Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের সিংহাসনে বসার দৌড়েও জয়ী ভারত

পুজোর আগে শেষ রবি-সন্ধ্যায় ধর্মতলায় ব্যস্ততা আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ট্র্যাফিক জ্যামে যেমন লুকিয়ে উৎসবের উত্তেজনা, তেমন প্রতি বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারিতে ইডেনের গ্যালারিতে ওঠা ঢাকের আওয়াজেও আগমনির সুর। এমন উৎসবের আবহে বিরাট কোহালির সংসারেও এখন বাজছে উৎসবের ‘প্রিলিউড’।

ইডেনে নেমেই মেজাজে রোহিত।

ইডেনে নেমেই মেজাজে রোহিত।

রাজীব ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:১৩
Share: Save:

পুজোর আগে শেষ রবি-সন্ধ্যায় ধর্মতলায় ব্যস্ততা আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ট্র্যাফিক জ্যামে যেমন লুকিয়ে উৎসবের উত্তেজনা, তেমন প্রতি বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারিতে ইডেনের গ্যালারিতে ওঠা ঢাকের আওয়াজেও আগমনির সুর। এমন উৎসবের আবহে বিরাট কোহালির সংসারেও এখন বাজছে উৎসবের ‘প্রিলিউড’।

ইডেনে কোহালিরা জয় দেখতে পাচ্ছেন যে।

টেস্ট জয়। সিরিজ জয়। আর টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের সিংহাসনে বসার দৌড়েও জয়।

রস টেলরদের কাঁধে চারশোর বোঝা চাপাতে সোমবার আরও ৬১ দরকার ভারতের। আর ঋদ্ধিমান সাহা দ্বিতীয় ইনিংসের হাফ সেঞ্চুরির মাইলফলক থেকে আর মাত্র ১১ ধাপ দূরে।

অথচ ঘণ্টা দুয়েক আগেও ভারত ফের চলে গিয়েছিল এলওসি-র কাছাকাছি। ৪৩-৪-এ। প্রথম ইনিংসের মতোই। আগের বার অজিঙ্ক রাহানে-চেতেশ্বর পূজারা দলকে খাদের কিনারা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ বার সেটা করলেন রোহিত শর্মা। সঙ্গে ‘ঘরের ছেলে’ ঋদ্ধি। আবার।

ইডেনের সঙ্গে তাঁর ‘অ্যাফেয়ার’ যে এখনও চলছে, সেটাই এ দিন বুঝিয়ে দিলেন রোহিত। সেই ইডেনেই ফের নিজেকে মেলে ধরলেন তিনি। সুন্দরী ইডেন এখন বলতেই পারে, ‘‘লক্ষ্মণ আমার অতীত, রোহিত বর্তমান।’’

ইডেন এমনই। কারও না কারও প্রেমে পড়েই থাকে। কখনও আজহার, কখনও লক্ষ্মণ তো কখনও হরভজন, আবার কখনও রোহিত শর্মা। ইডেন এখন রোহিতের প্রেমে মজে। যে প্রেমপর্ব তিন বছর আগে অভিষেক টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৭৭-এর ইনিংস দিয়ে শুরু। তার পর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওয়ান ডে-তে চিরস্মরণীয় ২৬৪। আর এই ৮২। রবিবার বিকেলে এই মধুর সম্পর্কে যেন কাঁটা হয়ে উঠলেন ইংরেজ আম্পায়ার। কট বিহাইন্ড হলেন বটে, কিন্তু টিভির স্নিকোমিটারে রোহিতের ব্যাটে বল ছোঁয়ার কোনও প্রমাণ পাওয়া গেল কই?

কানপুরেও দ্বিতীয় ইনিংসে হাত খুলেছিলেন, এখানেও তাই। মুম্বইয়ের এক বর্ষীয়ান ক্রিকেট লিখিয়ে টুইটারে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘রোহিত, তোমার দ্বিতীয় ইনিংসটা প্রথম ইনিংসে খেল না কেন?’’

‘ইয়ে জিন্দেগি হ্যায় এক জুয়া’ গানটা বিরাট কোহালির প্রিয় কি না জানা নেই। এই ইডেন-মঞ্চেই কোহালি বুঝিয়ে দিলেন ফাটকা খেলতে তিনি ভালবাসেন। আগের দিন তাঁকে এক ফাটকায় জিতিয়েছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। এ দিন জেতালেন রোহিত।

সিরিজের আগে রোহিতের টেস্ট দলে থাকা নিয়ে কম চর্চা হয়নি। তিনি সীমিত ওভারে স্পেশালিস্ট। কেন টেস্ট দলে থাকবেন? এই প্রশ্ন উঠেছিল বারবার। কোহালি কিন্তু রোহিত-জেদে অটল ছিলেন। নির্বাচকদের বুঝিয়েছিলেন, প্রথম এগারোয় একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান নেওয়ার সুযোগ থাকলে সে রোহিতই হওয়া উচিত। ক্যাপ্টেনের সেই আস্থার প্রতি সুবিচার করলেন এ দিন। যেমন করেছিলেন কানপুরেও। এখন ক্রিকেট মহলও কোহালির পাশে। ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ অংশুমান গায়কোয়াড় যেমন বলেই দিলেন, ‘‘কোহালি যে অনেক দূরের চিন্তা ভাবনা করে এগোচ্ছে, এই একটা সিদ্ধান্তেই সেটা প্রমাণ হয়ে গেল।’’

একটা দিক সারাতে গেলে অন্য কোনও একটা দিক খসে পড়ে যায়। এ দিক থেকে দেখলে ভারতীয় ক্রিকেট দল যেন বহু পুরনো দিনের ইমারতের মতো। না হলে রোহিতের টেস্ট দলে জায়গা পাকা হওয়ার দিনে শিখর ধবনের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়? রবিবার ফের সঠিক ফুটওয়ার্কের অভাবে আউট হয়ে গেলেন ধবন। তার আগে বোল্টের সাঙ্ঘাতিক একটা বলে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে চোট পান। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাঁর আঙুলে স্ক্যান করা হয়। চিড় ধরলে ইন্দওর টেস্টে অনিশ্চিত। কিন্তু চিড় না ধরলেও কি নিশ্চিত হবেন ? বোধহয় না। নর্থ সাউন্ডে সেই ৮৪-র পর টেস্টে আর কোনও বড় রান নেই তাঁর। তা হলে আর দলে কেন থাকবেন? সেই প্রশ্নই উঠছে এখন। প্রিয় ইডেনের বুকেই গম্ভীরের মুখে হাসি ফোটা শুরু হল বোধহয়।

গ্যালারিতে গত দু’দিনের খরার পর রবিবারের ইডেনে যাঁর টানে এসেছিলেন অন্তত তিন গুণ বেশি মানুষ, যাঁর জন্য পিকনিক মুডে চলে এসেছিল ক্রিকেটের নন্দনকানন, সেই ভারত অধিনায়ক রানে ফেরার রাস্তা তৈরি করেও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারলেন না। বোল্টের একটা শর্ট বল যে ভাবে হঠাৎ নেমে যাওয়ায় তিনি এলবিডব্লিউ-র ফাঁদে পড়ে গেলেন, তাতে হয়তো ইডেনের এই উইকেটকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না। সকালে ম্যাচ শুরুর আগে বেশ খানিকক্ষণ বীরেন্দ্র সহবাগের সঙ্গে কথাবার্তা হয় তাঁর। টিভিতে প্রি ম্যাচ শোয়ের তাড়া থাকায় সে কথা শেষ না হলেও নজফগড়ের নবাবের ক্রিকেট সম্পদের যে ছিটেফোঁটা নিতে পারলেন, তাতেই বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল তাঁকে। বোলারদের শাসন করার জন্য বড় শট খেলা শুরু করেন। টেস্টেও ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট তাঁর কাছে সত্যিই যে গুরুত্বপূর্ণ, পরপর কয়েকটা বাউন্ডারি মেরে ৩৮ বলে ৩৫ তুলে তা বুঝিয়েও দেন। সেই চেনা কোহালিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল যখন, হাফ সেঞ্চুরি থেকে যখন পাঁচ রান দূরে, ঠিক তখনই ধোঁকা খেয়ে গেলেন। সেই সময় উল্টো দিকে থাকা রোহিত খেলার পর বলছিলেন, ‘‘বিরাটের মতো ব্যাটসম্যানকে এ রকম আউট হতে দেখে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু এটাও ঠিক যে এ রকম উইকেটে সব সময় সাবধান থাকতে হয়। এক সেকেন্ড অসাবধান হওয়া মানেই এ রকম বিপদে পড়তে হবে।’’ খেলা শেষের পর ফের সহবাগের কাছে যান বিরাট। বাকি কথাটুকু বলতে।

কখনও বল মাথাসমান উচ্চতায় উঠছে তো কোনও সময় হঠাৎ নেমে যাচ্ছে। ইডেনের এই বাইশ গজ যেন ক্রমশ রহস্যময়ী নারী হয়ে উঠছে। সে তার মর্জিমাফিক চলে। কখন কার প্রতি প্রেম নিবেদন করবে, কেউ জানে না। কলকাতা লন্ডন হওয়ার আগে ইডেন গার্ডেন্সকে ইডেন পার্ক বানিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রায় বেনজির একটা মাইলস্টোন তৈরি করে রাখলেন। কোহালি এই নিয়ে কী ভাবছেন, তা দু-এক দিন পরে হয়তো জানা যাবে। কিন্তু এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে ক্রিকেট মহল। বোর্ডের চিফ কিউরেটর দলজিৎ সিংহ যাঁদের অন্যতম। রবিবার চণ্ডীগড় থেকে ফোনে জানালেন, ‘‘খুব ভাল উইকেট। এত জমজমাট একটা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে যেখানে, সেখানকার উইকেটকে ভাল বলতেই হবে।’’


যেন বুঝিয়ে দেওয়া ক্রিকেট বোর্ড আর সরকার আলাদা নয়। রবিবার ইডেনে বিরাট কোহালিদের ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’।

এই দলজিতের তৈরি জোরজবরদস্তির র‌্যাঙ্ক টার্নারেই গত বছর মোহালিতে সাড়ে তিন দিনে টেস্ট জিতে কোহালি সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘হোম অ্যাডভান্টেজ নেওয়াতে কোনও অন্যায় নেই। এখন থেকে এ রকমই হবে। হোম সিরিজে আমরা টার্নারেই খেলব।’’ অসময়ে সিএবি-র উপর একটা টেস্ট চাপিয়ে দেওয়ার জবাব যেন এ ভাবেই দিল সৌরভের সিএবি। পাশাপাশি একটা বার্তাও দিয়ে রাখল। ভাল উইকেটে ভাল ক্রিকেট খেলে জয় অর্জন করো। অর্ডারি উইকেটে স্পিনারদের দিয়ে বিদেশিদের বধ করে নয়।

এমন উইকেট যে, প্রথম ইনিংসে আট ওভারের বেশি বল করতেই হল না রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে। ঘরের মাঠে টেস্টে একটা প্রমাণ সাইজের ইনিংসে এত কম বল করেননি অশ্বিন।

দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ড বধে তাঁকে কাজে লাগবে কি না, তা সময়ই জানে। কিন্তু তিন দিন খেলা হওয়ার পরও আশ্বিনের ইডেনে অশ্বিনের এমন নির্বিষ হয়ে থাকা সত্যিই বিরল ঘটনা।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

ভারত
প্রথম ইনিংস: ৩১৬

নিউজিল্যান্ড
প্রথম ইনিংস (আগের দিন ১২৮-৭)

ওয়াটলিং এলবিডব্লিউ শামি ২৫
পটেল ক শামি বো অশ্বিন ৪৭
ওয়্যাগনার এলবিডব্লিউ শামি ১০
বোল্ট ন.আ. ৬

অতিরিক্ত ১৯, মোট ২০৪।

পতন: ১০, ১৮, ২৩, ৮৫, ১০৪, ১২২, ১২২, ১৮২, ১৮৭।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ১৫-২-৪৮-৫, শামি ১৮-১-৭০-৩, জাডেজা ১২-৪-৪০-১, অশ্বিন ৮-৩-৩৩-১।

ভারত
দ্বিতীয় ইনিংস

বিজয় ক গাপ্টিল বো হেনরি ৭
ধবন এলবিডব্লিউ বোল্ট ১৭
পূজারা এলবিডব্লিউ হেনরি ৪
বিরাট এলবিডব্লিউ বোল্ট ৪৫
রাহানে ক বোল্ট বো হেনরি ১
রোহিত ক রঙ্কি বো স্যান্টনার ৮২
অশ্বিন এলবিডব্লিউ স্যান্টনার ৫
ঋদ্ধিমান ন.আ. ৩৯
জাডেজা ক পরিবর্ত (নিশাম) বো স্যান্টনার ৬
ভুবনেশ্বর ন.আ. ৮

অতিরিক্ত ১৩, মোট ২২৭-৮।
পতন: ১২, ২৪, ৩৪, ৪৩, ৯১, ১০৬, ২০৯, ২১৫।
বোলিং: বোল্ট ১৪-৫-২৮-২, হেনরি ১৫.২-২-৪৪-৩, ওয়্যাগনার ১৩-২-৪৩-০, পটেল ৮-০-৫০-০, স্যান্টনার ১৩-১-৫১-৩।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Eden Gardens Rohit Sharma
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE