ভারত অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। ফাইল চিত্র।
অধিনায়ক বিরাট কোহলির মাথায় অনেক মুকুটই হয়তো রয়েছে। কিন্তু সে সবই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় জয়ের পুরস্কার। অধিনায়ক হিসেবে সফল পরিসংখ্যানের অধিকারী হলেও ক্যাবিনেটে আইসিসি ট্রফি নেই বিরাটের। একটা দিক থেকে দেখলে সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর পৃথিবীতে আইসিসি ট্রফিতে সাফল্য না পেয়েও মুকুটু বাঁচিয়ে রাখতে পারলে তাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে।
এক নিঃশ্বাসে এটাও বলা দরকার যে, বিরাট একা নয়। ওর আগেও অনেক অধিনায়ক দীর্ঘ দিন মসনদে থেকেছে বিশ্বকাপ বা আইসিসি ট্রফিতে কিছু না করেও। তারা অনেকে গদি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে বোর্ডে ‘গডফাদার’ থাকার জন্য।
একটু অন্য রকম কথাই বলব যে, ‘গডফাদার’ না থেকেও অধিনায়ক হিসেবে সফল হওয়ার সেরা উদাহরণ আমার কাছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। জানি, অনেকেই পাল্টা বলবেন, এন শ্রীনিবাসনের নাম। মনে করিয়ে দিতে চাইবেন, কী ভাবে জাতীয় নির্বাচকেরা অধিনায়ক ধোনিকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও শ্রীনিবাসন সেই সিদ্ধান্তকে উল্টে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ধোনিকেই অধিনায়ক রেখে দিয়েছিলেন। ঘটনা হচ্ছে, ধোনির ক্রিকেটজীবনে শ্রীনিবাসনের প্রভাব এসেছে অনেক পরে। তত দিনে কিন্তু রাঁচী, খড়গপুর হয়ে ছোট শহরের একেবারে আনকোরা প্রতিভা হিসেবে হাজির হয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে ভাল মতো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে ধোনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যখন তরুণ দল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল তরুণ অধিনায়ক, তখন কোথায় শ্রীনিবাসনের হাত ছিল ওর মাথার উপরে? ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা সাফল্যগুলোর একটা হিসেবে থেকে যাওয়া উচিত এই জয়। সেই সময় ধোনির পিঠে না ছিল বোর্ডের কোনও সর্বময় কর্তার হাত, না ছিল কোনও রাজনৈতিক সমর্থন। ভারতের অধিনায়ক নির্বাচনের ইতিহাসে এই দু’টো প্রভাবই বহু বার দেখা গিয়েছে। ধোনি যখন ২০০৭-এ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতে, বোর্ড প্রেসিডেন্ট তখন শরদ পওয়ার। তার পরের বোর্ড প্রধান শশাঙ্ক মনোহর। তারও পরে আসেন শ্রীনিবাসন। তত দিনে ধোনি সেরা ভারতীয় তারকাদের একজন।
আমি বরং বলব, ধোনির মতো প্রতিভাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উন্মোচন করতে অনেক দেরি হয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩, ও যখন বিহারের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছিল, তখনই সকলে ওর অসামান্য প্রতিভা সম্পর্কে জানত। অথচ পাঁচ বছর ধরে ধোনিকে ঘরোয়া ক্রিকেটের মাঠেই পড়ে থাকতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে উন্নীত করার মতো যথেষ্ট সমর্থন কিন্তু শুরুর দিকে পায়নি ধোনি। তার পরেও ও-ই একমাত্র ভারত অধিনায়ক, যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেশের হয়ে সব রকম মুকুট জিতে দেখিয়েছে। দু’বার বিশ্বকাপ জয় (২০০৭ টি-টোয়েন্টি, ২০১১ পঞ্চাশ ওভার), এক বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ভুলে গেলে চলবে না, ওর অধীনে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরও হয়েছিল ভারত। আর কোন অধিনায়কের এমন ঝলমলে ট্রফি ক্যাবিনেট রয়েছে?
ভারত অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে নেতা বাছতে গিয়ে। ১৯৪৬-এ ইংল্যান্ড সফরের জন্য দলীপ সিংহজি, কন্ট্রাক্টর, সুব্বারায়নের মতো নির্বাচকেরা অধিনায়ক বানিয়ে দিলেন ইফতিকার আলি খান পটৌডিকে। তত দিনে ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর সব জৌলুসই অতীত। বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি যে, ১৯৩৬-এ ইফতিকার নির্বাচক হয়ে গিয়েছিলেন। এমন আজগুবি ঘটনা কখনও কেউ শুনেছে যে, নির্বাচক হিসেবে কাজ করার দশ বছর পরে কেউ দেশের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছে! কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে সবই সম্ভব। এমন সব অদ্ভুত ধরনের অধিনায়ক নির্বাচনের ঘটনায় ভর্তি হয়ে রয়েছে আমাদের দেশের ক্রিকেট ইতিহাস। ১৯৪৬-এর সেই ইংল্যান্ড সফরে পটৌডি পাঁচ ইনিংস মিলিয়ে ৫৫ রান করেন। বারবার প্রশ্ন উঠেছে, কারা এমন নির্বাচনের নেপথ্যে? ভারতীয় বোর্ডের প্রভাবশালী কর্তাদের হাত থাকবে না, ভাবা কঠিন। বাইরে থেকে প্রবল ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপের ঘটনার কথাও শোনা যায়। কিন্তু দিনের শেষে সেই তো নির্বাচকদের ঘাড়ে গিয়ে দোষ চাপবে। যাবতীয় প্রশ্নের মুখে তাঁদেরই পড়তে হবে। তাঁদেরই দায় নিতে হবে।
১৯৫৮-র ইংল্যান্ড সফরে দলে সুযোগ পাওয়ারও যোগ্য নন, এমন এক জনকে অধিনায়ক বেছে নেওয়া হল— দত্তাজিরাও গায়কোয়াড়। সেরা ক্রিকেটার পলি উমরিগড়কে অধিনায়ক করা হল না কারণ, পলি নিজের বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনায় চলবেন। নব্বইয়ের দশকে রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর যখন কয়েকটি বিশেষ মহলকে চুপ করানোর জন্য মহম্মদ আজ়হারউদ্দিনকে অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিলেন, তখন আজ়হারের কোনও নেতৃত্ব গুণই ছিল না। ম্যাচ গড়াপেটার মারাত্মক অভিযোগে বিতর্কবিদ্ধ হতে হল আজ়হারকে। তার পরে সৌরভের নেতৃত্বে তাজা বাতাস এসেছিল ভারতীয় ক্রিকেটে। কিন্তু যে মুহূর্তে ক্রিকেট প্রশাসনে জগমোহন ডালমিয়ার ক্ষমতা খর্ব হতে শুরু হল, অধিনায়ক হিসেবে সৌরভের সম্ভাবনাও কমতে থাকল। ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ ভাবেই মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের প্রভাব বেশি দেখা গিয়েছে। এখন বিরাট কোহলিকে সরিয়ে যে ভঙ্গিতে রোহিত শর্মাকে নেতা বেছে নেওয়া হল, তাতে স্পষ্ট, পুরনো প্রথা এখনও চলছে। নেতৃত্বের মিউজ়িক্যাল চেয়ারের খেলা আজও থামেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy