হয়েছে, তার শংসাপত্র এসেছে বাক্সে করে। সঙ্গে রয়েছে মহাকাশের মানচিত্র। সেখানে একটি তারাকে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে— ‘আজ থেকে ওই অনামী তারার নাম দেওয়া হল পৌলমী।’

বেঙ্গালুরুর রনির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আসানসোলের প্রিয়াঙ্কার। ফুলশয্যার রাতে বর যে বাক্স খুলে তারার চার্ট বিছিয়ে বসবে— তা কে জানত! অবশ্য উপহারের ‘গুরুত্ব’ বুঝে আনন্দ এখন আক্ষরিক অর্থেই আকাশ-ছোঁয়া। উঠতি প্রজন্মের অভিনেতা ঋদ্ধি সেন-ও তারার নাম নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে এটা বেশ অভিনব, টাটকা আই়ডিয়া। কেবল প্রেম নিবেদন নয়, কাউকে শ্রদ্ধা দেখাতেও আমি তারার নাম দিতে পারি।’’

পশ্চিমে অনেক দিন ধরেই জনপ্রিয় এই ‘নেম আ স্টার’-এর রেওয়াজ। ইদানীং ভারতেও সেটা বেশ ‘ইন থিং’ হয়ে উঠছে। মহাকাশ পাড়ির ঝামেলা নেই। দূরবীনের হাঙ্গামা নেই। শুধু মাউসের ক্লিকে মহাকাশের কোনও একটি তারার পরিচয় বদলে দিন প্রিয়তমার নামে। অনলাইন মার্কেটিং সাইটগুলির দৌলতে সুদৃশ্য ধাতব বাক্সে তারার নামকরণের প্রমাণপত্র আপনার ঠিকানায়। ভারতেও বিভিন্ন সংস্থা আসরে নেমেছে। দাম পড়ছে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা।

কী ভাবে ঠিক হয় তারার দাম?

যদি যে কোনও একটি তারায় আপনার মন ভরে তো দাম কম। তারকামণ্ডলীর কোনও নির্দিষ্ট তারার নাম উপহার দিতে চাইলে দাম লাফিয়ে বাড়বে। শংসাপত্রের সঙ্গে মানচিত্র নিলে আলাদা দাম। স্যাটেলাইট ছবি চাইলে পকেট আরও হালকা।

পুরনো নথি অনুযায়ী, তারার নাম দেওয়ার এই ব্যবসা সম্ভবত প্রথম শুরু করেছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টার রেজিস্ট্রি’। সেই ১৯৭৯ সালে। চিত্রতারকা, খেলোয়াড়, শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই উপহার। তারার দামও ছিল বেশি। কিন্তু বাজার ধরতে এখন ৬০ ডলারের তারা ৫০ শতাংশ ছাড়ে ৩০ ডলারে বিকোচ্ছে।

কিন্তু যুগ যুগ ধরে মানুষ যে তারাকে যে নামে চিনে এসেছে, ইচ্ছে করলেই কি তাদের নাম পাল্টে দেওয়া যায়? ধ্রুবতারা বা লুব্ধকের নাম কি তবে বদলে যাবে? বিড়লা তারামণ্ডলের অধিকর্তা দেবপ্রসাদ দুয়ারি বলছেন, এমন আশঙ্কা ভিত্তিহীন। কারণ তারার নাম দেওয়ার এই হিড়িকের কোনও বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি নেই।’’ বহু তারারই প্রাচীন ইসলামি, গ্রিক বা সংস্কৃত নাম রয়েছে। ‘‘নতুন করে কালপুরুষ বা সপ্তর্ষিমণ্ডলের নাম কেউ বদলে দিতে পারেন না। তারার নামের ব্যাপারে শেষ কথা আইএইউ।’’

১৯১৯ সাল থেকে আইএইউ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’ই তারা-গ্রহ-উপগ্রহদের পরিচিতি সংক্রান্ত বিষয়টি তদারকি করে আসছে। তারার নাম নিয়ে আজকাল হাজারো প্রশ্ন জমা পড়ছে তাদের ওয়েবসাইটে। আইএইউ স্পষ্ট বলছে— মহাকাশ বিজ্ঞানে এই নামগুলির স্বীকৃতি নেই। বিভিন্ন সংস্থা তারাদের ‘নাম’ বিক্রির কথা বলে মানুষকে বোকা বানিয়ে ডলার কামাচ্ছে। এমন হতেই পারে, কলকাতার কৃষ্ণেন্দু যে তারাটি কিনে হয়তো ‘পায়েল’ নামকরণ করেছেন, সেই একই তারা কিনে ‘প্যাট্রিসিয়া’ নাম রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিল।

চাঁদ-তারাকে ঘিরে মানুষের কল্পনা আর ফ্যান্টাসি দীর্ঘ দিনের। ঘুমপাড়ানি গান থেকে শুরু করে রোম্যান্টিক কবিতা, সিনেমার গান থেকে মৃত্যুভাবনা— তারাদের আনাগোনা সর্বত্র। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা নায়ককে তারকা বা নক্ষত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখন পয়সা ফেললেই যদি তারার মালিক হওয়া যায়, এত কালের ফ্যান্টাসি মরে যাবে না? কবি শ্রীজাতর আশ্বাস, ‘‘কল্পনাশক্তির পরিসর ব্যবসা-বুদ্ধির চেয়ে অনের গভীর। বিপণন সেই কল্পনাকে ধাক্কা দিতে পারবে না।’’ প্রবীণ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘এ হল হুজুগ আর ব্যবসার অর্থহীন যুগলবন্দি।’’

আর মর্ত্যের নক্ষত্ররা কী ভাবছেন? পয়সা দিয়ে তারা কেনা গেলে স্টার-সিস্টেমের নতুন নামকরণ প্রয়োজন হবে না কি? অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় বিরক্ত। বললেন, ‘‘হুজুগ আর বাজার অর্থনীতির জন্যই তারাদের এমন দুরবস্থা। এ বার হয়তো একটা তারা কিনলে আর একটা ফ্রি দেওয়া হবে।’’ নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর মতেও, ‘‘মানুষের ফ্যান্টাসি আর ইলিউশন থেকে জন্মানো কৌতূহল একটা অন্য আনন্দ দেয়। কিছু আবেগ অনুচ্চারিত আর কিছু প্রাপ্তি স্পর্শের বাইরে থাকাই শ্রেয়।’’

তারাদের অবশ্য এ সবে কিছু আসে-যায় না। তারা সেই তিমিরে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy