Advertisement
E-Paper

সিন্ধুর রুপোলি রেখাতেও মুছছে না অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা

উসেইন বোল্ট যখন শুক্রবার রাতে অলিম্পিক্স ইতিহাস গড়ছিলেন, পাশে বসা জামাইকার এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বোল্ট অলিম্পিক্সে ট্রিপল ট্রিপল করে অবসর ঘোষণা করে দিলেন। ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম, এ বার কী হবে আপনাদের দেশের?

দীপিকা: প্রি কোয়ার্টারে হার, জিতু রাই: দু’ইভেন্টে ব্যর্থ

দীপিকা: প্রি কোয়ার্টারে হার, জিতু রাই: দু’ইভেন্টে ব্যর্থ

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:২৩
Share
Save

উসেইন বোল্ট যখন শুক্রবার রাতে অলিম্পিক্স ইতিহাস গড়ছিলেন, পাশে বসা জামাইকার এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বোল্ট অলিম্পিক্সে ট্রিপল ট্রিপল করে অবসর ঘোষণা করে দিলেন। ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম, এ বার কী হবে আপনাদের দেশের? বোল্টই তো আর থাকলেন না? ভদ্রলোক স্মিত হেসে উত্তর দেন, ‘‘বোল্ট জিনিয়াস। কিন্তু টোকিওয় আমাদের ফল খারাপ হবে না। পরের প্রজন্ম রেডি। দেখলেন না, একশো মিটারে শেলিকে হারিয়ে কী ভাবে সোনা নিয়ে গেল আমাদের অন্য একটা মেয়ে?’’

কিনিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গেও মিডিয়া বাসে আসা-যাওয়ার সময় প্রায়ই কথা হয়। দেখলাম, অনেকেই হতাশ। ব্যাপার কী? না, যথেষ্ট সোনা পায়নি দেশ, তাই। চারটে সোনা আর তিনটে ব্রোঞ্জ। আরও বেশি সোনা নাকি পাওয়া উচিত ছিল। শুনতে শুনতে জামাইকার পদক হিসেবটা দ্রুত মনে পড়ে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওই ভূখণ্ডের আর্থিক অবস্থা নাকি ভাল নয়। বেছে-বেছে অ্যাথলিট পাঠাতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৯ জন। চারটে বিভাগের বেশি লড়াও যায়নি। পদক তালিকা খুলে দেখি, তবু ছ’টা সোনা। দু’টো ব্রোঞ্জ।

আর আমাদের দু’টো। শনিবার রাত পর্যন্ত দু’টো।

কিনিয়া, জামাইকা, বিশ্বের এই ছোট-ছোট দেশগুলোর পাশে অলিম্পিক্স মহাসমুদ্রে নিজ দেশের পদক মানচিত্র আঁকতে বসলে ভাল লাগে যেমন, আবার একটা চোরা দুঃখও কোথাও যেন মন ছুঁয়ে যায়। দু’টো মন যেন হাঁটে পাশাপাশি।

জামাইকার একটা বোল্ট থাকতে পারে। তিনি শুক্রবারের ট্রিপল, ট্রিপলের পর বিশ্বের সর্বকালের সেরা দৌড়বীর হয়ে গেলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদেরও তো একটা পিভি সিন্ধু আছে। যিনি সোনা না পেলেও গোটা একটা জাতির মধ্যে ব্যাডমিন্টন নিয়ে চেতনা জাগিয়ে চলে গেলেন। মধ্যবিত্ত মনন এ বার তো সন্তানকে ক্রিকেট ব্যাটের বদলে একটা ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেট ধরানোর কথা ভাবতে পারবে। সাক্ষী মালিক—তিনিও বা কম কী? ভারতের মেয়েরাও যে কুস্তিতে আন্তর্জাতিক খেলাধুলোর শ্রেষ্ঠ মঞ্চে দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে পারে, আনতে পারে পদক, তা তো কোনও এক সাক্ষী মালিকই শিখিয়ে গেলেন। শোনা যায়, হরিয়ানার যে গ্রাম থেকে মালিকের উঠে আসা, সেই গ্রামই নাকি ছোট থেকে তাঁর প্রতিবন্ধকতা ছিল। তারাই বলেছে, মেয়ে হয়ে জন্মে আবার কুস্তি লড়বে কী? ওই অবস্থা থেকে সাক্ষী যা করে গেলেন, তার পর ভারতের কোনও গ্রামে আর কোনও মহিলা কুস্তিগিরের বৈরিতার মুখে পড়া উচিত নয়। কাঞ্চনমূল্যে বিচার হয় এর? পদকের দাঁড়িপাল্লায় তুলে মাপা যায় এই প্রাপ্তির হিসেবকে?

ওহ, দীপা কর্মকারের কথাটা লেখাই হয়নি। বাঙালি কন্যা জিমন্যাস্টিক্স-দুনিয়ায় ভারতকে যে সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, তুলনা হয়? ভারত এত দিন ভাবতেও পারত না জিমন্যাস্টিক্সে তারও সম্ভ্রমের জায়গা হতে পারে। বাঙালি এত দিন ভাবতেও পারত না, কোনও এক সিমোন বাইলস তারই এক প্রতিনিধিকে বাহবা দিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারে। চার একটা পজিশন মাত্র। পদক পোডিয়ামে জায়গা হয়নি দীপার। কিন্তু জিমন্যাস্টিক্স নিয়ে ভবিষ্যৎ আশার পোডিয়ামে? তার স্বর্ণপদক কিন্তু বাঙালির গলাতেই চিরকাল ঝুলবে!

কিন্তু ওই যে, আর একটা মন। চোরা দুঃখ, চাপা কষ্ট যার সঙ্গী। কিনিয়া-জামাইকাকে দেখলে যে প্রশ্ন তুলে দেয়, ওরা এত পেলে আমরা নয় কেন? আমাদের কেন থাকবে না একটাও সোনা? ৪৮২ কোটি টাকা এ বার অলিম্পিক্সের পিছনে খরচ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কখনও সাই-কে সামনে রেখে, কখনও বিদেশি কোচদের পিছনে। টার্গেট পোডিয়াম— শব্দবন্ধকে সামনে রেখে।

সরকারি হিসেব বলছে, শ্যুটারদের পিছনেই খরচ হয়েছে ৪৩ কোটি। অলিম্পিক্সে ভাল করতে হলে টাকা লাগবেই। সেটা যুক্তি নয়। কিন্তু এত খাটাখাটনির পর কপাল পুড়লে খারাপটাও যে ততধিক লাগে। বারো জন শ্যুটার এসেছিলেন রিওতে। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কোচ। কিন্তু তার পরেও জিতু রাই, অভিনব বিন্দ্রারা স্বপ্ন দেখিয়েও পারলেন না। অভিনব তো অল্পের জন্য চতুর্থ হলেন। মন খারাপ হবে না এর পর? তিরন্দাজি— সেখানেও এক। দীপিকা কুমারী, বোম্বাইলা দেবীরা আশার বুদ্বুদ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু বুদ্বুদেই থেকে গেল। টেবল টেনিস, অ্যাথলেটিক্স, বক্সিং, রোয়িং, হকি— সব জায়গাতেই একই মন খারাপের ছবি, অন্ধকারের কাহিনি।

পিভি সিন্ধুর ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন ভারতের হকি প্লেয়াররা। কোচ রোনাল্ট অল্টম্যান্সকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার টিম পারল না। গ্রুপে জার্মানি আর কানাডা ম্যাচে পয়েন্ট নষ্ট না হারালে ভাল কিছু হত না? ডাচ কোচ কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলেন, ‘‘সামনের দিকে তাকান। যা হয়নি, তা নিয়ে ভেবে তো লাভ নেই।’’ সামনে মানে, টোকিও। কে জানে, ওখানেও হবে কি না। পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে দেখে দ্রুত চলে যান ডাচ কোচ। রূপেন্দ্র, সৃজেশরাও। একরাশ প্রশ্ন রেখে। সিন্ধুদের ইতিহাসের গৌরব-চাদরে যা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু গৌরব না এলে কী হত? ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।


গ্রুপ পর্বে বিদায় সাইনার, রুপো পেলেন সিন্ধু

সাইয়ের কাছ থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করলেই টাকা পাওয়া গিয়েছে শোনা গেল। দেশে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের জন্য টাকার প্রয়োজন, সাই নাকি তা-ও দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও ধোঁয়াশা। অ্যাথলেটিক্সের চিফ কোচ বাহাদুর সিংহ বলছিলেন, ‘‘বিকাশ গৌড়ার মতো তিন চারজন আছে, যারা কোথায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আমি রিও আসার আগে জানতামই না।’’ পঞ্জাব, হরিয়ানার কয়েক জন অ্যাথলিট শুনলাম সাইয়ের টাকায় দামি গাড়ি কিনে ফেলেছেন! কলকাতার এক অলিম্পিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সাই প্রদত্ত পুরো টাকাটাই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ফেলে পাড়ার ক্লাবে ট্রেনিং নিয়ে অলিম্পিক্স খেলতে চলে এসেছিলেন! সাই ডিরেক্টর ইনজেতি শ্রীনিবাসন কয়েক দিন আগে প্রশ্নটা শুনে উত্তেজিত ভাবে বলেছিলেন, ‘‘অপেক্ষা করুন না। এখনও তো বাকি আছে খেলা।’’ অপেক্ষা করে দু’টো পদক এসেছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার পাশের চাপ চাপ অন্ধকারকেও একেবারে উপেক্ষা করা যায় কি? নরসিংহ যাদব তো সিন্ধু-সভ্যতা স্থাপনের দিনই নিজেকে চরম লজ্জায় ডুবিয়ে দিলেন ওয়াডা-মামলায় কোর্ট অফ আরবিট্রেশনে হেরে, চার বছরের নির্বাসনের অপমানে নিমজ্জিত হয়ে।

রবিবার, অলিম্পিক্সের শেষ দিনে কুস্তির ৬৫ কেজি বিভাগে নামবেন ভারতের যোগেশ্বর দত্ত। অলিম্পিক্স পদক আছে তাঁর। জানা নেই, তিনি আবারও পারবেন কি না। জানা নেই, রিও মহাযুদ্ধের শেষ দিনে ভারতকে তিনি পদক দিতে পারবেন কি না। পারলে নিঃসন্দেহে ভাল। ভারত পাবে আর এক গৌরবের রাত। দুঃখী মনের চোরাকুঠুরিতে তালাচাবি ঝুলিয়ে আনন্দে ফেরা যাবে রিও থেকে। ফেরা যাবে সুখ নিয়ে। কিন্তু কে জানে কেন মনে হচ্ছে, শেষ দিনে পদক এলেও শান্তিটা অপার হবে না। তার জন্য আরও কিছু দরকার। টোকিওয় আরও কিছু পদক দরকার। এ সব ছাইচাপা বিতর্ক থামাতে। সুখী আবহাওয়াতেও প্রশ্নের চোরাগোপ্তা আক্রমণ বন্ধ করতে।

শোভা দে-দের সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে জবাবটা বোধহয় আরও ঝাঁঝালো হওয়া দরকার!

Rio Olympics Saina Nehwal PV Sindhu

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}