Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Rishav Pant

‘কিক’ তত্ত্ব উড়িয়ে ‘দলের সম্পদ’ ঋষভকে আরও সুযোগ দিতে বলছেন কোচ

ব্যাটসম্যান ও কিপার, কোনও ভূমিকাতেই ঋষভ ক্রিকেটপ্রেমীদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি এখনও। তারক সিনহার অবশ্য নিজস্ব যুক্তি রয়েছে।

ঋষভ পন্থের মুখে এই হাসি স্থায়ী হবে তো, চর্চায় ক্রিকেটমহল। ছবি: বিসিসিআই।

ঋষভ পন্থের মুখে এই হাসি স্থায়ী হবে তো, চর্চায় ক্রিকেটমহল। ছবি: বিসিসিআই।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ১৪:০১
Share: Save:

‘এ কিক অন দ্য ব্যাক!’ ঋষভ পন্থের নাকি এটাই জরুরি। অন্তত ইরফান পাঠান তেমনই মনে করেন।

এবং তারক সিনহা, ছোটবেলার কোচ, এখনও গাইড, তা একেবারেই মনে করেন না। বরং জোরালো প্রতিবাদ থাকছে তাঁর তরফে। ‘কিক’ নয়, ছাত্রের চাই টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা। দরকার সঠিক দিশা, প্রয়োজন ভূমিকা ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেওয়া। ঋষভ পন্থের প্রতিভা তবেই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে, বিশ্বাস রাজধানীর বর্ষীয়ান কোচের।

কিন্তু উইকেটকিপিং নিয়েই তো রয়েছে প্রশ্ন। দেশের মাঠে এ জন্যই তো টেস্ট সিরিজে উইকেটকিপার হিসেবে এখনও দেখা যায়নি তাঁকে। আর ব্যাটসম্যান হিসেবেও আপাতত ভরসা দেওয়ার ধারেকাছে নেই তিনি। সাদা বলের ক্রিকেটে উইকেটকিপার হিসেবে হালফিল লোকেশ রাহুলের উপর বিশ্বাস রেখেছে দল। মারকুটে হিসেবে চিহ্নিত হলেও এগারোয় জায়গা হচ্ছে না ঋষভের। ভবিষ্যৎ তো ধোঁয়াশাই দেখাচ্ছে।

কোচের চোখে অবশ্য তা ধরা পড়ছে না। বরং ছাত্রকে নিয়ে আশপাশের অনিশ্চয়তার আবহে কিছুটা বিরক্ত তিনি। আনন্দবাজার ডিজিটালকে সরাসরি বললেন, “এটা নিশ্চয়ই কথার কথা! যা বলেছে ঠিক সে ভাবে নেওয়া উচিত হবে না। ও হয়তো বোঝাতে চেয়েছে পন্থকে বকে-ঝকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা। আর আমার মনে হয় না ইরফান পাঠান ঠিক কথা বলেছে। ঋষভ পন্থ দলের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তবে ও দলের সম্পদ হয়ে উঠবে। ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ও প্রতিশ্রুতিবান। একটা কথা মানতেই হবে যে, নিজেকে মেলে ধরার খুব বেশি সুযোগ ও পায়নি। টেস্টে তুলনায় বেশি খেলেছে। টেস্টে যে ভাল খেলতে পারে সে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তো পারবেই। আর ও তো আইপিএলেও ভাল খেলেছে। দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে পারবে না, হয় নাকি?”

কোচ তারক সিনহার সঙ্গে ঋষভ পন্থ। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।

তারক সিনহার মুখে উঠে আসছে ঠিকঠাক সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু ‘ঠিকঠাক সুযোগ’ মানে কী? ইরফান পাঠান তো উল্টো সুরে বলেছেন, কখনও কখনও ‘টু মাচ ব্যাকিং’ সমস্যা গড়ে তোলে। পরিসংখ্যান বলছে, এখনও পর্যন্ত ১৩ টেস্ট, ১৬ এক দিনের ম্যাচ ও ২৮ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। টেস্টে গড় ৩৮.৭৬। দুটো সেঞ্চুরি। যা এসেছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়। সর্বাধিক নট আউট ১৫৯। তুলনায় সাদা বলের ক্রিকেটে গড় বেশ কম, ওয়ানডে ম্যাচে ২৬.৭১, টি-টোয়েন্টিতে ২০.৫০। সীমিত ওভারের ফরম্যাটে দেশের হয়ে সর্বাধিক ৭১, একটা আশি পর্যন্ত নেই! যদি বাইশ গজে মেলে ধরতে না পারা যায়, তা হলে আর প্রতিভাবান হয়ে লাভ কী? অনেকেই তাই বলছেন, ক্রিকেটমহলে প্রশ্ন উঠছে সঙ্গত কারণেই।

আরও পড়ুন: মোহনবাগান দিবসে টাইম স্কোয়ারের বিলবোর্ড ঢাকল সবুজ মেরুনে

লোকেশ রাহুলকে সাদা বলের ক্রিকেটে উইকেটকিপার হিসেবে দেখতে চাইছেন না ঋষভের কোচ। তাঁর যুক্তি, “দেখুন, লোকেশ রাহুল আসলে ব্যাটসম্যান। দুর্দান্ত এক জন ব্যাটসম্যান। কিপিং করিয়ে না আবার ওর ব্যাটিং নষ্ট করে ফেলি। কারণ, কিপিং করানো মানে ওর ঘাড়ে বোঝা চাপানো। সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে। আর ঋষভ তো হার্ডহিটার। বড় শট নিতে পারে। এটা টি-টোয়েন্টিতে ভাল খেলার শর্ত। তা ছাড়া ও প্রধানত কিপার। সেটাও দেখতে হবে।”

মুশকিল হল, ব্যাটসম্যান ও কিপার, কোনও ভূমিকাতেই ঋষভ ক্রিকেটপ্রেমীদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি এখনও। তারক সিনহার অবশ্য নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। তাঁর মতে, “হাতে কম ওভার থাকলে ওকে তো শট নিতেই হবে। নিজের জন্য খেললে চলে না। টিমের জন্য খেলতে হবে। দেশের কথা ভাবতে হবে। শট নিতে গেলে ঝুঁকি এসেই যায়। তখন ব্যাপারটা ফিফটি-ফিফটি। ছক্কা হলে হাততালি, আউট হলে ধিক্কার।”

কিন্তু, এর মানে তো শট-বাছাইয়ে সমস্যা। ছাত্রকে কী পরামর্শ দিয়েছেন তা কাটিয়ে উঠতে? উত্তর এল, “পন্থের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। বেশ কয়েক বারই কথা হয়েছে। বলেছি, মানসিক ভাবে তৈরি থাকতে। কোন মাঠে খেলছি, কোন আক্রমণের বিরুদ্ধে খেলছি, কোথায় নামছি, এগুলো দেখতে হবে। স্লগে খেললে এক রকম মানসিকতা। আবার আগে নেমে ইনিংস গড়ার দায়িত্ব এলে অন্য মানসিকতা দরকার। কিছু ইনিংস দেওয়া হোক ওকে। হতে পারে যে প্রতিটায় সাফল্য আসবে না, কিছু ব্যর্থতাও নিশ্চয় আসবে। কিন্তু ধীরে ধীরে ও থিতু হবে। যদি মনে হয় যে ও দলের সম্পদ হয়ে উঠবে, তবে সেটা ওকে বোঝানো হোক। বলা হোক, এই নম্বরে নেমে তুমি নিজেকে প্রমাণ করো। যদি লোয়ার ডাউনে নামে তবে সেখানকার ব্যাটিং করতে হবে। আর যদি আগে নামে তবে সেখানকার ব্যাটিং করতে হবে।”মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বিশ্বক্রিকেটের সেরা ফিনিশার হিসেবে পরিচিত। সেই জায়গাতেই তো খেলতে হবে ঋষভকে। কিন্তু তাঁর মধ্যে ফিনিশার হওয়ার দায়িত্ববোধ দেখা যায়নি এখনও। তারক সিনহা অবশ্য ফিনিশার হিসেবে দেখছেন না ছাত্রকে। তাঁর কথায়, “ও স্ট্রোকমেকার। ফলে ফিনিশার হওয়া মুশকিল। স্ট্রোক যে নেয় সে যে কোনও সময় আউট হতে পারে। ও টেস্টে দ্বিতীয় বলেই ছয় মেরেছিল। আর ধোনি শেষ পর্যন্ত ম্যাচ নিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী। প্রথমে ধীরে ধীরে খেলে আস্তে আস্তে গতি বাড়ানো ধোনির স্টাইল। ঋষভ খেলে উল্টো ঘরানায়। ওকে বরং বলা হোক, তোমার কাজ হবে ইনিংসের গতি বাড়িয়ে রাখা। শট নেওয়া ওর সহজাত বৈশিষ্ট্য। সেই স্বাধীনতা দেওয়া হোক। শেষের দিকের কাজটা সারার দায়িত্ব বরং দেওয়া হোক অন্য কাউকে।”

টেস্টে ব্যাট হাতে ঋষভ পন্থ তুলনায় বেশি সফল। ছবি: এএফপি।

শ্রীলঙ্কার রমেশ কালুভিথরনের উদাহরণ টানছেন তিনি। বললেন, “শ্রীলঙ্কা সনৎ জয়সূর্যের সঙ্গে কালুভিথরনেকে দিয়ে ওপেন করিয়ে একটা তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিল। লাইসেন্স দিয়েছিল কালুকে যাতে প্রথম থেকেই ও চালাতে পারে। আউট হলেও কোনও ব্যাপার নয়, বলে দেওয়া হয়েছিল। ওই দু’জনের কাজ ছিল রান রেট বাড়ানো। তখন কিন্তু কেউ বলত না যে, প্রথম ওভারেই কেন আউট হয়ে যাচ্ছে কালুভিথরনে। কারণ, ওদের এই দায়িত্বই দেওয়া হয়েছিল। ঋষভকেও তেমন রোল দেওয়া হোক। যদি মনে হয় ও সম্পদ হয়ে উঠতে পারে তবে ওর জন্য বিনিয়োগ করা হোক।”

‘কিপার’ হিসেবেও তো ঋষভ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন। স্পিনের বিরুদ্ধে তাঁর দুর্বলতার কথা অজানা নয় ক্রিকেটমহলে। তারক সিনহা তা মানছেন না। তাঁর মতে, “দেখুন, ধোনির উইকেটকিপিংও তেমন শক্তপোক্ত ছিল না গোড়ার দিকে। ধীরে ধীরে ও উন্নতি করেছে। পন্থও পরিশঅরম করছে। ওর বয়স তো মাত্র ২২। সতেরো-আঠেরো বছর বয়স থেকে খেলছে। সময় আছে। নিশ্চয়ই উন্নতি করবে।”

ঘরের মাঠে টেস্টে বিশেষজ্ঞ উইকেটকিপার হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন ঋদ্ধিমান সাহা। আবার নিউজিল্যান্ডে বছরের গোড়ায় টেস্ট সিরিজে ঋষভকে দেখা গিয়েছে স্টাম্পের পিছনে। ঋদ্ধির সঙ্গে তুলনায় কোথায় রাখবেন ঋষভকে? তারক সিনহা বলেছেন, “ঋদ্ধিমান পুরোপুরি কিপিংয়েই মনোযোগ দিয়েছে। ও খুব ভাল কিপার। কিন্তু, ঋষভ ব্যাটিংয়েও মন দিয়েছে। এখন ক্রিকেট অনেক বদলে গিয়েছে। কিপারকে এখন অলরাউন্ডার হতে হবে। যাকে দক্ষ ব্যাটসম্যান হিসেবেও ধরা যায়। আগে পিওর কিপার নেওয়া হত। এখন অলরাউন্ডারে জোর দেওয়া হচ্ছে। আর ঋষভের কিপিং কিন্তু খারাপ নয়। ওর কালেকশন পারফেক্ট। শুধু মনসংযোগ বাড়াতে হবে। তা নেই, এমন নয়। সে ক্ষেত্রে তো টেস্টে কিপার হিসেবে রেকর্ড করতে পারত না। ওর হাত নমনীয়। টেকনিকে পিছিয়ে নেই একটুও।”

আরও পড়ুন: অনু প্রেমেই বিরাট বদল​

কিন্তু দেশের মাঠের ধুলো ওড়া পিচে স্পিনারদের বিরুদ্ধে টেকনিক নিয়ে সংশয় তো দলেও রয়েছে। কোচের দাবি, “ভারতে ওকে খেলিয়ে তো দেখুন। না খেলালে বোঝা যাবে কী করে। ভারতে ওকে খেলানো হোক। কিপিংয়ের জন্য বল ধরায় নিখুঁত থাকতে হয়। তা কিন্তু ওর আছে। বল ওর হাতে জমে যায়। শুধু মনোসংযোগ বাড়াতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার রডনি মার্শ বিশাল ব়ড় কিপার ছিল না। খেলে খেলে ও উন্নতি করেছে। ধোনির ক্ষেত্রেও এটা খাটে। কারও উপরে ভরসা রাখলে, সুযোগ দিলে উন্নতি হবেই।”

কোচের কাছেই জানা গেল, অনুশীলন শুরু করে দিয়েছেন ঋষভ। লকডাউনে বাড়ির মধ্যেই ছোটখাটো জিমে ঘাম ঝরিয়েছিলেন। এখন মাঠে ঝরাচ্ছেন ঘাম। বাড়ির পাশের এক মাঠে সুরেশ রায়নার সঙ্গেই স্কিলের চর্চা চালু। নেটও হচ্ছে। কোচের কথা মতো স্কিল মাজাঘষায় ব্যস্ত তিনি। সামনে আইপিএল। ধুমধাড়াক্কা শটের প্রস্তুতিও চলছে। বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ খেলার কথা রয়েছে টিম ইন্ডিয়ার।

সামনের দিনগুলোর জন্য কী পরিকল্পনা থাকছে? তারক সিনহা বললেন, “অহেতুক চাপ বাড়িয়ে তো লাভ নেই। আইপিএলে ও যথেষ্ট অভিজ্ঞ। প্রচুর ভাল ইনিংস খেলেছে। ফলে চিন্তা নেই। ও স্বাভাবিক খেললেই রান আসবে। আর অস্ট্রেলিয়ায় তো বড় রান পেয়েইছে আগে। ওখানের হার্ড বাউন্সি উইকেটে খেলতে পছন্দ করে। শট নেওয়া সহজ ওখানে। গত বার রানও পেয়েছিল। ভালই খেলবে।”

চাপ নয়, ভরসা দেওয়া। মাথার উপরে ঝুলতে থাকা খাঁড়া নয়, বিশ্বাস রাখা। ঋষভ পন্থের সাফল্যর জন্য টিম ইন্ডিয়ার কাছে এটাই চাহিদা কোচের। কিন্তু, এই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে ক্রমাগত ভরসা রাখা কি সম্ভব? পারফরম্যান্সই যেখানে টিকে থাকার একমাত্র মন্ত্র, সেখানে ব্যর্থ হলেও ক্রমাগত আস্থা রাখা যে সোনার পাথরবাটির মতোই অবাস্তব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE