২৭ কোটি টাকা দিয়ে ঋষভ পন্থকে কেনার পরে সঞ্জীব গোয়েন্কা বলেছিলেন, “দিল্লি ক্যাপিটাল্স পন্থকে রাখবে না জানার পরই আমরা ওকে ধরে দল সাজানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার বিশ্বাস, পন্থ দারুণ নেতা। ওর সেরা নেতৃত্ব এখনও দেখতে পাইনি। আমরা ২৭ কোটিতে ওকে পেয়েছিলাম। দরকার হলে ২৮ কোটিও খরচ করতাম!”
আইপিএল শেষ হওয়ার পর লখনউ সুপার জায়ান্টসের মালিক গোয়েন্কা সম্ভবত ভাবছেন, যাক, অন্তত এক কোটি তো বাঁচল! কারণ, বাকি ২৭ কোটি জলে গিয়েছে। পন্থ সব মিলিয়ে ১৪ ম্যাচে মোট রান করেছেন ২৬৯। পাটিগণিতের হিসাবে পন্থের প্রতিটি রানের জন্য গোয়েন্কার গচ্চা গিয়েছে প্রায় ১০ লাখ।
মঙ্গলবার রাতে শেষ ম্যাচের আগে এই হিসাব ছিল ১৮ লাখ! রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ৬১ বলে ১১৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খানিকটা মুখরক্ষা করল পন্থের। একেবারে শেষবেলায় ‘পন্থ-পথে’ এলেন ঋষভ। ১১টি চার, ৮টি ছক্কার ইনিংসে ব্যাটের মাঝখান দিয়ে খেললেন অধিকাংশ শট। তাতে ‘মান’ খানিকটা বাঁচলেও ‘জান’ বাঁচল না।
শতরান করার পর গ্লাভস, হেলমেট খুলে শূন্যে ‘ডিগবাজি’ দিলেন পন্থ। দু’দিকে দু’হাত ডানার মতো ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। মুখে তৃপ্তির হাসি। চাপমুক্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। টেলিভিশন স্ক্রিনে ভেসে উঠল লখনউয়ের ভিআইপি বক্স। কিন্তু সেখানে দেখা গেল না গোয়েন্কাকে। অথচ এই ইনিংস দেখার অপেক্ষাতেই তিনি থেকেছেন গোটা আইপিএল। কিন্তু শেষবেলায় নিয়মরক্ষার ম্যাচ দেখতে আর লখনউ যাননি। ম্যাচের পরে সমাজমাধ্যমে একটি শব্দ লিখেছেন গোয়েন্কা, ‘প্যান্টাস্টিক’!
আইপিএলের শুরু থেকেই পন্থ খারাপ ফর্মে। তা সত্ত্বেও প্রতিটি ম্যাচে হারের পরে মাঠে নেমে হাসিমুখে দলের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে গোয়েন্কাকে। ভিআইপি বক্সে বসে কয়েক বার বিরক্তি প্রকাশ করলেও (হাতে একটি ছবি নিয়ে, সম্ভবত ইষ্টদেবতা বা কুলদেবতা, বার বার কপালে ঠেকাতে দেখা গিয়েছে) ম্যাচের শেষে অধিনায়কের পিঠ চাপড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কি খুব স্বচ্ছন্দ হয়েছেন তিনি? হওয়ার কথা নয়। কিন্তু উপায় নেই। গোয়েন্কাকে তাড়া করেছে লোকেশ রাহুলের ‘ভূত’। গত মরসুমে রাহুল ছিলেন লখনউয়ের অধিনায়ক। একটি ম্যাচ হারার পরে মাঠে নেমে প্রকাশ্যেই রাহুলকে ভর্ৎসনা করেছিলেন দলের মালিক। শোনা যায়নি কী বলেছিলেন। কিন্তু বোঝা গিয়েছিল, ভঙ্গিতে খুব ‘বড়দাসুলভ স্নেহ’ নেই। গোয়েন্কা দেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী। আইপিএলে দল কিনে বিনিয়োগ করেছেন। প্রত্যাশামতো ফল না-পেলে তিনি ক্ষুব্ধ হবেন, সেটা প্রত্যাশিত। কিন্তু সর্বসমক্ষে মেজাজ হারাবেন, এটা সম্ভবত কেউ ভাবেননি। ফলে প্রকাশ্যেই সমালোচিত হয়েছিলেন লখনউয়ের দলমালিক। গোয়েন্কা-রাহুলের বিতণ্ডা ক্রিকেটমহলে তো বটেই, সমাজমাধ্যমেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। পরে রাহুলকে বাড়িতে নৈশভোজে ডেকেছিলেন গোয়েন্কা। মনে হয়েছিল ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হল।
হয়নি। রাহুল লখনউ ছেড়ে চলে গিয়েছেন দিল্লিতে। গোয়েন্কা পরবর্তী নেতা খুঁজতে নেমে পন্থকে বেছেছিলেন। বলেছিলেন, “আমাদের এমন একজন নেতা দরকার, যে নিজের দক্ষতায় বিশ্বাস করে। যে ভয়ডরহীন এবং বিধ্বংসী ব্যাটিং করতে পারে। ঋষভের মধ্যে এর সব ক’টাই রয়েছে।” গোয়েন্কা যখন সেই দরাজ শংসাপত্র দিচ্ছেন তাঁর অধিনায়ককে, তখন তাঁর ডান দিকে বসে পন্থ স্বয়ং। বাঁ দিকে লখনউয়ের কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার। গোয়েন্কা যখন বলছেন, ‘‘পন্থকে না পেলে লখনউ দলে এমন কোনও ভারতীয় ব্যাটার থাকত না, যে ইনিংস টানতে পারবে। এমন এক জন, যাকে ঘিরে পুরো দল তৈরি হবে।” কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগের সেই বিশ্বাসের থেকে বাস্তব অনেক দূরে রয়ে গিয়েছে।
‘বিধ্বংসী ব্যাটিং’ তো দূরস্থান, মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে নামার আগে পর্যন্ত ১৩টি ম্যাচে পন্থ করেছিলেন মোট ১৫১ রান। তার মধ্যে সাত বার তিনি দু’অঙ্কেও পৌঁছোতে পারেননি। ব্যাট করতে নেমে দ্বিধায় ভুগেছেন। শট নির্বাচন করতে পারেননি। বলের লাইনে গিয়ে খেলতে পারেননি। সাধারণ ডেলিভারিতে উইকেট ছুড়ে দিয়ে এসেছেন। উইকেটরক্ষক হিসাবেও সফল হননি। ক্যাচ ফেলেছেন। সহজ স্টাম্পিংয়ের সুযোগ ফস্কেছেন। ধরেছেন পাঁচটি ক্যাচ। স্টাম্প আউট করেছেন একটি। পন্থকে দেখে মনে হয়েছে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগেছেন। ব্যাটে রান না-পেলে বা পারফরম্যান্স তলানিতে ঠেকলে যেমন হয়ে থাকে।
গোদের উপর বিষফোড়ার মতো রাহুলের দিল্লির বিরুদ্ধে দু’টি ম্যাচই হেরেছে গোয়েন্কা-পন্থের লখনউ। প্রথম ম্যাচে দিল্লি জিতেছিল এক উইকেটে। পন্থ করেছিলেন ৬ বলে শূন্য! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য রাহুল সেই ম্যাচে খেলেননি। পরেরটিতে দিল্লি জিতেছিল আট উইকেটে। পন্থ করেছিলেন ২ বলে শূন্য। রাহুল সেই ম্যাচে করেছিলেন ৪২ বলে ৫৭ রান। অর্থাৎ, দিল্লির বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার দু’টি ম্যাচে ব্যাটে পন্থের অবদান শূন্য। পক্ষান্তরে, রাহুল লখনউয়ের বিরুদ্ধে ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। সে ম্যাচে ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’ হয়েছিলেন রাহুলই। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে আর কাকে বলে!
আরও পড়ুন:
পন্থকে নিয়ে শুধু লখনউ কর্তৃপক্ষ আশাবাদী ছিলেন না। আশায় ছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরাও। আইপিএলের আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটি ম্যাচেও পন্থকে খেলাননি ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর। অনেকেই ভেবেছিলেন ভারতের প্রথম একাদশে জায়গা হারানো পন্থ জবাব দেবেন আইপিএলে। কোথায় কী! বরং পন্থ নিজেকেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন জবাবদিহি করার জায়গায়।
কিন্তু গোয়েন্কা তার পরেও সংযত থেকেছেন। ক্যামেরার সামনে অধিনায়কের সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন। গল্প-সল্পও করেছেন। কিন্তু সে সবই ক্যামেরার সামনে। কারণ, তিনি ‘সংশোধিত’ মালিক। রাহুলের সময়ে যে ‘ভুল’ করেছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি চাননি গোয়েন্কা।
কিন্তু পন্থ? তিনি কিন্তু নিজেকে সংশোধন করেছেন, তা মনে হয়নি। টানা ব্যর্থ হয়েও খেলায় পরিবর্তনের চেষ্টা করেননি। বার বার দলের ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু নিজেকে প্রথম একাদশের বাইরে রাখার কথা ভাবেননি। কোনও ম্যাচে ওপেন করেছেন। কোনও ম্যাচে নিজের নির্দিষ্ট জায়গা চার নম্বরে নেমেছেন। কোনও ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে পিছিয়ে দিতে দিতে নিয়ে গিয়েছেন সাত নম্বরে! রানের খোঁজে নিরন্তর পরীক্ষা করেছেন। বার বার কৌশল বদলেছেন। তবু সাফল্য পাননি। লখনউ প্লে-অফের দৌড় থেকে ছিটকে যাওয়ার পর পন্থ দায়ী করেছেন বোলারদের চোট-আঘাতকে। বোলারদের ধারাবাহিকতার অভাবের কথা বলেছেন। নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে কোনও কথা বা আত্মসমালোচনা শোনা যায়নি তাঁর মুখে। পন্থের বেহাল দশা দেখে খোঁচা দিয়েছে ক্রিকেটের ‘বামন’ দেশ আইসল্যান্ডও। পন্থকে তারা দলের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ (মোটা টাকা পেয়েও খারাপ খেলা) করা ক্রিকেটারদের একাদশের অধিনায়ক করেছে!
সাফল্য দিতে না পারায় অধিনায়ক রাহুলকে রাখেননি গোয়েন্কা। পন্থের ভবিষ্যৎ কী? আইপিএলের মধ্যেই বিভিন্ন মহলে জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছিল এই মর্মে যে, আগামী বছর লখনউ কর্তৃপক্ষ না-ও রাখতে পারেন পন্থকে। যদিও ইংল্যান্ড সফরে ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক নিজের তেজেই বলে দিয়েছেন, ‘‘সব ভিত্তিহীন খবর!’’ সেটা সম্ভবত তিনি মন্দ বলেননি। কারণ, প্রথমত, শেষবেলার সেঞ্চুরি তাঁকে ভাসিয়ে তুলল অনেকটা। বস্তুত, শেষ ম্যাচে ব্যাটার হিসাবে তো বটেই, নিজের দলের বোলারের ‘মাঁকড়ীয়’ আউটের সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিয়ে তিনি ক্রিকেটীয় ‘স্পিরিট’ দেখিয়েছেন। শেষবেলার স্মৃতিই তো সবচেয়ে টাটকা থাকে। সেই নিরিখে পন্থের উত্তরণ ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, পন্থের বিকল্প নিতে গেলে ভারতীয় ক্রিকেটার পেতে হবে। লখনউয়ের বিদেশি ক্রিকেটারের ‘কোটা’ শেষ। অন্য কোনও দল তাদের ভারতীয় ক্রিকেটারকে ছাড়বে না। তিন, মাত্র একটি মরসুমের ব্যর্থতাতেই পন্থকে একেবারে ছেঁটে ফেলার পথে ধুরন্ধর ব্যবসাবুদ্ধি-সম্পন্ন গোয়েন্কাও হাঁটবেন বলে মনে হয় না। বিশেষত, তাঁর শেষ ম্যাচের অধিনায়কোচিত পারফরম্যান্সের পর। পরের মরসুমের ‘প্রত্যাবর্তন’ যদি এই শেষের ম্যাচ থেকেই শুরু হয়ে থাকে? হাজার হোক, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে যাঁর প্রায় অবিশ্বাস্য ‘প্রত্যাবর্তন’ হয়েছে, তাঁর নামও তো ঋষভ পন্থ!