দুর্দশা: এ রকম অব্যবস্থার মধ্যেই চলছে বাংলার ফুটবল। ফাইল চিত্র
গোটা বিশ্বে ঘরোয়া লিগ থেকে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার তুলে আনার জন্য স্পটার বা নির্বাচকেরা বিভিন্ন মাঠে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখেন। ব্যতিক্রম বাংলার ফুটবলে। শতাব্দীপ্রাচীন কলকাতা লিগের ম্যাচে কখনওই দেখা যায় না স্পটারদের। সর্বভারতীয় স্তরে বাংলা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। নতুন প্রতিভা উঠে না এলে কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলার ফুটবল?
রাজ্যের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা (আইএফএ)-র সচিব জানিয়েছিলেন, কলকাতা লিগে কোনও দিনই স্পটার ছিল না। এখনও তার প্রয়োজন নেই। কলকাতা ময়দানের প্রাক্তন তারকারা আইএফএ সচিবের যুক্তি শুনে বিস্মিত। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ও কোচ প্রদীপকুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায় আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘ফুটবলে উন্নতির জন্য কতগুলো পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ঘরোয়া ফুটবল থেকে নতুন প্রতিভা তুলে আনা। সেটা পারেন স্পটাররাই। বাংলার ফুটবলের উন্নতির জন্য আইএফএ-র উচিত অবিলম্বে স্পটার নিয়োগ করা।’’
পিকের সঙ্গে একমত নন তাঁর প্রাক্তন সতীর্থ ও ভারতীয় ফুটবলের আর এক কিংবদন্তি চুনী গোস্বামী। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতা লিগে কখনওই স্পটার ছিল না। ভাল যে খেলে, সে সব সময়ই নজরে পড়ে। তাই স্পটার রাখার প্রয়োজন নেই।’’ অচ্যুত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঘা সোম, অমল দত্তের মতো জহুরিরা আগে মাঠে মাঠে ঘুরে ফুটবলার তুলে আনতেন। কিন্তু এখন তাঁরা নেই। মাঠে স্পটারও থাকেন না। প্রশ্ন উঠছে তা হলে কী ভাবে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার উঠে আসবে? চুনীর একই জবাব, ‘‘ভাল খেললে নজরে পড়বেই।’’
সমরেশ চৌধুরী রাজি নন চুনীর যুক্তি মানতে। বললেন, ‘‘আমরা যখন খেলতাম, তখন অচ্যুত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঘা সোমের মতো জহুরিরা বিভিন্ন মাঠ ঘুরে ঘুরে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার তুলে আনতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। নিজেদের তাগিদে ফুটবলার তুলে আনার মতো লোকের সংখ্যা কমে গিয়েছে। তাই আইএফএ-র উচিত স্পটার নিয়োগ করা।’’ শুধু আইএফএ নয়, কলকাতার ক্লাবগুলো যে ভাবে চলছে তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে প্রাক্তন তারকার। বললেন, ‘‘ফুটবলার তুলে আনার দায়িত্ব শুধু আইএফএ-র নয়, ক্লাবগুলোরও রয়েছে। ওদের আরও তৎপর হওয়া উচিত।’’ এর পরেই শোনালেন তাঁর ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ার কাহিনি। বললেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের কেউ আমার খেলা দেখে জ্যোতিষ গুহকে জানিয়েছিলেন। তার পরেই আমাকে তিনি সই করান। এখন মাঠে গিয়ে খেলা দেখার মতো লোকের সংখ্যাই ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তাই নতুন ফুটবলারও উঠে আসছে না।’’
মোহনবাগানের প্রাক্তন অধিনায়ক সুব্রত ভট্টাচার্য মনে করেন পেশাদারিত্ব না এলে বাংলার ফুটবলে উন্নতি সম্ভব নয়। তাঁর মতে প্রাক্তন ফুটবলারদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত নতুন প্রতিভা খুঁজে বার করার জন্য। সুব্রতর কথায়, ‘‘বিদেশের ফুটবল ফেডারেশন প্রাক্তন ফুটবলারদের নিয়োগ করে। এর জন্য তাঁদের পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের এখানে মানসিকতা হচ্ছে, বিনা অর্থে কাজ আদায় করে নেওয়া। এ ভাবে উন্নতি করা সম্ভব নয়।’’
ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন অধিনায়ক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করেন শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার জন্য নয়, গড়াপেটা আটকাতেও স্পটার থাকা প্রয়োজন! তিনি বললেন, ‘‘স্পটার কখনও দেখিনি। স্পটার না থাকায় প্রচুর ম্যাচ গড়াপেটা হয়। এ ভাবেই চলছে। কী আর বলব!’’ সুব্রতর মতো মনোরঞ্জনও মনে করেন, বিনা পারিশ্রমিকে কেউ দায়িত্ব নিয়ে আগ্রহ দেখাবেন না। বললেন, ‘‘স্পটার রাখতে পারলে ভালই হতো। কিন্তু অর্থের অভাবে অনেক কিছুই করা যাচ্ছে না। নিয়মিত মাঠে যাওয়ার জন্য পারিশ্রমিক দিতে হবে। এই মুহূর্তে আইএফএ-র যা অবস্থা তা সম্ভব নয়।’’
ক্ষোভ উগরে দিলেন আর এক প্রাক্তন তারকা মিহির বসুও। বললেন, ‘‘বাংলার ফুটবলে অবক্ষয় শুরু হয়েছে। কলকাতা লিগ নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, তত ভাল। জেলা লিগ তো শেষ হয়ে গিয়েছে। আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ মণিপুর, মেঘালয়, মিজ়োরামের উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘‘গত কয়েক বছরে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যগুলো ফুটবলে দারুণ উন্নতি করেছে। আমাদের সেই জায়গায় পৌঁছতে হলে পুরো পরিকাঠামো বদলে ফেলতে হবে। প্রচুর ডিগ্রিধারী কোচ বসে রয়েছেন। তাঁদের ঠিক মতো কাজে লাগানো হচ্ছে না। সব প্রাক্তন ফুটবলারদের টিকিটও দেওয়া হয় না।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘আইএফএ সচিব চেষ্টা করছেন। কিন্তু অন্যান্যরা সাহায্য করছেন না।’’
এ দিকে, আর্মান্দো কোলাসো আনন্দবাজারকে ই-মেল করে জানালেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। কখনও তাঁদের আঘাত দিতে চাইনি। কোচিং করানোর সুযোগ দেওয়ায় ইস্টবেঙ্গলের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy