শিবরাম চক্রবর্তীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র কাঞ্চনের সঙ্গে অদ্ভুত মিল সৌম্যা গুগুলথের। প্রথম জন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল অনুশাসন মুক্ত জীবনের খোঁজে। দ্বিতীয় জন পালাতেন ফুটবল খেলার জন্য। কারণ মেয়ে হয়ে সন্তান মানুষ করার পরিবর্তে মাঠে দাপিয়ে ফুটবল খেলবে এটা একেবারেই তাঁর পরিবার চাইতেন না। তাই লুকিয়েই চলত ফুটবলের সাধনা।
কাঞ্চন কিন্তু পরে জানিয়েছিল, তাঁর কাছে গ্রামের জীবনই ভাল ছিল। এখানেই পার্থক্য গড়েছে সৌম্যা। সে বেঁচে থাকতে চেয়েছে ফুটবল নিয়েই। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করার পরেই বাড়ির তরফে অনুমতি মেলে। কিন্তু এখানেই লড়াইয়ের ইতি ঘটেনি। তার পরেও আত্মীয়স্বজনদের বাধা-বিপত্তি ধেয়ে আসতে থাকে। এ বারে লড়াকু সৌম্যার পক্ষে দাঁড়ান তাঁর বাবা। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মেয়ে ফুটবলই খেলবে।
লাজুক স্বরে এই কাহিনি বলার সময়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন তেলঙ্গানার লড়াকু কন্যা সৌম্যা। মেয়েদের আই লিগে যিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে নয় গোল করে ফেলেছেন। যা ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক। অথচ এত লড়াই করে যে ফুটবল খেলতে চাওয়া, শুরুর দিকে সেই খেলা তাঁর শয়নে-স্বপনে ছিল না।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিদ্যালয়ের এক প্রতিযোগিতায় ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার এবং ৮০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় হন সৌম্যা। প্রথমে ভেবেছিলেন অ্যাথলিটই হবেন। কিন্তু তাঁর গতি দেখে বিদ্যালয়ের খেলার শিক্ষক জানান, অ্যাথলিট নয়, সৌম্যার ফুটবলের দিকে যাওয়া উচিত। তাঁর সরল স্বীকারোক্তি, “অথচ সেই সময়ে ফুটবল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।” ভাগ্যিস সে দিন ফুটবলকে আপন করে নিয়েছিলেন, না হলে হয়তো তাঁর লড়াইয়ের কাহিনিও চিরদিনের মতো অন্তরালে চলে যেত।
পড়াশোনার জন্য তাঁর পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে হয়। কিন্তু ফুটবলার হওয়ার সেই পরামর্শ তিনি ভোলেননি। স্থানীয় এক প্রশিক্ষকের কাছে শুরু করেন ফুটবল-সাধনা। সৌম্যার কথায়, “তখন খুব লজ্জা লাগত। দু’তিন জন বাদে সবাই ছেলে ছিল। হাফ-প্যান্ট পরে খেলতে হত। বাবা-মাও সমর্থন করেননি। বিদ্যালয় শেষের পরে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে খেলতে চলে যেতাম। এক প্রকার গোপনেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।”
বাবার অনুমতি আদায়ের পরে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন ডাক পান জাতীয় দলের ট্রায়ালে। খুশির ঝিলিক খেলে যায় তাঁর মুখে। “দশ জনের মধ্যে আমি এক মাত্র শিবিরে সুযোগ পাই। তার পরে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনূর্ধ্ব-১৪ পর্যায়ে খেলি। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, যে সুযোগ পেয়েছি তা হাতছাড়া করলে চলবে না।” সুযোগ কিন্তু হাতছাড়া করেননি সৌম্যা। ওড়িশা এফসি-র সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় করা তাঁর একমাত্র গোলের সৌজন্যেই মহিলা ফুটবলে ভারতসেরা হয় ইস্টবেঙ্গল।
