Advertisement
E-Paper

একের পর এক ধাক্কা সামলে এগোচ্ছেন আকাশদীপ, প্রিয় ছাত্রকে এ বার এক দিনের দলে দেখছেন কোচ সৌরাশিস

কয়েক বছর আগে বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ট্রায়ালে এসে এলোমেলো বল করেছিলেন আকাশদীপ। বাংলার জোরে বোলারের বলই এজবাস্টনে ইংল্যান্ডে এলোমেলো করে দিয়েছে।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫ ১০:৫৬
picture of Akash Deep

আকাশদীপ। —ফাইল চিত্র।

ক্যানসার আক্রান্ত দিদিকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন আকাশদীপ। দিদির পাশে বসে তাঁকে ভর্তি করানোর প্রয়োজনীয় কাজ সারছিলেন। তখনই ইংল্যান্ড সফরের ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার খবর পান বাংলার জোরে বোলার। দিদি খুশি হলেও সেই মুহূর্তে খবরটা উপভোগ করতে পারেননি আকাশদীপ। তবে তখনই ঠিক করে নেন ইংল্যান্ডে ভাল পারফর্ম করে দিদির মুখে হাসি ফোটাবেন।

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হয় আকাশদীপের। নয় নয় করে আটটি টেস্ট খেলে ফেলেছেন। তবে এখনও ভারতীয় টেস্ট দলের প্রথম একাদশে নিয়মিত হতে পারেননি। জসপ্রীত বুমরাহ এবং মহম্মদ সিরাজের পর তৃতীয় জোরে বোলার হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। সেখানেও তাঁর লড়াই প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, শার্দূল ঠাকুর, হর্ষিত রানাদের সঙ্গে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন এখনও থিতু নয়। তার মধ্যেই ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক ধাক্কা সামলে যাচ্ছেন ২৮ বছরের ক্রিকেটার।

নিজের সমস্যার কথা সাধারণত কাউকে বলেন না আকাশদীপ। খুব ঘনিষ্ঠ কাউকেও নয়। নিজের লড়াই নিজে লড়তেই পছন্দ করেন। গত মরসুমের শেষ দিকে চোট পেয়েছিলেন। কয়েক মাস খেলতে পারেননি। সে সময়ও নিজের চোটের থেকে ছোট জামাইবাবুর স্নায়ুজনিত অসুস্থতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পুণেবাসী জামাইবাবুকে নিয়ে টানা দৌড়োদৌড়ি করেছেন মুম্বইয়ের হাসপাতালে। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁকে সুস্থ করার পর বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে (এনসিএ) গিয়েছেন রিহ্যাব করতে। তার পর আবার ধাক্কা। আইপিএলের মাঝে জানতে পারেন, তাঁর দিদি অখণ্ড জ্যোতি সিংহ ক্যানসারে আক্রান্ত। মাঠে ফেরার পর ধীরে ধীরে ছন্দ পেতে শুরু করা আকাশদীপ শুরু করেন নতুন লড়াই। দিদির চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আইপিএলের মধ্যেই। ইংল্যান্ডের বিমানে ওঠার আগে দিদির জন্য সব ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। এত বড় সমস্যার কথা ইংল্যান্ডে গিয়েও কাউকে জানাননি। এজবাস্টনে ১০ উইকেট নেওয়ার পর চেতেশ্বর পুজারার সঙ্গে কথা বলার সময় ক্যানসার আক্রান্ত দিদিকে জয় উৎসর্গের কথা জানান আকাশদীপ। সেই প্রথম দিদির অসুস্থতা নিয়ে মুখ খোলেন আকাশদীপ। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিলেন। টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে আকাশদীপের কথা প্রায় বাক্‌রুদ্ধ করে দিয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের। ১৮৭ রানে ১০ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের ‘বাজ়বল’ ক্রিকেটকে ভোঁতা করে দেওয়া ছেলেটা বলে কী! এমন মানসিক চাপ নিয়েও বিষাক্ত লেট ইনসুইংয়ে জো রুটের অফ স্টাম্প উপড়ে ফেলা যায়! অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে টানা বল করা যায়। রুটকে করা বলটা আসলে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়কের অফ স্টাম্প ছিটকে দেয়নি। বেন স্টোকসদের আত্মবিশ্বাসের অফ স্টাম্পটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল।

প্রিয় ছাত্রের দিদির অসুস্থতার কথা শুনে কম বিস্মিত হননি তাঁর কোচ এবং মেন্টর সৌরাশিস লাহিড়ীও। প্রায় দিনই কথা হয়। এজবাস্টনে চার উইকেট নেওয়ার পরও হয়েছিল। এক বারও বিষয়টা বলেননি! আনন্দবাজার ডট কমকে সৌরাশিস বললেন, ‘‘আমাকে সব কথা বলে আকাশদীপ। অথচ এই কথাটা বলেনি। খারাপ লেগেছিল একটু। প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট নেওয়ার পর ফোনে কথা হয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, খুব ভাল বল করেছিস। কিন্তু পাঁচ উইকেট কবে নিবি? ও কথা দিয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি নেবে। তখনও দিদির অসুস্থতার কথা বলেনি। ম্যাচের পর আবার ফোন করেছিলাম। তখন জানতে চাই, কেন দিদির অসুস্থতার কথা আমাকে বলেনি। আকাশদীপ বলেছিল, ‘স্যর আমি বলার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলাম না তখন। তাই বলা হয়নি। আপনি কিছু মনে করবেন না।’’

এখন কেমন আছেন আকাশদীপের দিদি? সৌরাশিস জানালেন, ‘‘আইপিএলের সময়ই ওর দিদির ক্যানসার ধরা পড়ে। থার্ড স্টেজে। দিদি লখনউয়ে থাকেন। আকাশদীপও লখনউয়ের হয়ে খেলায় সেখানেই ছিল। খেলা, অনুশীলনের সময় বাদে সারা ক্ষণ দিদির কাছে থাকত। দিদির চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করত। রাতের পর রাত হাসপাতালে জেগেছে। তার পরও আইপিএল খেলেছে। অসম্ভব মানসিক জোর ছেলেটার। এখন ওর দিদি অনেকটা ভাল রয়েছেন। অস্ত্রোপচার হয়েছে ভাল ভাবে। কেমোথেরাপি শুরু হবে এ বার। ’’

একাধিক মানসিক চাপে ডুবে থাকা আকাশদীপ কোচকে অপেক্ষা করাননি। এজবাস্টনেই দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৯ রানে ৬ উইকেট তুলে নেন। কোচকে দেওয়া কথা রাখেন প্রথম সুযোগেই। আসলে মানসিক চাপের সঙ্গে লড়াই করে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে আকাশদীপ। সৌরাশিস বলছিলেন, ‘‘একের পর এক ধাক্কা আসছে ওর জীবনে। কোভিডের সময় প্রথমে ওর বাবা মারা গেলেন। অসুস্থ ছিলেন। বয়সও হয়েছিল। তার মাস ছয়েক পর ওর দাদাও মারা যান। ছোট জামাইবাবু অসুস্থ। দিদির ক্যানসার। দাদা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। মা, বৌদি, ভাইঝির সব দায়িত্ব। সব সময় সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সকলের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কাছে পরিবার সবার আগে। কাঁধে এত ভার নিতে পারে বলেই হয়তো ঈশ্বর আকাশদীপের কাঁধেই সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। অথচ দেখুন, এত দিক সামলেও নিজের ক্রিকেটকে আগলে রেখেছে। ক্রমশ উন্নতি করছে। কোনও কিছুই ওর ক্রিকেটীয় উত্থানের পথে বাধা তৈরি করতে পারেনি।’’

আকাশদীপকে সৌরাশিস প্রথম যখন দেখেন, তখন তিনি ছিলেন ‘মাটির তাল’। ডিউস বলে কখনও ক্রিকেট খেলেননি। টেনিস বলে খেলতেন। বিহারের সাসারামের ছেলে ক্রিকেট খেলার জন্যই চলে এসেছিলেন আসানসোলে এক কাকার কাছে। সেখান থেকে কলকাতার ইউনাইটেড ক্লাব। তৎকালীন বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কোচ সৌরাশিসকে আকাশদীপের কথা বলেছিলেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। শুধু বলেছিলেন, ‘ছেলেটাকে এক বার দেখ। খুব জোরে বল করে।’ ইউনাইটেড ক্লাবের নেটে দেখার পর বাংলার অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ট্রায়ালে ডাকেন সৌরাশিস। বলে গতি থাকলেও একটু এলোমেলো ছিলেন তখন। সৌরাশিস বলেছেন, ‘‘ডিউস বলে কী করে বল করতে হয়, সেটাই তখন ও জানত না। তবে বলে ভাল গতি ছিল। মনে হয়েছিল, গড়ে নিতে পারলে অনেক দূর যাবে। বাংলার হয়ে অনেক দিন খেলবে। তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কথা ভাবার সুযোগ ছিল না। মাস দুয়েক পর অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ট্রায়াল ম্যাচ ছিল। তখন ওর পিঠে একটা ব্যথা হচ্ছিল। আমাকে বলেছিল। ওকে বল না-করানোর কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমি কল্যাণীর মাঠ থেকে চলে আসার পর কেউ ওকে আবার বল করতে বলেন। ও ‘না’ বলতে পারেনি। বল করে আকাশদীপের ব্যথা আরও বেড়ে গিয়েছিল। পরের দিন ফিজিয়োকে দেখতে বলি। ওর ‘স্ট্রেস ফ্র্যাকচার’ ছিল। আকাশদীপ তার আগে কখনও ‘স্ট্রেস ফ্র্যাকচার’ কথাটাই শোনেনি। বিশ্রাম এবং রিহ্যাবের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে ফিট হয়।’’

সে সময় অনূর্ধ্ব-২৩ বাংলা দল নিয়ে কয়েকটি প্রাক্‌ মরসুম প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে যাওয়ার কথা ছিল সৌরাশিসের। নির্বাচনী বৈঠকে আকাশদীপের কথা বলেছিলেন। কিন্তু নির্বাচকেরা রাজি হননি কেউ। সৌরাশিস বলেছেন, ‘‘তার আগে তো আকাশদীপ কোথাও তেমন কিছু খেলেনি। কোনও পারফরম্যান্সও ছিল না। কী করে রাজি হবেন নির্বাচকেরা! তাঁদের দোষ ছিল না। আমিই ওকে নিয়ে জেদ ধরেছিলাম। তখন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিষেক ডালমিয়া খুব সাহায্য করেছিলেন। আমার উপর ভরসা রেখেছিলেন দু’জনেই। চোট পুরো না সারায় প্রথম টুর্নামেন্টে খেলাতে পারিনি। দ্বিতীয় টুর্নামেন্ট ছিল বিশাখাপত্তনমে। তার আগে নির্বাচকেরা বলেছিলেন, এ বারও খেলাতে না পারলে আর আকাশদীপকে দলে রাখবেন না। ঠিকই বলেছিলেন। কোনও দিন না খেলা একটা ছেলেকে কেন দলে রাখা হবে! বিশাখাপত্তনমেও প্রথম দুটো ম্যাচ খেলাতে পারিনি। তার পর ফিজিয়ো অনুমতি দেওয়ায় খেলাতে শুরু করি। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে ২৫-২৬ বলে ৫৭ বা ৫৮ রান করেছিল। বল হাতে ৫ উইকেট নিয়েছিল। বাংলার হয়ে সেই শুরু আকাশদীপের। পরে সিনিয়র টিমেও এসেছে। নিয়মিত খেলছে। এখন তো ওকে সবাই চিনে গিয়েছে।’’ গর্বিত শোনাচ্ছিল বাংলার অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কোচকে।

প্রিয় ছাত্রের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত সৌরাশিস। ২০১৮ থেকে ২০২৫— আকাশদীপের চার পাশে সব কিছু বদলে গিয়েছে। আসানসোলের টেনিস বল ক্রিকেট থেকে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের সঙ্গে এক সাজঘরে। জসপ্রীত বুমরাহের মতো বোলারের সঙ্গে নতুন বল ভাগ করে নিচ্ছেন। চার পাশ বদলে গেলেও জোরে বোলার নিজে বদলাননি। এখনও কলকাতায় তাঁর থাকার কোনও বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই। সিএবির ডরমেটরিই তাঁর আস্তানা। কয়েক বার ভাবলেও ফ্ল্যাট কেনা হয়নি এখনও। অথচ সাসারামে নতুন দোতলা বাড়ি করেছেন। পরিবারের সকলে যাতে আরামে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করেছেন। সৌরাশিস বলছিলেন, ‘‘আকাশদীপ অসম্ভব বিনয়ী প্রকৃতির। সব সময় মাটিতে পা রেখে চলতে চায়। সবাইকে সম্মান করে। কারও প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় না। কারও উপকার ভোলে না।’’ আকাশদীপ নিজেকে বাংলার ক্রিকেটারই মনে করেন। বাংলার ক্রিকেটার হিসাবেই পরিচিত হতে চান।

আকাশদীপের জীবন কাহিনি, হার মানাতে পারে সিনেমা-সিরিয়ালের গল্পকেও। সাসারাম থেকে এজবাস্টন ভায়া আসানসোল, কলকাতা। ক্রিকেটজীবনের যাত্রা সবে শুরু। তাঁর লক্ষ্য অনেক দূর। সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে চান ধাপে ধাপে। কোনও রকম শর্টকাটে আস্থা নেই তাঁর। সুযোগ পেলেই মহম্মদ শামির পরামর্শ নেন। আইপিএলের সময় জাহির খানের সঙ্গে কথা বলেছেন বোলিং নিয়ে। সৌরাশিসের আশা, ভারতের এক দিনের দলে খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাওয়া যাবে আকাশদীপকে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাদা দলের ক্রিকেটারদের লাল বলে সাফল্য পাওয়া কঠিন। লাল বলের ক্রিকেটারদের সাদা বলে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় না। কারণ টেস্ট ক্রিকেট সবচেয়ে কঠিন। আকাশদীপের দক্ষতা প্রমাণিত। সাদা বলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সফল হবে। শুধু একটু মানসিকতা বদল করে বল করতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটের ভাবনা নিয়ে বল করলে হবে না। আকাশদীপ পারবে। যে এত কিছু অনায়াসে সামলাতে পারে, সে পারবেই। তা ছাড়া বাংলার হয়ে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স রয়েছে ওর।’’

এজবাস্টন টেস্টের পর দিদির সঙ্গে কথা বলেছেন আকাশদীপ। দিদি তাঁকে আস্বস্ত করেছেন। খেলায় মন দিতে বলেছেন। ১০ উইকেট নিয়ে আত্মবিশ্বাসী আকাশদীপ খানিকটা মানসিক স্বস্তি পেয়েছেন। সাফল্যের আনন্দ তো রয়েছেই। তাঁর জন্য সবুজ গালিচা পাতা রয়েছে লর্ডসে। সেই লর্ডস, যেখান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরু হয়েছিল সৌরভ-রাজ।

আগের ম্যাচে আকাশদীপের রুদ্রমূর্তি দেখা ইংরেজরা নাকি ২২ গজের ঘাস ছেঁটে ফেলছেন! বাংলার জোরে বোলার বোধহয় ‘বাজ়বল’এর অফ স্টাম্পটাই নাড়িয়ে দিয়েছেন।

India vs England 2025 Test Series Akash Deep Saurasish Lahiri coach
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy