বাঘের ডাকে এক সময় কেঁপে উঠত খয়েরবাড়ি। এখন তেরোটি খাঁচা খালি পড়ে রয়েছে। ল্যাজকাটা রাম, এক পা কাটা রাজা এবং শ্যাম এখন অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র। তাদেরও যৌবন শেষ। বার্ধক্য এসেছে। এই তিন বাঘ না থাকলে খয়েরবাড়িতে যে পরিমাণ পর্যটক ভিড় করছেন, এরপরে তাঁরাও মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলে মনে করছেন বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা।
নামে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প হলেও পর্যটকরা দূরে থাক, শেষ কবে কোন বনকর্মী রয়্যাল বেঙ্গলের দর্শন পেয়েছেন, তা মনে করতে পারেন না অনেকে। তাই বনের মধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল দেখার দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে ২০০৫ সালে সার্কাস থেকে উদ্ধার করা ১৬টি বাঘ নিয়ে আসা হয় ডুয়ার্সের খয়েরবাড়িতে। লোহার জাল দিয়ে মুড়ে ফেলা ঘাস বনে সারা দিন ঘরুত বাঘগুলি। কখনও হুঙ্কার ছেড়ে পর্যটকদের পিলে চমকে দিত তারা। আবার কখনও সেখানে ছোট জলাশয়ে শরীর ডুবিয়ে রাখত। বাঘের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত পর্যটকদের মধ্যে। পরে সুন্দরবন থেকে উদ্ধার করে পা কাটা রাজাকে খয়েরবাড়ি নিয়ে আসার পর জৌলুস বেড়ে যায় সেখানকার। তবে বয়সের ভারে একে একে চোদ্দটি বাঘ মারা গিয়েছে। রাম, শ্যাম, রাজা এখন বৃদ্ধ। তিনটি মাত্র বাঘ দেখতে সে রকম উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না পর্যটকদের।
খয়েরবাড়ির এক বনকর্মীর কথায়, ‘‘শুধু বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়া নয়, গোটা পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থা এখন যে ভাবে বেহাল হয়ে পড়েছে তাতে তো পর্যকরা মুখ ফেরাতে বাধ্য হবেন।’’
হচ্ছেও তাই। আগের তুলনায় পর্যটকদের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি নেমে গিয়েছে। গোটা ইকো পার্ক জুড়ে এখন অযত্নের ছাপ। অজস্র গরু, ছাগল পার্কের ভিতর চড়ে বেড়াচ্ছে দিনভর।
শুধু রয়্যাল বেঙ্গল নয়, চা বাগান থেকে উদ্ধার করে আনা চিতাবাঘগুলিকে এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কৃত্রিম বনে ছেড়ে দেওয়া হত প্রথম দিকে। উদ্দেশ্য ছিল বনের পরিবেশে তাদের বড় করার পাশাপাশি সেখানে শিকার করে খাবার খাওয়া। পরবর্তীতে তাদের বনে ছেড়ে দিলে যাতে তাঁরা যাতে নিজেদের খাবার শিকার করতে পারে। সেই কৃত্রিম বনে পর্যটকদের ঘুরে দেখানোর জন্য ব্যাটারি চালিত গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। খয়েরবাড়ির খাঁচায় ৭ টি বাঘ থাকলেও সেই কৃত্রিম বনে এখন মাত্র দুটি বাঘ ছাড়া রয়েছে। উল্টে গত চার বছর ধরে ব্যাটারি চালিত গাড়ির যন্ত্রাংশ বিকল। তা সারাই করারও কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছে না বন দফতর।
খয়েরবাড়ি জঙ্গলে এক সময় ব্যাপক হারে গাছ কাটা হচ্ছিল। ২০০৩ সালে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরে তা অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষজনের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা হয়। তবে এখন বন দফতরের উদাসীনতায় নতুন করে বনে গাছ কাটা শুরু হয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন বনমন্ত্রী যোগেশ বর্মনের কথায়, ‘‘এক সময় গাছ কাটা তো বন্ধ হয়ে যায়। এখন ফের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। ওই পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না বন দফতর। বন সুরক্ষা কমিটির বৈঠকও হয় না আজকাল। যে হারে গাছ কাটা হচ্ছে, তাতে কিছু দিন বাদে তো জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাবে।’’
শুধু যোগেশবাবু নন, দিনে দুপুরে যে খয়েরবাড়িতে যথেচ্ছ বৃক্ষ ছেদন হচ্ছে সে বিষয়ে বন দফতরের অফিসারদের দায়ী করেছেন ফালাকাটা ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি সঞ্জয় দাস। তৃণমূলের ওই নেতা ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেছেন, ‘‘গাছ কাটা রোধ করতে আমরা বার বার অফিসারদের খবর দিলেও তাঁরা আসছেন না। বন দফতরের উদাসীনতার জন্য কয়েক দফা আমরা রাস্তা অবরোধ করি। ক্লাবের ছেলেরা বন কর্মীদের আটকে রাখেন কিছুদিন আগে। পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থা যারপরনাই বেহাল।’’
খয়েরবাড়িতে অবিরাম গাছ কাটায় বাঁদরদের খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামগুলিতে এখন খাদ্যের সন্ধানে সকাল থেকে দল বেঁধে বাঁদরেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।
বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বলেছেন, ‘‘পর্যটন কেন্দ্রে ব্যাটারি চালিত গাড়ি পুনরায় চালু করার জন্য কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। বনে গাছ কাটার খবর আমার কাছে এসেছে। তা যাতে দ্রুত রোধ করা হয় তা দেখতে নির্দেশ আমি দিয়েছি।’’