ভারতীয় ক্রিকেটে কোচই সর্বেসর্বা হতে গেলে পরিণতি কী হয়, তা দেখা গিয়েছিল গ্রেগ চ্যাপেলের আমলে। দলের ক্রিকেটারদের ‘বিদ্রোহে’ সরতে হয়েছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোচকেও।
আবার কোচকে টপকে দলের অধিনায়কই পরাক্রমশালী হয়ে উঠলে কী হয় তার উদাহরণও দেখা গিয়েছে অনিল কুম্বলের আমলে। দলের শক্তিশালী ক্রিকেটারদের সামলাতে না পেরে সরে যেতে হয়েছিল কুম্বলেকে।
বিষাণ সিংহ বেদি, চ্যাপেল এবং কুম্বলেরা বুঝতে পারেননি যে তাদের দ্বিতীয় সারিতেই থাকতে হবে। জন রাইট, গ্যারি কার্স্টেন এবং রবি শাস্ত্রীরা বুঝেছিলেন বলেই টিকে গিয়েছিলেন।
গৌতম গম্ভীর এখানেই বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে উঠতে চাইছেন। তিনি চ্যাপেল হতে চাইছেন না। আবার কার্স্টেন, শাস্ত্রীদের মতো দ্বিতীয় সারিতে বসে পা দোলাতেও চাইছেন না। তিনি মাঝামাঝি এমন একটা পথ নিয়েছেন, যেখানে কোচের কথা যেমন শেষ কথা হবে, তেমনই অধিনায়ক বা বাকি ক্রিকেটারদের মতও গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে।
গম্ভীর তারকাপুজোর পক্ষে কোনও দিনই নন। সময় হলে যেতে হবে, এই ভাবনায় বিশ্বাসী বরাবর। কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে সেটা বলেও দিয়েছিলেন। দেওয়াল লিখন তার পরে আর অস্পষ্ট ছিল না। কয়েক দিনের ব্যবধানে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলির টেস্ট থেকে অবসর সেটাই প্রমাণ করল। গত বছরের মাঝ ডিসেম্বর থেকে মে-র মাঝামাঝি, গম্ভীর-যুগে এই ছ’মাসে তিন ক্রিকেটারের অবসর সহজে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
রোহিত, কোহলি এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন টেস্ট থেকে সরে যাওয়ায় এখনকার দল তারকাহীন। শোনা যাচ্ছে, গম্ভীর কোচ হওয়ার আগে থেকেই নিজের নোটবুকে কিছু তালিকা তৈরি করে এসেছিলেন। তার মধ্যে সবার উপরে ছিল দলের অন্দরে তারকাপুজোর বর্জন।
বোর্ডের এক সূত্র বলেছেন, “এ বার গম্ভীরের যুগ শুরু হল। আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে পরের টেস্ট বিশ্বকাপের মেয়াদ শুরু হওয়ার আগে দলে তরুণ মুখ চাই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দলে যারা আছে তারা ভালমতোই জানত যে টেস্টে সিনিয়রদের নিয়ে গম্ভীরের ভাবনাচিন্তা ঠিক কী। গম্ভীর নিজের দলে টেনে নিয়েছে নির্বাচক প্রধান অজিত আগরকরকেও।”
ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কেরা বরাবরই কোচের উপরের স্তরে থাকার চেষ্টা করেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি থেকে কোহলি এবং রোহিতও তার ব্যতিক্রম নন। তবে গম্ভীর-যুগে আর সেটা হবে না। এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বশক্তিমান তিনিই, এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
রাহুল দ্রাবিড়-রোহিতের সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল না। কম সময়ের ‘সুখী বিবাহ’ হিসাবে দেখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু রোহিতের সঙ্গে গম্ভীরের বনিবনা ছিল, এটা ভাবলে ভুল হবে। গম্ভীর এতটাই প্রভাব ফেলেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে যে, এই মুহূর্তের দুই তারকাকে ছেঁটে ফেলার বার্তা দিতে দেরি করেননি।
শোনা যাচ্ছে, গম্ভীর আগেই বোর্ডকে জানিয়েছিলেন, নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ে ভারতের যে অসম্মান হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় তার জন্য তাঁকে ক্ষমতা দিতে হবে। বোর্ড সেটা দিয়েছে। প্রমাণ রোহিত এবং কোহলির পর পর অবসর।
আরও পড়ুন:
গম্ভীর এই কাজ শুরু করেছিলেন অনেক আগে। পাঁচটি ঘটনায় তার প্রমাণ রয়েছে।
প্রথম, গত বছরের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া সফরের মাঝপথে অশ্বিনকে বলে দিয়েছিলেন, ‘তোমায় আর দরকার নেই’। বুদ্ধিমান অশ্বিন দেওয়াল লিখন পড়তে দেরি করেননি। বিদেশেই অবসর নিয়ে সফরের মাঝপথে ফিরে এসেছিলেন। কারও উপর কোনও রাগ দেখাননি। তবে নেপথ্যে কে, সেটা কারও বুঝতে বাকি ছিল না।
দ্বিতীয়, সিডনি টেস্টের আগের দিন সটান সাংবাদিক বৈঠকে চলে এসেছিলেন গম্ভীর। এসেই বলে দিয়েছিলেন, পঞ্চম টেস্টে অধিনায়ক রোহিত ‘অটোম্যাটিক চয়েস’ নন। হেড কোচ বলেছিলেন, ‘‘আমরা ম্যাচের আগে চূড়ান্ত দল বেছে নেব।’’ গম্ভীরকে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম প্রশ্নও করেছিল, “ম্যাচের আগে সাংবাদিক বৈঠকে তো অধিনায়কের আসার প্রথা রয়েছে। তা হলে আপনি কেন? রোহিতের কী হল?” কিছুটা বাঁকা চোখে তাকিয়ে গম্ভীরের জবাব ছিল, “কে বলেছে অধিনায়কের আসা প্রথা? কোচ এসেছে। আমার মনে হয় সেটাই যথেষ্ট। রোহিত একদম ঠিক আছে। আগে পিচ দেখব, তার পর কাল প্রথম দল নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।” এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। তবে রোহিত সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘টুমরো’ শব্দটির আগে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়েছিলেন গম্ভীর। অনেকের মতে যা ছিল ‘ইঙ্গিতবাহী’। ‘খবর’ ছড়িয়েছিল, সিডনি টেস্টে খেলবেন না রোহিত। তাঁর জায়গায় অধিনায়কত্ব করবেন সিরিজ়ে সফলতম ভারতীয় ক্রিকেটার (এবং পার্থ টেস্টে অধিনায়কত্ব করা) জসপ্রীত বুমরাহ। সেটাই হয়েছিল।
তৃতীয়, সিডনি টেস্টে হারের পর দেশে ফিরে যখন কাটাছেঁড়া চলছিল তখনই গম্ভীর তারকাদের উদ্দেশে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারতের দলে জায়গা পেতে গেলে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে হবে। শুরুতে কেউ আমল দেননি। কিন্তু গম্ভীরের অবস্থান বুঝে নিমরাজি হয়েছিলেন। রোহিত, কোহলি ছাড়াও যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমনের মতো ক্রিকেটারদের রঞ্জি খেলতে দেখা গিয়েছিল। তাতে যে পারফরম্যান্সের বিরাট উন্নতি হয়েছিল এমন নয়। তবে গম্ভীর সিনিয়রদের এই বার্তাটুকু দিয়েছিলেন, তুমি যতই কেউকেটা হও, ভারতীয় ক্রিকেটের থেকে বড় নও।
চতুর্থ, কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টরের দায়িত্ব থেকে গম্ভীর ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার আগে সহকারী কোচ হিসাবে তিন জনকে চেয়েছিলেন। অভিষেক নায়ার, মর্নি মর্কেল ও রায়ান টেন দুশখাতে। তিন জনের নামেই সিলমোহর দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। এই তিন জনের সঙ্গে কেকেআরে সময় কাটিয়েছিলেন গম্ভীর। তাই তাঁদের ভাল ভাবে চেনেন তিনি। দ্রাবিড় জমানার বাকি সহকারী কোচদের চাকরি গেলেও এক জন থেকে গিয়েছিলেন— টি দিলীপ। দলের ফিল্ডিং কোচ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বা তার আগে এক দিনের বিশ্বকাপে ভারতের ফিল্ডিংয়ের মান ভাল ছিল। যে ভাবে তিনি প্রতিটি ম্যাচের পর সেরা ফিল্ডারকে পুরস্কার দেন, সে ভাবেই তাঁকে পুরস্কার দিয়েছিল বোর্ড। একমাত্র দিলীপই ছিলেন গম্ভীরের অপরিচিত। ১০ মাস পরে সেই দিলীপের চাকরিও যায়। তাঁকে যে গম্ভীর চাইছিলেন না, তা বোর্ডের সিদ্ধান্ত থেকে পরিষ্কার হয়েছিল। তবে নায়ারকে গম্ভীর চাইলেও তাঁর কাজ নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিশেষ করে দেশের মাটিতে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে চুনকাম ও পরে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সিরিজ় হারের দায় ছিল ব্যাটারদের কাঁধে। সহকারী কোচ হিসাবে ব্যাটিংয়ের দিকে নজর রাখার দায়িত্ব ছিল নায়ারের। সেই দায়িত্বে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের পরেই হয়তো চাকরি যেত নায়ারের। কিন্তু সেই চাকরি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন রোহিত। ভারত অধিনায়কের মতো নায়ারও মুম্বইয়ের ক্রিকেটার। আগে রোহিত অনেক বার নিজের ফিটনেস ও ব্যাটিংয়ের জন্য নায়ারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। রোহিত ভেবেছিলেন, তিনি যত দিন রয়েছেন নায়ারও টিকে যাবেন। সেই ভাবনা ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি গম্ভীর।
পঞ্চম, পাঁচ দিনের ব্যবধানে রোহিত এবং কোহলির টেস্ট থেকে অবসর। ক্রিকেটজীবনের সায়াহ্নে থাকা দুই খেলোয়াড়কে দেখে গম্ভীর বুঝেছিলেন, ইংল্যান্ড সিরিজ়ে তাঁরা অচল। টেস্টে দু’জনেই পারফরম্যান্সের তলানিতে ছিলেন। অতীতে পারফরম্যান্স এবং তারকাসুলভ উপস্থিতি ছাড়া দলে তাঁদের জায়গা পাওয়া কঠিন ছিল। গম্ভীর সে সবের দিকে ফিরেও তাকাননি। কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “যত দিন ওরা (রোহিত, কোহলি) ভাল খেলছে, তত দিন দলে থাকবেই। পারফরম্যান্সের উপরেই দল নির্বাচন হয়। কোচ, নির্বাচন বা বিসিসিআইও কাউকে বলে দিতে পারে না যে তুমি ক্রিকেট ছেড়ে দাও। যদি ওরা ৪০ পর্যন্ত খেলতে পারে তা হলে খেলবে। কেউ ওদের বাদ দিতে পারবে না।”
দেওয়াল লিখন কতটা স্পষ্ট ছিল, এই মন্তব্যের পর কি আর তা নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে!