দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম দেখল ‘কামাল, লা-জবাব’ রাহুলকে। ব্যাটিংয়ের ক্লাস নিলেন লোকেশ রাহুল। এ বারের আইপিএলে তিনি বদলে ফেলেছেন তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরন। রাহুল ফেরালেন বিরাট কোহলির স্মৃতিও। কিন্তু কাজে এল না তাঁর শতরান। রাহুলকে দেখে শিখতে পারলেন না দিল্লির বাকি ব্যাটারেরা। কিন্তু রাহুলের সেই ক্লাস থেকেই শিক্ষা নিয়ে জিতল গুজরাত টাইটান্স। শুভমন গিল ও সাই সুদর্শনের ওপেনিং জুটি দেখিয়ে দিল কী ভাবে রান তাড়া করতে হয়। দিল্লির ঘরের মাঠে তাদের হারিয়ে প্রথম দল হিসাবে এ বারের আইপিএলের প্লে-অফে উঠল গুজরাত।
৬ বল বাকি থাকতে ১০ উইকেটে জিতল গুজরাত। শুভমন ও সুদর্শনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল, কে আগে শতরান করবেন। শেষ পর্যন্ত সুদর্শনের ব্যাট থেকে এল শতরান। ৫৬ বলে ১০০ করলেন তিনি। ছক্কা মেরে পৌঁছলেন তিন অঙ্কে। তিনিও রাহুলের ঘরানার ব্যাটার। টেকনিকের উপর বেশি জোর দেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই যে শুধু জোরের খেলা নয় তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন রাহুল, সুদর্শনেরা। ১০৮ রানে অপরাজিত থাকলেন গুজরাতের বাঁহাতি ওপেনার। অধিনায়ক শুভমন ৯৩ রানে অপরাজিত থাকলেন। মাঠে দাঁড়িয়ে হতাশ রাহুল দেখলেন দলের হার।
এ বার ওপেনিং জুটি বার বার বদলেছে দিল্লি। ফাফ ডু’প্লেসি, অভিষেক পোড়েল, করুণ নায়ার থেকে জেক ফ্রেজ়ার ম্যাকগার্ক— তালিকা লম্বা। রাহুলও ওপেন করেছেন। তবে কয়েকটি ম্যাচে। যখন তাঁকে যেখানে দরকার সেখানে ব্যবহার করেছে দিল্লি। তবে গুজরাতের বিরুদ্ধে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন অক্ষর পটেলরা। বলা ভাল, তাঁদের বাধ্য করেন রাহুল। ইনিংসে বিরতিতে দিল্লির মেন্টর কেভিন পিটারসেন জানান, রাহুল নিজেই ওপেন করতে চেয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, তিনি দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। সেটা করেও দেখালেন। অভিষেক দলে থাকলেও ডু’প্লেসির সঙ্গে ওপেন করেন রাহুল। তিনি দেখিয়ে দিলেন, কেন তাঁকে এত বড় মানের ব্যাটার বলা হয়। ক্রিকেটের ধ্রুপদী ঘরানার ব্যাটার রাহুল। টেকনিক তাঁর প্রধান অস্ত্র। সেটাই দেখা গেল অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে।
২০২৫ সালের আইপিএলের রাহুল এবং ২০২৪ সালের আইপিএলের রাহুল এক ব্যক্তি। কিন্তু এক ব্যাটার নন। গত বছর আইপিএলে বেশ কিছু ম্যাচে ২৫০র কাছাকাছি বা বেশি রান উঠেছিল। রানের সেই বন্যা দেখেও রাহুল নিজের ক্রিকেট দর্শনে অবিচল ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘স্ট্রাইক রেট আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্ট্রাইক রেট বিষয়টাকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।’’ পিচ আঁকড়ে বড় রানের ভাল ইনিংস তৈরিকেই অগ্রাধিকার দিতেন। সে সময় ব্যাটার রাহুলের এই মানসিকতা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আদর্শ। কিছুটা হয়তো এক দিনের ক্রিকেটের জন্যও। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য নয়। ২০ ওভারের ক্রিকেটে বলের থেকে রান বেশ কিছুটা বেশি হবে, এটাই প্রত্যাশিত। লখনউ সুপার জায়ান্টসের তৎকালীন অধিনায়ক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতেন না। অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক ক্রিকেটের চাহিদার দ্বন্দ্বে নিজের শিক্ষাকেই এগিয়ে রাখতেন।
রাহুল বদলে গিয়েছেন। নিজের ব্যাটিং দর্শন বদলে ফেলেছেন। নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ় হারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে রাহুলের পরিবর্তনের পিছনে। ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর তাঁকে টেস্ট দল থেকেও বাদ দিয়ে দেন। রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দলের এবং পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী ব্যাট করতে পারেন না। তবে অস্ট্রেলিয়া সফরে রোহিত শর্মার অনুপস্থিতিতে ওপেন করতে নেমে রান পাওয়ায় পরিস্থিতি আবার বদলে যায়। যদিও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রাহুলকে ব্যাট করতে পাঠানো হয় পাঁচ নম্বরে। অনভ্যস্ত জায়গায় ব্যাট করেও পাঁচটি ম্যাচে ১৪০ রান করেন তিনি। সে সময় রাহুল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমি অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট ম্যাচে ওপেন করেছিলাম। সকলেই জানে, অস্ট্রেলিয়ায় নতুন বল সামলানো কতটা কঠিন। তার পরই মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নামাটা একটু কঠিন হয়। আমার কোনও অভিযোগ নেই। গত চার-পাঁচ বছর ধরে সাদা বলের ক্রিকেট এ ভাবেই খেলছি। ব্যাটিং অর্ডারের উপরে বা নিচে ব্যাট করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আমাকে যেখানেই খেলতে বলা হোক, খুশি মনেই খেলি। এটা নিজের খেলাকে আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে আমায়। নিচের দিকে ব্যাট করায় আগের থেকে অনেক বেশি বাউন্ডারি মারতে পারছি।’’
আরও পড়ুন:
রাহুল কতটা বদলেছেন, তা বোঝা যাচ্ছে এ বারের আইপিএলে। চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে ৭৭ রান এবং রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে অপরাজিত ৯৩ রানের ইনিংস খেলেছেন আগ্রাসী মেজাজে। পাঁচ বলের জন্য ক্রিজ়ে এলেও তিন থেকে চারটি বল পাঠাচ্ছেন মাঠের বাইরে। আগ্রাসী ব্যাটিং করার জন্য অবশ্য অবিবেচকের মতো শট খেলছেন না। ক্রিকেটীয় শট খেলেও দ্রুত রান করছেন। চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব ত্রুটি এবং ঝুঁকিহীন ব্যাটিং করতে। নিজের আগ্রাসী ব্যাটিং নিয়ে রাহুল বলেছেন, ‘‘ক্রিকেটজীবনের একটা পর্যায়ে এসে চার, ছয় মারার মজা হারিয়ে ফেলেছি। নিজের ব্যাটিংকে আরও আরও নিখুঁত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে সেটা আটকে গিয়েছে। আসলে ক্রিকেট খেলাটাই বদলে গিয়েছে। বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে যত বেশি সম্ভব বাউন্ডারির মারতে হয়। যারা বেশি সংখ্যক চার-ছয় মারতে পারে, তারাই জেতে।’’
দিল্লির মাঠেও সেই ব্যাটিংই দেখা গেল। প্রথম থেকে চালিয়ে খেললেন তিনি। শুরুতে পাওয়ার প্লে কাজে লাগালেন। ৩০ গজ বৃত্তের উপর দিয়ে খেললেন। পরে ফিল্ডিং ছড়িয়ে গেলে তার ফাঁক ব্যবহার করলেন। কী ভাবে এই ইনিংসকে শিক্ষার পর্যায়ে নিয়ে গেলেন রাহুল? তার প্রধান কারণ, বল নির্বাচনের ক্ষমতা। সব বলে মারার চেষ্টা করছিলেন না রাহুল। তিনি জানতেন, দিল্লির এই মাঠের আয়তন বড় নয়। অর্থাৎ, মারার বল পাবেন তিনি। সেই অপেক্ষা করলেন রাহুল। পাশাপাশি ‘ভি’ (লং অন থেকে লং অফ) ব্যবহার করলেন রাহুল। খুব বেশি আড়াআড়ি শট মারেননি। যে কয়েকটি মেরেছেন, সেগুলি লেগ স্টাম্পে করা বলে।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
৬০ বলে নিজের শতরান করেন রাহুল। মিড উইকেটে পুল মেরে বল বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ব্যাট উপরে তোলেন তিনি। হেলমেট খোলেন। ঘাম মুছে আবার ব্যাট করতে শুরু করেন। ওপেন করতে নেমে শেষ পর্যন্ত খেলেন তিনি। ৫৬ বলে ১১২ রানের ইনিংসে ১৪টি চার ও চারটি ছক্কা মেরেছেন রাহুল। ১৭২.২৯ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন। দলের মোট রানের অর্ধেকের বেশি করেছেন রাহুল একাই। তবে নজর কাড়ল তাঁর দু’টি ছক্কা। শর্ট বলে পিছনের পায়ে দাঁড়িয়ে দু’টি সোজা ছক্কা মারলেন রাহুল। স্মৃতি ফিরল কোহলির। ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হ্যারিস রউফের বলে পিছনের পায়ে শর্ট বলে ছক্কা মেরেছিলেন কোহলি। মেলবোর্নের সেই ছবি ধরা পড়ল অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে। অবশ্য মেলবোর্নের তুলনায় দিল্লির মাঠ অনেকটাই ছোট। তা বলে রাহুলের কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না।
তবে সেই শতরান কাজে এল না। রাহুলের ক্লাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর দলকেই হারাল গুজরাত। দলের দুই ওপেনার শুভমন ও সাই সুদর্শন পাওয়ার প্লে কাজে লাগালেন। ঠিক যেমনটা লাগিয়েছিলেন রাহুল। তাঁরাও জানতেন, উইকেটে পড়ে থাকলেই রান আসবে। সেটাই হল। শিশির পড়ায় বোলারদের কাজ আরও কঠিন হল। দিল্লির কোনও বোলারই তাঁদের সমস্যায় ফেলতে পারেননি। গুজরাতের দুই ব্যাটারও বড় শটের জন্য মাঠের সামনের দিক কাজে লাগালেন। সুদর্শন চার বেশি মারলেও শুভমনের লক্ষ্য ছিল বড় শটের দিকে। শতরানের জুটি হওয়ার পরে মনে হল, দিল্লি হার মেনে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেটাই হল। এই হারের পর দিল্লির প্লে-অফে ওঠা আরও কঠিন হল। রাহুল ব্যাটিংয়ের শিক্ষা দিলেও নিজের দলের ব্যাটারেরাই তা শিখতে পারছেন না। তা হলে আর দিল্লি জিতবে কী ভাবে?