২০২১-’২২ মরসুমে গোকুলম কেরলের হয়ে আই লিগ জেতেন। সেই দলেরও কোচ ছিলেন বর্তমানে ইস্টবেঙ্গলের কোচ অ্যান্টনি অ্যান্ড্রুস। কেন ইস্টবেঙ্গলে আসা? সৌম্যা বলেন, “অ্যান্টনি স্যরের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই উনি ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব পাওয়ার পরে আমাকে নিতে চাইলে দু’বার ভাবিনি। এ ছাড়াও লাল-হলুদের সমর্থকদের দেখে আমি আপ্লুত। গোকুলমে খেলার সময়ে আমরা এত সমর্থন পাইনি। প্রত্যেক দিন আরও ভাল খেলতে উজ্জীবিত করে এই সমর্থকরাই।” যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ট্রফি জয়ের দিনে। এই কারণেই ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেতাব জয়কে অনেকটাই এগিয়ে রাখছেন সৌম্যা।
প্রধানত খেলেন উইঙ্গার হিসেবে। দলের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তার কথায়,“শুধু গোল করা নয়, ওঁর মাপা ক্রস পুরুষ দলের ফুটবালরদেরও রীতিমতো পরীক্ষায় ফেলে দেবে। তা থেকে গোল করতে না পারাটাই বরং কঠিন কাজ।” গোলের পরে তাঁর আদর্শ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর অনুকরণে শূন্যে লাফিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে উৎসব করেন সৌম্যা। এমনকি তাঁর জন্যই পরেন ৭ নম্বর জার্সিও।
গোকুলম কেরলের হয়ে আই লিগ জয়ের পরেই ডাক পান ক্রোয়েশিয়ার ক্লাব ডায়নামো জাগ্রেভে। সেই ট্রায়াল হয়েছিল কলকাতাতেই। সেখানেও নিজের ছাপ ফেলেছেন সৌম্যা। সেই লিগে তাঁর নামের পাশে একটি গোলও রয়েছে। কেন সেই ক্লাব ছাড়লেন? সৌম্যার বক্তব্যে উঠে আসে পরিকাঠামোগত অভাবের কথা। তিনি বলেন, “ওই ক্লাবে আমাদের অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলতে হয়। মেয়েদের জন্য পরিকাঠামো একেবারেই উপযুক্ত নয়। অনুশীলনে যাওয়ার জন্য সব সময়ে বাস পাওয়া যায় না। অনেক সময় মেট্রোতে চড়েও যেতে হয়েছে।”
সিনিয়র পর্যায়ে জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর অভিষেক হয় ২০২১ সালে উজ়বেকিস্তানের বিরুদ্ধে। পরের বছর মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোল আসে। এখনও পর্যন্ত ৩৩ ম্যাচে ভারতের হয়ে করেছেন ৫ গোল।
এখানেই থেমে থাকতে চান না সৌম্যা। তাঁর পরের লক্ষ্য মেয়েদের এএফসি ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে দলকে সেরা করা। তার আগে রয়েছে জাতীয় দলের খেলাও। যে দৌড় তিনি ছোটবেলায় শুরু করেছিলেন সেই দৌড় লক্ষ্যে পৌঁছনো না পর্যন্ত থামাতে চান না। অবশ্য মেনেও নিলেন, এখনও তাঁকে শারীরিক ভাবে আরও কিছুটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে।
ট্রফি পাওয়ার পরে মাঠে বসে একাকী বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন। যোগ্য জবাব কি দেওয়া গেল? হেসে বললেন, “সবে প্রথম ধাপ পেরিয়েছি। এখনও অনেকটা পথ বাকি। এটাই চাই, লড়াই যেন
বৃথা না হয়।”
আইএসএলে পাঁচ মরসুম কেটে গেলেও আঁধার কাটেনি পুরুষদের। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলকে স্বপ্ন দেখিয়েছে মেয়েরা। সেই মশাল বহনের পরীক্ষা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ কাহিনির নতুন নায়িকা সৌম্যার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)