সচিন তেন্ডুলকর অবসর নেওয়ার পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, ভারতীয় দলে কে নেবেন তাঁর জায়গা? মুম্বইয়ের ক্রিকেটমহল একটু বেশিই উদ্বিগ্ন ছিল বোধহয়। খেলতে খেলতে নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা সচিনের শূন্যস্থান ভরাট করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এক তরুণকে। মুম্বই তথা গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে উত্তর দিয়েছিল দিল্লি। সেই উত্তরের নাম ছিল বিরাট কোহলি।
দেখতে দেখতে ভারতীয় ক্রিকেটে উপস্থিত কোহলি-উত্তর যুগ। চিকু (কোহলির ডাকনাম) আর ভারতের জার্সি পরে ২২ গজের দিকে হেঁটে যাবেন না (এক দিনের ক্রিকেট ছাড়া)। শূন্যস্থান পূরণ করা কোহলি নিজেই তৈরি করলেন আর একটি শূন্যস্থান। জীবনের বৃত্ত এ ভাবেই পূর্ণ হয়। সদা অগ্রগামী জীবন থামতে পারে না। জানে না। সময়ের পরতে পরতে বদলাতে হয় নিজেকে। সেই বদলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেটও মানিয়ে নিয়েছে অতীতে। এ বারও হয়তো নেবে। মানিয়ে নিতে হবে কোহলিকেও। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার থেকে হঠাৎ প্রাক্তন খেলোয়াড়ের জীবনে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। কোহলি নিশ্চই পারবেন। যিনি সচিনের মতো ক্রিকেটারের জায়গায় মানিয়ে নিতে পেরেছেন, বিশ্বের সব প্রান্তে সব ধরনের পিচে সব বোলারের বিরুদ্ধে পেরেছেন, তাঁর কাছে কী এমন কঠিন কাজ!
ভারতে ক্রিকেট ধর্মের মতো। পূজিত হন ক্রিকেটারেরা। সচিনের মতো কোহলিও ক্রিকেট ঈশ্বরের বরপুত্র। তাঁর অভাব অনুভব করবে ভারতীয় দল। অনুভব করবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। আর কয়েকটা দিন হয়তো অনায়াসে টেস্ট খেলতে পারতেন। ব্যাট হাতে রান করা কী এমন কঠিন কাজ তাঁর কাছে! ৩৬ বছর বয়সই বা কী এমন বেশি! আর কটা দিন খেললে কী ক্ষতি হত ক্রিকেটের? সেরা ফর্মে ছিলেন না বেশ কিছু দিন ধরে। মাঝে মধ্যে বড় রান করলেও তাতে কোহলিসুলভ ছাপ থাকছিল না। খেটে রান করতে হচ্ছিল। অফ স্টাম্পের বাইরের বলগুলি বড্ড সমস্যা করছিল। চোখ গেলেও বলের লাইনে পা যাচ্ছিল না। রানের খোঁজে অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন অনেক বার। বিশ্বের সব খেলোয়াড়ের জীবনেই অফ ফর্ম আসে। চলেও যায়। তাই বলে কি খেলার মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হবে? কোহলি চেষ্টা করলে পারতেন না ফর্ম ফিরে পেতে? লড়াই ছেড়ে দেওয়ার মানুষ তো তিনি নন! আইপিএলে নিজের মতোই তো খেলছিলেন। তবু অবসর নিয়ে ফেললেন। টি-টোয়েন্টির পর টেস্ট ক্রিকেট থেকেও। অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীর কথা একটু ভাবলেন না!
কোহলি ভেবেছেন। ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অনুরোধেও মন গলেনি তাঁর! রোহিত শর্মার পর তিনিও সরে গেলেন লাল বলের ক্রিকেট থেকে। একসময় সকলকে থামতে হয়। কোহলিকেও হল। বড় খেলোয়াড়েরা জানেন, ঠিক কখন থামতে হয়। তাঁরা থামেন যাত্রাপথের শেষের খানিকটা আগে। যাতে প্রশ্ন না ওঠে, কেন থামছেন না। একই সঙ্গে পথের শেষটুকু অজানা থেকে যাওয়ার আফসোস রয়ে যায়। সময় যত নিখুঁত হয়, অবসর তত আকর্ষণীয় হয়। কোহলির টাইমিংয়ের কথা অজানা নয় ক্রিকেটবিশ্বের। ক্রমে কোহলি হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ভরসা। ক্রিকেটপ্রেমীদের ভরসা। প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। সেই কোহলি নিজের ক্রিকেটজীবনে ইতি টানলেন ছোটগল্পের মতো করে। কোনও একটা উত্তর যেন বাকি থেকে গেল! ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য পড়ে থাকল বছরে আট-দশটা এক দিনের ম্যাচ।
বাকি থাকা উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে প্রায় দু’দশকের ক্রিকেটজীবনে যতগুলি উত্তর দিয়েছেন, তার যোগফল নেহাত ছোট নয়। ভারতীয় ক্রিকেটে কোহলির আগমন বিস্ময়বালক হিসাবে হয়নি। তিনি এসেছিলেন প্রতিভাবান ব্যাটার হিসাবে। ২০০৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। ক্রিকেটার কোহলির উত্থানের প্রথম ধাপ হিসাবে সেটাই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। বিরাট হয়ে ওঠার পরেও নিজেকে ক্রিকেটের নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী মনে করেছেন কোহলি। অনুশীলন, নিজের প্রস্তুতির সঙ্গে কখনও আপস করেননি। ক্রিকেটের জন্য বদলে ফেলেছেন নিজের জীবনদর্শন, যা তাঁকে বাকি সকলের থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
ছোটবেলায় প্রায় দিনই অনুশীলনের পর চনচনে খিদে মেটাতেন প্রিয় ছোলে-বাটুরে দিয়ে। ক্রিকেটের জন্য প্রিয় সেই খাবার ২০১৪ সালের পর মুখে তোলেননি। সম্পর্ক চুকিয়ে দেন প্রিয় বাটার চিকেনের সঙ্গেও। ফিটনেসের জন্য বদলে ফেলেছেন নিজের খাদ্যাভ্যাস। ক্রিকেটের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন প্রিয় আরও অনেক কিছু। যাঁরা খাওয়ার ব্যাপারে কঠোর নিয়ম মেনে চলেন, তাঁরাও মাঝে মধ্যে একটু-আধটু অনিয়ম করেন। কোহলি সে বান্দা নন। এক বার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এক দিনের জন্য ছাড় পেলে প্রিয় কোন খাবার খেতে চান? কোহলি বলেছিলেন, কোনওটাই খাব না। কারণ পরের দিন অতিরিক্ত এক ঘণ্টা ট্রেনিং করার চাপ নেওয়া খুব কঠিন। ফিটনেস সচেতন কোহলি এমনই। নিখুঁত থাকতে চেয়েছেন সবসময়। খাওয়ার নিয়ম ভেঙে বাড়তি ট্রেনিং করায় সায় নেই তাঁর। খেয়েছেন যেমন নিয়ম মেনে, তেমন ট্রেনিংও করেছেন নির্দিষ্ট সূচি অনুযায়ী। প্রতিভা এবং পরিশ্রমের যোগফলের অন্যতম উদাহরণ কোহলি। সাজগোজে ধোপদুরস্ত কোহলি ফিটনেস নিয়ে পরীক্ষার পথে হাঁটতে চাননি।
সচিনের শূন্যস্থান পূরণ করা কোহলি কেমন ক্রিকেটার, তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না। তেমনই মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পর ভারতীয় দলের অধিনায়ক হওয়া কোহলি কেমন নেতা, তা-ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এ সবের জন্য পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। যে কোনও অধিনায়কই চান নিজের মতো করে দল পরিচালনা করতে। কোহলিও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ভারতের হয়ে খেলতে হলে নির্দিষ্ট ফিটনেস বজায় রাখতে হবে, এই নিয়ম কোহলিই তৈরি করেছিলেন। সতীর্থদের বলার আগে নিজে করে দেখিয়েছেন। ঠিক তেমনই ম্যাচের পর ম্যাচ নিজে রান করেছেন। প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের আগ্রাসী মানসিকতা ঠেকিয়েছেন পাল্টা আগ্রাসনে। সব মিলিয়ে কোহলি সতীর্থদের সামনে নিজেকে উদাহরণ করে তোলেন। ক্রিকেটের নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করেন। যে ব্র্যান্ডের ভিত ফিটনেস, পারফরম্যান্স এবং আগ্রাসী মেজাজের মিশেলে তৈরি, যা অননুকরণীয়।
তিন বছর বয়সে বাবা প্রেমনাথ কোহলির সঙ্গে বাড়ির উঠোনে ক্রিকেট খেলা শুরু। ছোট্ট কোহলিকে টানা বল করতে হত প্রেমনাথকে। ব্যাট ছাড়তেন না ছোট্ট কোহলি। ছেলের বয়স ১০ হওয়ার পর রাজকুমার শর্মার ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেন প্রেমনাথ। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন কোহলি। ক্রিকেটার কোহলির শুরুর পথ অবশ্য মসৃণ ছিল না। দিল্লির অনূর্ধ্ব ১৪ দলে জায়গা পাকা করতে পারেননি। কয়েকটি ম্যাচের পরই বাদ পড়তে হয়েছিল পারফর্ম করতে না পারায়। এক বছরের মাথায় সেই কোহলিই দিল্লির অনূর্ধ্ব ১৫ দলে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন। আর কখনও দল থেকে বাদ পড়তে হয়নি। শুধু এগিয়েছেন। নিজেকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সব করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও করেছেন। দরকারে ছুটে গিয়েছেন রাজকুমারের কাছে। ভুল শুধরে নিতে লজ্জা পাননি। সময় সময় নিজের খেলার পরিবর্তন, পরিমার্জন করেছেন। ভারতীয় দলের নেতৃত্ব ছাড়ার বিতর্কিত অধ্যায়কেও শাসন করেছেন ব্যাট হাতে। মাত্রা ছাড়াতে দেননি। মাঠের ভিতরে বা বাইরে। পরিস্থিতি আগাম অনুমান করতে পারার দক্ষতাই তাঁকে অনন্য করে তুলেছে।
২০০৮ সালে প্রথম শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজ়ের জন্য ভারতীয় দলে ডাক পান কোহলি। তার আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে মাত্র আটটি ৫০ ওভারের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। কোহলির ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া বিস্মিত করেছিল অনেককে। তার পর তিন ধরনের ক্রিকেটে একের পর এক বিস্ময়কর ইনিংস খেলে তাঁদের বিস্ময় আরও বাড়িয়ে তুলেছেন কোহলি। পৃথিবীর সর্বত্র সাফল্য পেয়েছেন। সব দলের বিরুদ্ধে পেয়েছেন।
অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ছাড়াও কোহলির মুকুটে রয়েছে ২০১১ সালের এক দিনের বিশ্বকাপ, ২০১৩ এবং ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তিনি অধিনায়ক থাকার সময় পর পর তিন বছর (২০১৭ থেকে ২০১৯) টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা দল হয়েছে ভারত। ভারতীয় ক্রিকেটকে ভরিয়ে দিয়েছেন কোহলি। নেতৃত্ব ছাড়ার পরেও তিনিই ছিলেন দলের নেতা। প্রয়োজনে মাঠে অধিনায়ককে পরামর্শ দেওয়া হোক বা দলের নতুন সদস্যদের জন্য সাজঘরের পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ করে তোলা— সবসময় এগিয়ে গিয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন। বিরাট-ব্যক্তিত্বের আবরণ তৈরি করে রাখেননি চারপাশে। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সতীর্থদের মাঝে। ব্যাটিং বা ফিল্ডিং নিয়ে কারও সমস্যা হলে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। বোলারদের বাতলে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের আউট করার কৌশল। উৎসাহিত করেছেন প্রতি মুহূর্তে।
সোমবার ১২ মে, নিজের টেস্টজীবনে ইতি টানলেন কোহলি। দেশের হয়ে ১২৩টি টেস্ট খেলে কোহলি করেছেন ৯২৩০ রান। গড় ৪৬.৮৫। ৩০টি শতরান এবং ৩১টি অর্ধশতরান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ২০১৯ সালে পুণেতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলেছিলেন অপরাজিত ২৫৪ রানের ইনিংস, যা টেস্ট ক্রিকেটে কোহলির সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ২০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেছিলেন। থাকল শুধু এক দিনের আন্তর্জাতিক।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ক্রিকেটজীবনের মতো ব্যক্তিজীবনেও কোহলি ব্যতিক্রমী। বলিউড অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন। দেশের সবচেয়ে আলোচিত দম্পতিদের মধ্যে অন্যতম বিরুষ্কা। বিতর্কহীন রেখেছেন ব্যক্তিগত জীবনকেও। দুই সন্তানের পিতা কোহলি দায়িত্বশীল বাবাও। সন্তানদের প্রচারের লক্ষ ওয়াটের আলো থেকে দূরে রাখেন। ক্রিকেটীয় ব্যস্ততার বাইরে পরিবারকে সময় দেন। পেশা এবং ব্যক্তিজীবনের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম পর্দা ছিঁড়তে দেননি কখনও। ভারসাম্য বজায় রেখেছেন সচেতন ভাবে। স্বচ্ছন্দে।
পিতা কোহলির স্নেহভরা চোখই প্রতিপক্ষের কাছে আতঙ্কের। আশঙ্কার। যে আগুনে ছারখার হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তানের মতো প্রতিপক্ষ। কোহলিহীন ভারতীয় ক্রিকেটকে কিছু দিন গন্ধহীন গোলাপ মনে হতে পারে। যে ফুলের কাঁটা থাকবে কিন্তু গন্ধ থাকবে না। কাঁটা উপড়ে ফেলার জন্য কোহলিও থাকবেন না। সামান্য সম্ভাবনার গন্ধে সতীর্থদের বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ করানোর মতো কেউ থাকবেন না। মাঠে দল সমস্যায় পড়লে তাঁর দ্বারস্থ হতে পারবেন না সতীর্থেরা। তবু তিনি থাকবেন। তাঁর অনুপস্থিতিই হয়তো বাকিদেরও আরও সতর্ক করবে। আরও বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত করে তুলবে। সকলে মিলে ভরাট করবেন ২২ গজের লড়াইয়ে কোহলির শূন্যতা।
অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীর হতাশা মেটাবেন কে? না-পাওয়া একটা উত্তরের জন্য হাপিত্যেশ করেই থাকতে হবে তাঁদের। বৃত্ত পূর্ণ করা কোহলি প্রাক্তন হয়ে গেলেন ছোটগল্পের শেষটুকু ধোঁয়াশার আড়ালে রেখে।