Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Sourav Ganguly

আগে কি লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, সৌরভ সত্যিই কি চেক-আপ করাতেন না?

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ, ক্রীড়া বিশ্ব। সে দিন ঠিক কী ঘটেছিল? সৌরভ বাড়ি ফিরছেন কাল। হাসপাতালে সারাক্ষণ সঙ্গে থাকা দীর্ঘ দিনের বন্ধু লিখছেন.. ভিতর থেকে ভেসে এল ডাক্তারের গলা: ‘অ্যাটাক’

ছুটি: বাড়ি ফিরছেন আজ। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ ভাবেই আবার কবে দেখা যাবে সৌরভকে, এখন তারই অপেক্ষা।   ফাইল চিত্র

ছুটি: বাড়ি ফিরছেন আজ। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ ভাবেই আবার কবে দেখা যাবে সৌরভকে, এখন তারই অপেক্ষা। ফাইল চিত্র

সঞ্জয় দাস
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:৫২
Share: Save:

২০১৯-এর ২৯ এপ্রিল। চেন্নাই পৌঁছে গিয়েছি। দিল্লি ক্যাপিটালসের পরামর্শদাতার নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দলের সঙ্গে আমিও গিয়েছি। চেন্নাইয়ে ধোনিদের সঙ্গে গ্রুপ পর্বের ম্যাচ ১ মে।

রাতের খাওয়াদাওয়া সারলাম যখন, টেবলে শিখর ধওয়নও ছিল। ওকে নানা রকম সব ক্রিকেটীয় পরামর্শ দিচ্ছিল দিল্লি ক্যাপিটালসের পরামর্শদাতা। এই সময়টা সৌরভের পাশে থাকা মানে ক্রিকেটীয় এনসাইক্লোপিডিয়ার সন্ধান পাওয়া। সেই ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির মতো সারাক্ষণ মাথায় নানা রকম ভাবনা, রণনীতি কিলবিল করছে। কোন ব্যাটসম্যানের কোথায় খুঁত, কখন পা’টা যাচ্ছে না, কোন বোলারকে কী ভাবে খেলতে হবে, সব একদম মস্তিষ্কের কম্পিউটারে তোলা যেন। শিখরকে নিয়ে সে রকমই ক্লাস চলতে থাকল লাঞ্চ সারার সময়ে।

তার পরে ঘরে ফিরে বিকালের দিকে সৌরভ হঠাৎ বলল, পিঠে ব্যথা করছে। দেখে মনে হল, যন্ত্রণা, অস্বস্তিটা বাড়ছে। কিছু ক্ষণ পরে ব্যথাটা চলে গেল আর নিজের মেজাজেই ফের পেলাম মহারাজকে।

কে ভেবেছিল, আসলে ব্যথাটা যায়নি। ফিরে আসবে! ডিনার সেরে ঘরে ফিরে আসার পরে গল্প করছি। ফের পিঠে ব্যথা হচ্ছে বলে জানাল সৌরভ। এ বার কিন্তু ব্যথাটা ক্রমশ বেশ বাড়তে শুরু করেছে। এমনই অবস্থা হল যে, দিল্লি ক্যাপিটালসের ফিজ়িয়োকে ডেকে ম্যাসাজ করানো হল। তাতে সাময়িক স্বস্তি পেল। কিন্তু সেই রাতেই আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বললাম যে, পরের দিন ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। কেন ব্যথাটা হচ্ছে, অবশ্যই জানা দরকার। সৌরভ দেখলাম রাজিও হল, পরের দিন ডাক্তার দেখিয়ে নেবে। এবং, পরীক্ষাও করাবে।

কে জানত, পরের দিন দানবটা আর ফিরবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে সৌরভের কোথাও কোনও ব্যথা অনুভব হবে না। ভোজভাজির মতোই সব যেন উবে গিয়েছে। আর ওকে বলতে শুনব, ‘‘সব ঠিক আছে। একদম ঠিক আছি রে। কোনও ব্যথা-ট্যথা নেই।’’

সেই সকালটা ছিল চেন্নাইয়ে ২০১৯-এর ১ মে। সে দিনই চেন্নাইয়ের সঙ্গে দিল্লির আইপিএল ম্যাচ। এখন বার বার মনে হচ্ছে, সেই সকালটায় যদি ব্যথাটা একটুও যদি থাকত, খুব ভাল হত। তা হলে ২০২১-এর ২ জানুয়ারি, শনিবারের এই দুপুরের ঝড়টা হয়তো দেখতে হয় না। তা হলে আগের রাতের কথা মতো সে দিনই আমরা ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে যাই আর হয়তো দানবটাও ধরা পড়ে যায়। এমন অজান্তে বাসা বেঁধে থাকতে পারত না আমার বন্ধুর বুকে।

গত শনিবার যখন প্রিয় বন্ধুর বুকে-পিঠে ব্যথা শুরু হল, আমার কাছে ফোনটা এল আর হাসপাতালে পৌঁছলাম, তখনও কি ভাবতে পেরেছিলাম কিছু ক্ষণের মধ্যে সাংঘাতিক কিছু শুনতে হবে! আমি, সৌরভের স্ত্রী ডোনা, ওর দাদা স্নেহাশিস বসে আছি। ভিতরে ডাক্তারেরা পরীক্ষা করছেন সৌরভের। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়েছে বুকে-পিঠে ব্যথা, মাথা ঘোরানো, হাত চিনচিন করার উপসর্গ নিয়ে। কিন্তু তখনও আমাদের মনে হচ্ছিল, সব ঠিকঠাকই থাকবে। হয়তো রুটিন পরীক্ষাই চলছে। ভিতর থেকে হঠাৎ এক জন ডাক্তারকে বলতে শুনলাম, ‘ইট্‌স অ্যান অ্যাটাক!!!’’

এত কেঁপে যাওয়ার মতো কথা আমরা কখনও শুনিনি। সেই অনূর্ধ্ব-১৫ বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের দিন থেকে আমি সৌরভকে কাছ থেকে দেখছি। দুর্লভ, ঐতিহাসিক সব মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছি। কৈলাস ঘাটানির দলের সঙ্গে আমি, সৌরভ, সচিন, বিনোদ কাম্বলি এক সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেছি কিশোর বয়সে। তার পরে লর্ডসে ওর অভিষেক টেস্টের সময় ছিলাম। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে মসনদে বসার সময়ে আরব সাগরের পারে ওর সঙ্গে ছিলাম। দু’জনে সিএবি প্রশাসনেও থেকেছি এক সঙ্গে।

ওর হার-না-মানা মনোভাব, যে কোনও কঠিন পরিস্থিতি থেকে ইস্পাতকঠিন মানসিকতা দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে পারা— এ সব কত দেখেছি! যখন সকলে হয়তো ধরে নিয়েছে, জেতার সম্ভাবনা নেই তখনও ওকে বলতে শুনেছি, খেলা ঘুরবে। ঠিক ঘুরবে। এবং, সত্যি ঘুরেওছে। ভিতর থেকে কানে আসা ওই শব্দগুলো শোনার পরে একটাই প্রার্থনা করলাম, সেই হার-না-মানা সৌরভকে আজ ব্যাট ধরতে হবে। খেলা ঘুরবে। ঘোরাতেই হবে।

এই যে কারও কারও মত সৌরভের উপরে ইদানীং কালে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছিল বলেই হৃদরোগের অসুখ বেঁধে গেল কি না, তা নিয়ে একটা কথা বলে দিতে পারি। জীবনে অনেক চাপ সামলেছে ও। কোনও নির্বাচক তাদের ইচ্ছা মতো অধিনায়ক সৌরভের হাতে তাদের পছন্দের টিম তুলে দিতে পারেনি। চার-সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে লড়াই চালিয়ে গিয়েছে যোগ্য ক্রিকেটারদের জন্য। জেনেবুঝেই যে, এই সব নির্বাচকেরাই রুষ্ঠ হয়ে ওকে অধিনায়কত্ব থেকে ছেঁটে ফেলতে পারে। চাপ দিয়ে ওকে কেউ কিছু করাতে পারবে না। মনের সায় পেলে তবেই সৌরভ সেটা করবে, না হলে কখনও নয়, কিছুতে নয়।

সে দিনের সেই না-হওয়া শারীরিক পরীক্ষা ফেলে রাখতে রাখতে অজান্তে হানা দিল এ ভাবে। আসলে গত চার-পাঁচ বছরে নিজের ট্রেনিংয়ের উপরে খুব আস্থা রাখত সৌরভ। ভাবত, এতটা ওজন কমিয়ে ফেলেছে। প্রিয় বিরিয়ানি খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ডিনার করতে গিয়ে দেখেছি, হাল্কা স্যুপ খেয়েও কাটিয়ে দিয়েছে। খুব বেশি হলে এক-দু’পিস চিকেনের টুকরো। বুঝতে পারেনি, এগুলো যথেষ্ট নয়। শরীরে কোথায় কী ঘটে রয়েছে, কখন যে দানব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, কে বলতে পারে!

হাসপাতাল থেকে সৌরভ বাড়ি ফিরছে কাল, বৃহস্পতিবার। শুরু হয়েছিল যে ঝড় দিয়ে, তা এখন কেটে গিয়েছে। তবে সৌরভের সেই ইনিংসের মাঝপথে বহু বার মনে করিয়ে দেওয়া কথাটাই ওকে কাল বাড়ি যেতে যেতে বলব, দেখে খেল। তোকে কিন্তু লম্বা খেলতে হবে।

আর এই ক’দিন নানা রকম দুশ্চিন্তার প্রহর কাটিয়ে ওঠা সামনে থেকে দেখার পরে আমার বিশ্বাস, সব ঠিক হয়ে যাবে। যখন ডাক্তারেরা প্রথম জানিয়েছিলেন, তিনটি স্টেন্ট বসাতে হবে তখন ওকে বলতে শুনেছিলাম, ‘‘অনেকের তো একটাকেই হয়ে যায়, আমার তিনটে বসাতে হবে!’’ সেটা ছিল হতাশার কথা। ওর মুখ থেকে শুনতে যেটা ভাল লাগে না। মঙ্গলবার বলতে শুনেছি, যা হওয়ার হয়েছে, মেনে নাও, এগিয়ে চলো।

এটাই তৌ সৌরভ। এটাই তো আমরা ওর মুখ থেকে শুনে অভ্যস্ত।

খেলা ঘুরবে বন্ধু! খেলা ঘোরাতেই হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sourav Ganguly Cardiac Arrest Woodlands
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE