ক্রোয়েশিয়াকে তৃতীয় স্থানে শেষ করালেন মদ্রিচ। ছবি: রয়টার্স
গোটা ম্যাচে একের পর এক সুযোগ নষ্টের খেসারত দিল মরক্কো। তৃতীয় স্থানের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া জিতল ২-১ ব্যবধানে। গোল করলেন জসকো গাভার্দিয়ল এবং মিরোস্লাভ ওরসিচ। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর আবার তৃতীয় স্থানে শেষ করল ক্রোয়েশিয়া।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইউরোপের বাকি ১২টি দেশের সঙ্গে যোগ্যতা অর্জন করেছিল আরও একটি দেশ। যেমন পুঁচকে তার আয়তন, তেমনই ক্ষুদ্র তার ফুটবল ইতিহাস। কিন্তু ফুটবল মাঠে দেখা গিয়েছিল তাঁর অন্য রূপ। লাল-সাদা জার্সির আগুনে পারফরম্যান্সে জ্বলে খাক হয়ে গিয়েছিল জামাইকা, জাপান, রোমানিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস। প্রথম বার বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল সেই দল। সেই দলের নেতা ছিলেন দাভর সুকের।
২৪ বছর আগে তাঁর হাত ধরে ক্রোয়েশিয়ার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখনও চলছে। সুকেরের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে বিশ্বকাপে আবার তৃতীয় স্থান পেল ক্রোয়েশিয়া। ৩৯ লক্ষের দেশ গত বার অল্পের জন্য ট্রফি হাতে তুলতে পারেনি। এ বারও চলে গিয়েছিল কাছাকাছি। স্বপ্ন অধরা থাকলেও ফেরানো গেল তৃতীয় স্থান। সুকের যে কাজটা শুরু করেছিলেন, সেটাই এগিয়ে নিয়ে গেলেন লুকা মদ্রিচ। হয়তো এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। এক বার ফাইনাল খেলার পর তৃতীয় স্থান, বিশ্বকাপের ইতিহাস মনে রাখবে তাঁকে।
বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া বলেও যে একটা দল খেলে, তারও যে একটা নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে, এটা জানতে পারা যায় সুকেরের কারণেই। সেই বিশ্বকাপে ছ’টি গোল করেছিলেন তিনি। নিয়মিত দলকে নির্ভরতা দিয়েছিলেন। তৃতীয় স্থানের ম্যাচে সে বার নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। সেই ম্যাচেও গোল করেছিলেন সুকের।
মদ্রিচ আবার গোল বেশি করতে পারেন না। কিন্তু করাতে পারেন। সবচেয়ে বেশি যেটা ভাল পারেন, তা হল গোটা দলকে চালনা করতে। বক্সে নেমে এসে রক্ষণ করছেন। পরের মুহূর্তেই বিপক্ষের বক্সে গিয়ে সতীর্থকে পাস বাড়াচ্ছেন। আবার ছুটছেন কর্নার বা ফ্রিকিক নিতে। কে বলবে তাঁর ৩৭ বছর বয়স। সমবয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে বিদায় নিতে হয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালে কাঁদতে কাঁদতে। সেমিফাইনালে হেরে মদ্রিচের চোখেও এসেছিল জল। কিন্তু কাঁদেননি। সামলে রেখেছিলেন। বিদায়বেলায় রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন গোটা বিশ্বকাপকেই।
রাশিয়া বিশ্বকাপের সময় একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, পাহাড়ি এলাকায় এক খুদে বালককে হাতে লাঠি নিয়ে ভেড়া চড়াতে যেতে। মুখের আদল দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন, সেই ছবি মদ্রিচের। ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলার নিজের মুখে কখনও তা স্বীকার করেননি। তবে স্বীকার না করলেও দুনিয়ার তাতে কিছু আসে যায় না। মদ্রিচের জীবন আসলে ছিল এ রকমই। ছোট থেকেই শুধু লড়াই আর লড়াই।
পাঁচ বছর বয়স থেকে ভেড়া চড়ানো শিখে গিয়েছিলেন মদ্রিচ। যে সময় বেড়ে উঠছিলেন, তখন ক্রোয়েশিয়ায় চলছে স্বাধীনতার লড়াই। গোটা বলকান এলাকাই অশান্ত। রোজ বোমা পড়ছে। মৃত্যুর খবর আসছে। ১৯৯১ সালে যুদ্ধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ়াদার ছেড়ে পালালেন মদ্রিচরা। তার আগে নিজের বাড়ির সামনে দাদুর মৃতদেহ দেখেছিলেন মদ্রিচ। সেই দাদু, যাঁর হাত ধরে ফুটবলের প্রতি প্রথম ভালবাসা তাঁর।
মদ্রিচরা পালানোর পরেই সেই বাড়ি ধসিয়ে দেওয়া হল। সাত বছর জ়াদারের দু’টি হোটেলে থাকল তাঁর পরিবার। সর্ব ক্ষণ বোমা পড়ার ভয়। আর পালিয়ে বাঁচার লড়াই। চারিত্রিক কাঠিন্য তখন থেকেই শুরু। শেষ মেশ হোটেলে থাকতে থাকতেই আশেপাশের সমবয়সীদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু করেন মদ্রিচ। সেখান থেকে জ়াদারের ফুটবল অ্যাকাডেমি। দৌড় চলছে সেই থেকেই।
ছোটবেলা থেকে দৌড়েই চলেছেন মদ্রিচ। তখন দৌড়তেন প্রাণের ভয়ে। এখন দৌড়ন বিপক্ষকে আটকানোর জন্যে বা গোল করার জন্যে। রিয়াল মাদ্রিদ বিরাট অর্থের বিনিময়েও তাঁকে ছাড়তে রাজি হয়নি। কারণ ক্লাবে তাঁর মূল্য কতটা সেটা সবাই জানেন। কোনও অর্থ দিয়ে মদ্রিচের পারফরম্যান্স বিচার করা যায় না। সুকেরের সঙ্গে একটি মিলও রয়েছে মদ্রিচের। দু’জনেই জীবনের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে।
সুকেরকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর আর সে ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু মদ্রিচ টানা দু’টি বিশ্বকাপে নিজের জাত চিনিয়ে গেলেন। গত বিশ্বকাপে যাঁরা তাঁর পাশে খেলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই জুতোজোড়া তুলে রেখেছেন। মদ্রিচ ৩৭ বছর বয়সেও যেন ২০ বছরের তরতাজা যুবক। যে ভাবে বিপক্ষের ফুটবলারের পা থেকে বল কেড়ে নেন, যে ভাবে দৌড়ে তাঁদের পিছনে ফেলে দেন, দেখে কে বুঝবে!
পরের বিশ্বকাপ হয়তো দেখতে পাবে না মদ্রিচকে। কিন্তু যে উত্তরাধিকার তিনি রেখে যাচ্ছেন, তাতে নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়, এই ক্রোয়েশিয়া এত সহজে থামার নয়।
এ দিন ম্যাচের সাত মিনিটেই ক্রোয়েশিয়াকে এগিয়ে দেন জসকো গাভার্দিয়ল। বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া লুকা মদ্রিচের ফ্রিকিক হেডে গোলমুখে ক্রস করেন ইভান পেরিসিচ। চলতি বলে হেড করে গোল করেন গাভার্দিয়ল। তার দু’মিনিট পরে গোল মরক্কোর। সমতা ফেরায় সেই ফ্রিকিক থেকেই। হাকিম জিয়েচ ফ্রিকিক নিয়েছিলেন। মায়ের ক্লিয়ার করতে গিয়ে পিছন দিকে হেড দেন। সেই বলে মাথা ছুঁইয়ে গোল করেন দারি।
প্রথমার্ধে শেষ হওয়ার আগেই এগিয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া। মরক্কো বক্সে একাধিক পাস খেলেন ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলাররা। বক্সের কোনাকুনি জায়গা থেকে দারুণ শটে গোল করেন মিরোস্লাভ ওরসিচ। পোস্টে লেগে জালে জড়াল বল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy