Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

লায়ন গর্জন থামিয়ে হুঙ্কার ভারতের, বডিলাইনের মঞ্চে রুদ্ধশ্বাস ইতিহাস

৬৮ বল আর ৩২ রানের দশম উইকেট থ্রিলার শেষ হল। জশ হেজলউড দ্বিতীয় স্লিপে তালুবন্দি। সমস্ত নজর তখন বিরাট কোহালির উপরে।

উল্লাস: জয় দিয়ে সিরিজ শুরু। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেট নিয়ে উচ্ছ্বাস কোহালিদের। গেটি ইমেজেস।

উল্লাস: জয় দিয়ে সিরিজ শুরু। অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেট নিয়ে উচ্ছ্বাস কোহালিদের। গেটি ইমেজেস।

সুমিত ঘোষ 
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০০
Share: Save:

৬৮ বল আর ৩২ রানের দশম উইকেট থ্রিলার শেষ হল। জশ হেজলউড দ্বিতীয় স্লিপে তালুবন্দি। সমস্ত নজর তখন বিরাট কোহালির উপরে।

স্বভাবসিদ্ধ আগ্রাসী বিজয়োৎসব দিয়ে শুরু করলেন ভারত অধিনায়ক। সেই গর্জন। মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে ‘কাম অন, কাম অন’ বলা। শূন্যে লাফিয়ে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ভঙ্গিতে দলকে তাতানোর চেষ্টা। কিন্তু অ্যাডিলেড ব্যতিক্রম হয়ে থাকল। কোহালি নিজেই এই ছবিকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দিলেন না।

এক মিনিটের মধ্যেই বিজয়োৎসব থামিয়ে ভারত অধিনায়ক এগিয়ে গেলেন প্রতিপক্ষের এগারো নম্বর ব্যাটসম্যানের দিকে। বিষণ্ণ মুখচোখ নিয়ে জশ হেজলউড তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ৪৩ বল ধরে মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন হেজলউড। সেই সময়ে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল ‘ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া’ ধ্বনি। তেমনই বাড়ছিল অস্ট্রেলীয় সমর্থকদের হাততালি। ধুকপুকুনি বাড়িয়ে দিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছিল চেন্নাইয়ের টাই টেস্ট। আবার সে রকম কিছু হতে যাচ্ছে না তো?

আরও পড়ুন: অ্যাডিলেডে ঐতিহাসিক টেস্ট জয় ভারতের, দেখুন কিছু মুহূর্ত

হার্ট অ্যাটাক করানোর মতো অবস্থা তৈরি করেও যে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ পিছলে গেল না, তার প্রধান কারণ যশপ্রীত বুমরা। যখনই মনে হয়েছে অস্ট্রেলীয় প্রতিরোধ ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে শুরু করেছে, বুম বুম বুমরা মিসাইল বর্ষিত হয়েছে। শেষ দিনের রুদ্ধশ্বাস ক্রিকেটে প্রত্যেকটা মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া উইকেট তাঁর নেওয়া। শন মার্শ (১৬৬ বলে ৬০), অধিনায়ক টিম পেন (৭৩ বলে ৪১) এবং প্যাট কামিন্স (১২১ বলে ২৮)। জেফ থমসন একদম ঠিক বলেছেন যে, উইকেট তোলার দরকার হলে বুমরার দিকে বল ছুড়ে দাও। আবার এটা লিখতে গিয়েই মনে হচ্ছে, উল্টোটাও তো ঠিক। যখনই বুমরা উইকেট নিয়েছেন আর মনে হয়েছে, ভারত এ বার বাকিদের সাবাড় করে দেবে, তখনই ফের রুখে দাঁড়িয়েছেন অস্ট্রেলীয় টেলএন্ডাররা। কী অসাধারণ একটা টেস্ট ম্যাচ!

নায়ক: ভারতকে টেস্ট জিতিয়ে সমর্থকদের আবদার মেটাচ্ছেন ম্যাচের সেরা পূজারা। সোমবার অ্যাডিলেডে। ছবি: এপি।

কোহালির সৌজন্যের ছবি যদিও হেজলউড দিয়েই শেষ হল না। অন্য প্রান্তে তখন হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছেন নেথান লায়ন। সিংহের মতোই যিনি লড়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত এবং দাঁতে দাঁত চেপে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়া অভাবনীয় জয় তুলে নেওয়ার সমস্ত রকম ব্যবস্থা করেছিলেন। কঠিন হয়ে ওঠা শেষ দিনের পিচে দশ নম্বর ব্যাটসম্যান লায়ন করে গেলেন ৩৮ নট আউট। কোহালি এ বার তাঁকে টেনে তুলতে গেলেন। ভারত অধিনায়ক জানেন, তাঁরা জিতেছেন কিন্তু লায়নরাও হারেননি! জানেন, এটা সেই আলেকজান্ডার আর পুরুর যুদ্ধের মতোই হল।

সংযত কোহালি বলে গেলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়া যে লড়বে সেটা আমরা ধরেই রেখেছিলাম। জিতবই বলে কখনও কুশনে গা এলিয়ে দিইনি। ওদের টেলএন্ডাররা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সেরা।’’ বললেন, টেস্ট জিতে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চান না। ‘‘আমাদের লক্ষ্য সিরিজ জেতা। একটা-দু’টো দারুণ মুহূর্ত নিয়ে আর ফিরে যেতে চাই না কেউ।’’
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস ও পরিসংখ্যানকে ওলটপালট করে দেওয়া একটা জয়। এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় এসে প্রথম টেস্টেই জিতল কোনও ভারতীয় দল। পঞ্চাশ বছর ধরে গত এগারো বারের সফরে কখনও যা ঘটেনি। একই ক্যালেন্ডার বর্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো তিনটি কঠিন বিদেশ সফরে তিনটি টেস্ট জয় আর কোনও ভারতীয় দলের নেই। এশিয়ার প্রথম অধিনায়ক হিসেবে এই তিন দেশে টেস্ট জিতলেন কোহালি।
অ্যাডিলেডে এই নিয়ে দ্বিতীয় টেস্ট জয়। এর আগে ২০০৩-এ সৌরভের ভারত জিতেছিল। সে বারে ডাবল সেঞ্চুরি এবং দ্বিতীয় ইনিংসে সত্তরের উপর রান করে ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। এ বারে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ দ্রাবিড় স্কুলের ছাত্র চেতেশ্বর পূজারা। হাইস্পিড ফেরারি গাড়ির মতো ভারতীয় ব্যাটিংকে যখন বিদেশের হাইওয়েতে বেসামাল দেখায়, উদয় হন পূজারা। নিজের নিয়ন্ত্রিত গিয়ারে ফেলে তারকাখচিত ফেরারিকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করেন। ঠিক যেমন দ্রাবিড় করে গিয়েছেন নিঃশব্দে, অনুচ্চারিত ভঙ্গিতে। প্রথম ইনিংসে চল্লিশের ঘরে যখন দলের রান, চার উইকেট চলে গিয়েছিল। পূজারার সেঞ্চুরি না থাকলে শেষ দিনের মহাকাব্য লেখাই হয় না।

আরও পড়ুন: সিরিজ জয়ের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে চান কোহালি

এ বারে স্টিভ স্মিথ আর ডেভিড ওয়ার্নারের অনুপস্থিতিতে শুরু থেকেই একটা সিরিজ জয়ের হাওয়া উঠেই রয়েছে। অ্যাডিলেডে ৩১ রানের জয় সেই হাওয়াকে আরও জোরালো করে দিয়ে গেল। অ্যালান বর্ডার থেকে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শেন ওয়ার্ন— অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তিরাও মনে করছেন, ভারতই এ বারে ফেভারিট। তাঁদের বক্তব্য, কোহালি এখনও বড় রান পাননি। পার্‌থ, মেলবোর্ন, সিডনিতে তিনি পুষিয়ে তোলার চেষ্টা করবেন। সেটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য চিন্তার কারণ।

ভারতীয় সমর্থকদের বিদেশি গ্রুপ ‘ভারত আর্মি’ দেখা গেল অ্যাডিলেডেই গান তৈরি করে ফেলেছে। ‘ওয়ান নিল, ওয়ান নিল (১-০)’। তার পরেই দ্বিতীয় লাইন— ‘আমরা কী চাই? ফোর নিল, ফোর নিল (৪-০)’। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারেরা কয়েক জনে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে তাঁদের সেই গান শুনতে শুনতে বাসে উঠে গেলেন। কে ভেবেছিল, নিজেদের দেশে এতটা পরাভূত, বিহ্বল দেখাতে পারে কোনও অস্ট্রেলীয় দলকে!

কিন্তু বার বারই মনে হচ্ছে, ভারত জিতেছে তবে অস্ট্রেলিয়া হেরেও হারেনি। ক্রিকেট বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাদের দেশ। বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারিতে স্টিভ স্মিথ এবং ডেভিড ওয়ার্নারের মতো মহাতারকা নির্বাসিত। ভারতের কোহালি এবং পূজারা না থাকার সমান সেটা।

বিতর্ক বলায় মনে পড়ে যাবে, অ্যাডিলেডেই চরম আকার নিয়েছিল বডিলাইন। এখানেই ডগলাস জার্ডিনের অস্ত্র হ্যারল্ড লারউডের বাউন্সার এসে আছড়ে পড়ে বিল উডফুলের হৃৎপিণ্ডে। বুক চেপে মাটিতে বসে পড়েন উডফুল। ক্ষিপ্ত জনতা ধিক্কার দিতে থাকে জার্ডিনের টিমকে। অবিচলিত জার্ডিন এগিয়ে এসে লারউডকে বলেছিলেন ‘‘ওয়েল বোল্ড।’’ তার পরেই উডফুলের সেই ঐতিহাসিক মন্তব্য, ‘‘এখানে দু’টো টিম খেলছে। একটা ক্রিকেট খেলছে। অন্যটা নয়।’’ অভিশপ্ত সেই অ্যাডিলেডে সৌজন্য ফিরতে দেখে খারাপ লাগার কথা নয় স্যর ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের। অ্যাডিলেডের ২, হোল্ডেন স্ট্রিটের প্রয়াত বাসিন্দা
ছিলেন তিনি।

এ দিন যখন যশপ্রীত বুমরার বাউন্সার গিয়ে লাগল মিচেল স্টার্কের হেলমেটে আর ভারতীয় পেসার এসে সহমর্মিতার সঙ্গে স্টার্কের কাঁধে হাত রাখলেন, কোথাও যেন বডিলাইন তিক্ততার শাপমোচন ঘটল। তিনি ডন ব্র্যাডম্যান— দেখে থাকলে হয়তো বিড়বিড় করে উঠতেন, কী জার্ডিন, কী লারউড, তোমরা দেখছ? সৌজন্য না হারিয়েও জেতা যায়!

নতুন অস্ট্রেলিয়ার এটাই তো লাইন— স্লেজিং বন্ধ করো। জিতব কিন্তু সৌজন্য না হারিয়ে জিতব। জার্ডিনের সেই বডিলাইন হানার মতোই সংকটে পড়েছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট। টিম পেনদের কাছে তাঁদের দেশ জয় চায়নি, সততা চেয়েছে। স্লেজিং চায়নি, সভ্যতা-সংস্কৃতি দেখতে চেয়েছে। লড়াই দেখতে চেয়েছে। তাঁরা সেটা দিতে পেরেছেন। অস্ট্রেলিয়ার শেষ তিন উইকেট মিলে যোগ করল ১০৪ রান! টেলএন্ডারদের এমন দুঃসাহসিক প্রতিরোধ খুব কমই দেখা গিয়েছে।
বলে না ক্যাঙারুর লেজ— তার শক্তিশালী অঙ্গ! অস্ট্রেলিয়ার ‘টেল’ আবারও তা মনে করিয়ে দিয়ে গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE