রিয়ান পরাগ। ভারতীয় ক্রিকেটে তারকা না হয়েও তিনি একটি চরিত্র। আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসে তিনি প্রায় প্রতি ম্যাচেই নানা কারণে আলোচনায়। কখনও ম্যাচশেষে মাঠকর্মীদের সঙ্গে নিজস্বী তোলার পর খারাপ আচরণ করে শিরোনামে, কখনও মাঠেই সতীর্থকে চোখ রাঙিয়ে বিতর্কে। বুধবার দিল্লি ক্যাপিটালসের ম্যাচে দাগ কাটতে না পারলেও তাঁর ব্যাট নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তাঁর ব্যাটের মাপে বেনিয়ম হওয়ায় আম্পায়ারেরা আপত্তি জানান। তিনিও তর্ক জুড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত যে ব্যাট নিয়ে নেমেছিলেন, সেই ব্যাটেই খেলেন। এ-হেন পরাগকে রাজস্থান প্রথম তিনটি ম্যাচে অধিনায়ক করে দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, নিয়মিত অধিনায়ক সঞ্জু স্যামসনের চোট। তাই শুরুতে তিনি খেলতে পারবেন না। কিন্তু কারণ কি শুধুই এটা? একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে আসল কারণটা ক্রিকেটীয় নয়, রাজনৈতিক।
অসমের ভূমিপুত্র পরাগ। স্থলপথে রাজস্থানের জয়পুর ও অসমের গুয়াহাটির মধ্যে দূরত্ব ১৯৭৩ কিলোমিটার। প্রথমটি ভারতের একেবারে পশ্চিমে, তো দ্বিতীয়টি উত্তর-পূর্বে। এই দুই জায়গার কোনও মিল নেই। না ভূপ্রকৃতিগত, না আবহাওয়ায়, না দুই জায়গার মানুষের সংস্কৃতি ও খাদ্যরীতিতে। অথচ এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীত দুই শহর একটিই দলের কেন্দ্র। রাজস্থান রয়্যালস। আইপিএলের প্রথম ট্রফিজয়ী দল। যে রাজস্থান এক সময় শুধু জয়পুরের সওয়াই মানসিংহ স্টেডিয়ামে খেলত, সেই দল এখন প্রতি বছর দু’টি ম্যাচ খেলতে আসে গুয়াহাটির বর্ষাপারা স্টেডিয়ামে। কেন? ভারতের দু’প্রান্তে দু’টি মাঠ কী ভাবে একটি দলের কেন্দ্র হতে পারে? এর কারণও কি শুধুই ক্রিকেটীয়? না কি তার নেপথ্যে অন্য কারণও রয়েছে?
কবে থেকে রাজস্থানের কেন্দ্র গুয়াহাটি?
২০২৩ সালে প্রথম বার গুয়াহাটিতে নিজেদের হোম ম্যাচ খেলেছিল রাজস্থান। তবে তার আগেও এই মাঠে খেলা প্রায় নিশ্চিত ছিল রাজস্থানের। ২০২০ সালে রাজস্থানের কেন্দ্র হিসাবে এই মাঠ ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু কোভিড অতিমারির কারণে আইপিএল ভারতের বদলে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে হয়। অতিমারি শেষে যে বার প্রথম হোম-অ্যাওয়ে নিয়মে খেলা শুরু হয় সে বারই গুয়াহাটিতে খেলতে যায় রাজস্থান। তবে গত ২০২৩ ও ২০২৪ সালে আইপিএলের মাঝে বা শেষে অসমের মাঠে খেলতে গিয়েছিল রাজস্থান। এ বার একেবারে শুরুতেই গিয়েছে তারা।

গুয়াহাটির বর্ষাপারা স্টেডিয়াম। ছবি: পিটিআই।
বোর্ডের সিদ্ধান্ত
২০২৩ সাল থেকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড স্থির করেছে, আইপিএলকে ভারতের আরও বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। যে ১০টি দল খেলছে তাদের শহরে তো মাঠ রয়েছেই, কিন্তু তার বাইরেও এই প্রতিযোগিতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য তাদের ছিল। সেই কারণেই পঞ্জাব কিংস মুল্লানপুরের পাশাপাশি ধর্মশালার মাঠে খেলছে। আবার দিল্লি ক্যাপিটালসের দ্বিতীয় হোম করা হয়েছে বিশাখাপত্তনমকে। তবে রাজস্থান সকলকে চমকে দিয়েছে। ভারতের একেবারে অন্য প্রান্তে গিয়ে খেলছে তারা।
ক্রিকেটে ব্রাত্য উত্তর-পূর্ব
গোটা ভারতে আইপিএল ছড়িয়ে গেলেও উত্তর-পূর্ব কিছুটা হলেও ব্রাত্য থেকে গিয়েছে। নর্থইস্ট ইউনাইটেড ফুটবল দল আইএসএলে খেললেও আইপিএলে এই অঞ্চল থেকে কোনও দল নেই। উত্তর-পূর্বে ক্রিকেটের থেকে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বেশি। দেশের জাতীয় ফুটবলে উত্তর-পূর্বের একের পর এক নাম উঠে এলেও ক্রিকেটে তা হয়নি। উত্তর-পূর্বে যে রঞ্জি দলগুলি রয়েছে তারাও প্লেট গ্রুপেই খেলে। সেই কারণেই আইপিএলের একটি কেন্দ্র হিসাবে অসমকে বেছে নিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। অসম থেকেই ধীরে ধীরে উত্তর-পূর্বের বাকি রাজ্যগুলিতে তা ছড়িয়ে দিতে চাইছে তারা।
অসমের তারকা রিয়ান পরাগ
আর এই লক্ষ্যে তাদের সুবিধা করে দিয়েছে রাজস্থান রয়্যালস। কারণ, এই দলেই খেলেন অসমের পরাগ। তিনি অসমের একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি জাতীয় দলে খেলেছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছেন। অসমের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ ক্রিকেট খেলা শুরু করেন পরাগ। ১৮ বছরের কম বয়সে অসমের হয়ে রঞ্জিতে অভিষেক হয় তাঁর। একুশ শতকে জন্ম নেওয়া ভারতের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন তিনি। ধীরে ধীরে অসমের এক নম্বর ক্রিকেটার হয়ে ওঠেন পরাগ। রঞ্জি থেকে শুরু করে বিজয় হজারে, একের পর এক প্রতিযোগিতায় উত্তর-পূর্বের রাজ্যের হয়ে সর্বাধিক রান করেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই সাফল্য তাঁকে জায়গা করে দেয় ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। আঙুলে চোট পাওয়ায় শুরুর কয়েকটি ম্যাচে খেলতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতে ফেরেন তিনি। পৃথ্বী শ-য়ের নেতৃত্বাধীন সেই দলে পরাগের সতীর্থ ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের আর এক তারকা শুভমন গিল।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতার পর সেই বছরই আইপিএলের নিলামে দল পান পরাগ। তাঁকে কেনে রাজস্থান। তার পর থেকে সেই দলেই খেলেছেন তিনি। মাঝে ২০২২ সালে পরাগকে ছেড়ে দিলেও আবার নিলামে রাজস্থানই তাঁকে কেনে। তবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আইপিএলে বিশেষ নজর কাড়েননি পরাগ। তত দিন তাঁর একমাত্র কীর্তি ছিল সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে আইপিএলে অর্ধশতরান। মাত্র ১৭ বছর ১৭৫ দিন বয়সে এই কীর্তি করেন তিনি। ২০২২ সালে ১৭টি ক্যাচ ধরার নজির গড়েছিলেন পরাগ।

টিম বাস থেকে নেমে ম্যাচ খেলতে যাওয়ার আগে পরাগ। ছবি: পিটিআই।
গত বছর থেকে পরাগ ২.০-কে দেখতে পেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। গত বার চার নম্বরে ব্যাট করে ৫৭৩ রান করেছিলেন পরাগ। পঞ্চম সর্বাধিক রান করেছিলেন তিনি। এ বার তাঁকে সহ-অধিনায়ক করেছে রাজস্থান। এ বার মরসুমের প্রথম তিনটি ম্যাচে অধিনায়কত্বও করেছেন তিনি। আঙুলে চোট থাকায় প্রথম তিনটি ম্যাচে শুধু ব্যাট করেছিলেন সঞ্জু স্যামসন। ফিল্ডিং করার অনুমতি ছিল না। সেই কারণে তিনটি ম্যাচে পরাগ অধিনায়কত্ব করেন। চতুর্থ ম্যাচের আগে বোর্ডের ছাড়পত্র পান সঞ্জু। চতুর্থ ম্যাচ থেকে তিনি অধিনায়কত্ব শুরু করেন।
কেন প্রথম তিনটি ম্যাচেই অধিনায়ক পরাগ?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন প্রথম তিনটি ম্যাচেই পরাগকে অধিনায়ক করা হয়েছে? পরাগ যে তিনটি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন, তার মধ্যে দু’টি ছিল রাজস্থানের হোম ম্যাচ। আর সেই দু’টি খেলা ছিল গুয়াহাটিতে। একটি কলকাতার বিরুদ্ধে। একটি চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে। কলকাতার বিরুদ্ধে হারলেও চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে জিতেছে রাজস্থান। আইপিএলের সূচি ঘোষণার আগেই চোট পেয়েছিলেন সঞ্জু। তিনি যে প্রথম তিনটি ম্যাচে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না, তা বোর্ড জানত। সঞ্জু না থাকলে পরাগ যে নেতৃত্ব দেবেন, তা-ও অজানা ছিল না। কারণ, তিনি দলের সহ-অধিনায়ক। অধিনায়কের অবর্তমানে সহ-অধিনায়কই নেতৃত্ব দেন। সেই কারণেই কি বেছে বেছে রাজস্থানের প্রথম দু’টি হোম ম্যাচ ফেলা হল গুয়াহাটিতে?
ভূমিকা আরও দুই কর্তার
গুয়াহাটিকে রাজস্থানের কেন্দ্র করার নেপথ্যে ভূমিকা রয়েছে আরও দু’জনের। এক, বোর্ডের সচিব দেবজিৎ শইকীয়া। অসমের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা শইকীয়া এর আগে রাজ্য ক্রিকেটে প্রশাসকের দায়িত্ব সামলেছেন। অসম ক্রিকেট সংস্থার সচিব ছিলেন তিনি। পরে জয় শাহ আইসিসির চেয়ারম্যান হওয়ার পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বোর্ডের সচিব হয়েছেন তিনি। শইকীয়াও চাইবেন নিজের রাজ্যে ক্রিকেটের প্রসার ঘটাতে। আইপিএলের থেকে ভাল মঞ্চ তিনি কী ভাবে পাবেন? গুয়াহাটিকে দ্বিতীয় কেন্দ্র করার নেপথ্যে ভূমিকা রয়েছে রাজস্থানের এক কর্তারও। তাঁর নাম রঞ্জিত বড়ঠাকুর। তিনি রাজস্থান রয়্যালসের এগ্জ়িকিউটিভ চেয়ারম্যান। অসমের জোড়হাটের বাসিন্দা তিনি। তাই রঞ্জিতও বরাবর চেয়েছেন অসমে ক্রিকেটের প্রসার। সুযোগ পেয়েই সেই কারণে রাজস্থানের কেন্দ্র হিসাবে গুয়াহাটিকে বেছে নিয়েছেন তিনি।
কাজে লেগেছে পরাগের জনপ্রিয়তা
পরাগের পিতা পরাগ দাসও প্রাক্তন ঘরোয়া ক্রিকেটার। তিনি অসম, রেলওয়েজ় ও ইস্ট জ়োনের হয়ে খেলেছেন। রেলওয়েজ়ের হয়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অধিনায়কত্বে খেলেছেন তিনি। আবার রঞ্জিতে ধোনির বিরুদ্ধেও খেলেছেন তিনি। অর্থাৎ, অসমের ক্রিকেটে পরাগের পরিবারের গুরুত্ব রয়েছে। সেই গুরুত্ব কাজে লাগাতে চেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। সেই কাজে সফলও তারা। গুয়াহাটিতে যে দু’টি ম্যাচ হয়েছে সেখানে মাঠ ভরে গিয়েছে। পরাগকে দেখে মাঠে যা চিৎকার হয়েছে তা দেখার মতো। তিনি যখনই ব্যাট করতে নেমেছেন, বা ক্যাচ ধরেছেন দর্শকদের উল্লাস ছিল বাঁধভাঙা। মাঠকর্মীরা পরাগের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছেন। আগে রাজস্থানের জার্সিতে সফল হলেই মাঠে বিহু (অসমের জনপ্রিয় নাচ) নাচতেন পরাগ। এখন আর তার দরকার পড়ে না। ভারতীয় ক্রিকেটের মানচিত্রে অসমের একটি জায়গা তিনি করেছেন। আর তাই তাঁকেই সবচেয়ে বড় দূত হিসাবে ব্যবহার করেছে বিসিসিআই।
এর নেপথ্যে একটি রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে অসমের সরকার বিজেপির দখলে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগ বহু বছরের। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় থেকেছে তারা দেশের ক্রিকেটে প্রভাব ফেলেছে। এখনও তার অন্যথা হচ্ছে না। সেই কারণেই হয়তো জয়পুর থেকে ১৯৭৩ কিলোমিটার দূরের গুয়াহাটিকে রাজস্থানের কেন্দ্র করা হয়েছে। যে কারণেই এই সিদ্ধান্ত হোক না কেন, উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে যে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না।