Advertisement
E-Paper

১২ বছর আগে তাঁদের অবহেলা করেছিল এই মুম্বই! সেই শহর থেকেই নতুন স্বপ্নপূরণের শুরু ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের

গত চার-পাঁচ দিন ধরে মহিলা ক্রিকেট নিয়ে যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা, তা মূলত ভারতের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অকল্পনীয় জয়ের কারণে। বলা হচ্ছে, এই বিশ্বকাপ নাকি মহিলা ক্রিকেটবিশ্বের বাজারে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে!

শৌভিক দেবনাথ

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:২৮
cricket

বিশ্বকাপ জেতার পর ট্রফি হাতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স।

নাদিন ডি ক্লার্কের ক্যাচটা হরমনপ্রীত কৌরের তালুবন্দি হতেই শাপমুক্তি! অবশেষে ৪২ বছর বয়সে স্বাবলম্বী হল মহিলাদের ‘বিশ্বকাপ’ ক্রিকেট (প্রথম মহিলা বিশ্বকাপ হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, পুরুষদের বিশ্বকাপের দু’বছর আগে)!

গত চার-পাঁচ দিন ধরে মহিলা ক্রিকেট নিয়ে যে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা, তা মূলত ভারতের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অকল্পনীয় জয়ের কারণে। এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল রবিবারের বিশ্বজয়ে। এই বিশ্বকাপ নাকি মহিলা ক্রিকেটবিশ্বের বাজারে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে! পরিবর্তন আসবে কি না, সময় বলবে। কিন্তু একটা পরিবর্তন এসেই গিয়েছে— মহিলা ক্রিকেট নিয়ে ভাবনায়।

১২ বছর আগে ২০১৩ সালের মহিলা বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ভারত। সমস্ত ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল মুম্বই এবং কটকে। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর সপ্তাহখানেক আগে মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম থেকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) সব ম্যাচ সরিয়ে দেয়। কারণ, মুম্বই রাজ্য দল চেয়েছিল ওয়াংখেড়েতে রঞ্জি ট্রফি ফাইনালটা খেলবে। ঘরোয়া প্রতিযোগিতার জন্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশ্বকাপের ম্যাচ। কারণ, মহিলা ক্রিকেট ‘দুয়োরানি’। সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছিল ওয়াংখেড়ে থেকে সাড়ে ছ’শো মিটার দূরের ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে। পুরো টুর্নামেন্টে গ্যালারিতে সাড়ে ছ’শো লোকও হয়েছিল কি না সন্দেহ! চ্যাম্পিয়ন কারা হয়েছিল, কেউ মনে রাখেননি। কারণ, মহিলা ক্রিকেট ‘দুয়োরানি’।

২০১৭ সালের ২০ জুলাই সম্ভবত ভারতে মহিলা ক্রিকেটের একটা মাইলফলক। ইংল্যান্ডে ডার্বির মাঠে হরমনপ্রীতের অপরাজিত ১৭১ রান। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভারতের ফাইনালে পৌঁছোনো। ক্রিকেটের বাণিজ্যিক সাফল্যের বাস্তুতন্ত্রে ভারতের সাফল্য অনেকটাই নির্ভরশীল। ‘শোলে’ ছবিতে গব্বর সিংহের সংলাপের মতো, ‘‘জব তক তেরে প্যায়ের চলেঙ্গে...তব তক উসকি সাস চলেগি।’’ ভারত বনাম ইংল্যান্ডের ফাইনাল হয়েছিল লর্ডসে। ‘ক্রিকেটের মক্কা’র ৩১,১৮০ আসন ভর্তি ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) তথ্য আরও চমকপ্রদ। ১৮ কোটি দর্শক টিভিতে সেদিনের ম্যাচ সরাসরি দেখেছিলেন। ভারত ৯ রানে হেরেছিল। কিন্তু জিতেছিল মহিলাদের ক্রিকেট। সেই প্রথম মহিলাদের কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা (টি২০ বিশ্বকাপ-সহ ) থেকে আইসিসি বাণিজ্যিক ভাবে লাভের মুখ দেখেছিল।

২০১৭ সালের সেই ‘সাফল্য’ আইসিসি-কে একপ্রকার বাধ্য করে ২০২০ সালের মহিলাদের জন্য আলাদা টি-২০ বিশ্বকাপের আয়োজন করতে। তার আগে পর্যন্ত ছেলেদের টি-২০ বিশ্বকাপের সঙ্গেই করা করা হত মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। মহিলাদের সেই বিশ্বকাপে বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ছিল ভারতের ফাইনালে যাওয়া। তা-ই হয়েছিল। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল হয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। আন্তর্জাতিক নারীদিবসে (৮ মার্চ) ৮৬,৭১৭ দর্শক মাঠে ছিলেন। যা সর্বকালীন রেকর্ড। সেদিনও ভারত হেরেছিল। কিন্তু জিতেছিল মহিলাদের ক্রিকেট।

২০১৭-২০২০ তিন বছরের মধ্যে দু’টি সাফল্য সাহায্য করেছিল তার তিন বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে মহিলাদের আইপিএল শুরু করার সিদ্ধান্ত নিতে। পুরুষদের আইপিএলের মতোই ক্রিকেটারদের নিলাম হয়েছিল। ক্রমশ ‘ইভেন্ট’ হিসাবে গুরুত্ব পেতে থাকে মহিলাদের ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক ম্যাচে পুরুষদের সম পরিমাণ ‘ম্যাচ ফি’ মহিলা ক্রিকেটারদেরও দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিসিসিআই। যেমন দেয় ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া’। সেখানে পুরুষ এবং মহিলা ক্রিকেটারদের বাৎসরিক চুক্তির অর্থের পরিমাণ সমান।

১২ বছর আগের সেই অবহেলার ‘জবাব’ দিল রবিবারের বিশ্বকাপ জয়। এখন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা বা শুভমন গিলই আর ভারতীয় ক্রিকেটের ‘পোস্টার’ নন। স্মৃতি মন্ধানা, হরমনপ্রীত কৌর, জেমাইমা রদ্রিগেসও তাঁদের পাশে জায়গা করে নিয়েছেন বিলবোর্ডে। যেমন, স্কাই স্পোর্টসের পডকাস্টে প্রাক্তন ইংরেজ অধিনায়ক নাসের হুসেন বলেছেন, ‘‘বিশ্বকাপ ফাইনালের ধারাভাষ্য দিতে মুম্বই বিমানবন্দরে নেমে একটা ডিজিটাল বিলবোর্ড দেখলাম। সেখানে ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের বিজ্ঞাপন চলছিল। এত বড় বিলবোর্ড পৃথিবীর কোনও বিমানবন্দরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হোটেল পর্যন্ত গাড়িতে আসার সময় যা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল, তার ৯৯ শতাংশ স্মৃতি, হরমনপ্রীত, জেমাইমার।’’ যেমন, সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জেমাইমার ম্যাচ-জেতানো ইনিংসের পর বাংলাদেশের হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা জোরে বোলার মারুফা আখতার সুদূর নীলফামারি থেকে জেমাইমাকে ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘জেমিদিদি, তোমার এই ইনিংস আমার মতো হাজার হাজার মেয়েকে উদ্বুদ্ধ করেছে ক্রিকেট খেলতে এবং জীবনসংগ্রামে না হারতে।’

এ বারের মহিলা বিশ্বকাপই প্রথম ‘প্রাইম টাইমে’ দেখাল সদ্যপ্রয়াত পীযূষ পাণ্ডের কালজয়ী ‘কুছ খাস হ্যায়...’ বিজ্ঞাপন, যেখানে একজন মহিলা ক্রিকেটার শেষ বলে ছক্কা মেরে দলকে জেতাচ্ছেন আর তাঁর প্রেমিক আনন্দে চকোলেট খেতে খেতে নিরাপত্তার বেড়া টপকে মাঠে ঢুকে তাঁকে জড়িয়ে ধরছেন। মনে রাখতে হবে, মূল বিজ্ঞাপনে ক্রিকেটারটি ছিলেন পুরুষ। বাউন্ডারির দড়ি টপকে ঢুকেছিলেন তাঁর প্রেমিকা। এ বারের মহিলা বিশ্বকাপই প্রথম দেখাল, ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার পুরুষদের টি-২০ সিরিজের বিজ্ঞাপনে সুনীল গাওস্কর এবং নভজোৎ সিংহ সিধুর সঙ্গে রয়েছেন স্মৃতি মন্ধানা। ৪২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম দেখা গেল, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও বিশ্বকাপ ফাইনাল হতে পারে। এমন দু’টি দেশ ফাইনাল খেলল, যেখানে রয়েছে লিঙ্গবৈষম্য।

১২ বছর আগে যে টুর্নামেন্ট দেখতে সাড়ে ছ’শো লোকও যায়নি, সেখানে নবি মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে রবিবার নীল ঢেউ। বৃষ্টির মধ্যেও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নাচছে দর্শকাসনে। পুরুষেরা দিব্যি স্মৃতি, হরমনপ্রীত, জেমাইমার নাম লেখা জার্সি পরে বসে আছেন। এ দৃশ্য ১২ বছর আগে অভাবনীয় ছিল।

১৮ বছর আগে এই স্টেডিয়ামেই ক্রিকেটবিশ্ব জেনেছিল, কারা হল প্রথম আইপিএলজয়ী। পাশাপাশিই দেখিয়েছিল, বাণিজ্যিক ভাবে কোন পথে চালিত হবে ক্রিকেট। রবিবার হরমনবাহিনীর বিশ্বজয়ও মহিলা ক্রিকেটের জন্য খুলে দেবে বাণিজ্যের দুয়ার।

India Women's Cricket Team Harmanpreet Kaur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy